Surah Al Baqarah Tafseer

মাদীনার দু’টি বিখ্যাত গোত্রের শান্তি চুক্তি এবং তা ভঙ্গ করা

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর যামানায় মাদীনার ইয়াহুদীদের মন্দ কর্মসমূহ এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের সময় আউস-খাযরায গোত্রদ্বয়ের প্রতি সাহায্য সহযোগিতা বিবরণ দেয়া হচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, মাদীনার আনসারগণের দু’টি গোত্র ছিলোঃ (১) আউস ও (২) খাযরায। ইসলাম পূর্বে এই গোত্রদ্বয়ের মধ্যে কখনো কোন মিল ছিলো না। পরস্পর যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো। অপর দিকে মাদীনার ইয়াহুদীদের তিনটি গোত্র ছিলোঃ (১) বানূ কাইনুকা, (২) বানু নাযীর ও (৩) বানূ কুরাইযা। বানূ কাইনুকা ও বানূ নাযীর খাযরাজের মিত্র ছিলো এবং তারা বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলো। আর বানূ কুরাইযার বন্ধুত্ব ছিলো আউসের সাথে। আউস ও খাযরাযের মধ্যে যখন যুদ্ধ শুরু হতো তখন ইয়াহহুদীদের তিনটি দল নিজ নিজ মিত্রের সাথে যোগ দিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতো। দুই পক্ষের ইয়াহুদী স্বয়ং তাদেরই হাতে মারাও যেতো এবং সুযোগ পেলে একে অপরের ঘর বাড়ী ধ্বংস করতো এবং দেশ থেকে তাড়িয়েও দিতো। ধন-মালও দখল করে নিতো। অতঃপর যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে পরাজিত দলের ইয়াহুদী বন্দীদেরকে ইয়াহূদীরা তাওরাতে বর্ণিত ‘কয়েদি মুক্তির’ নীতি-মালা দ্বারা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নিতো এবং বলতোঃ ‘আমাদের প্রতি তাদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে নেই। তারই উত্তরে মহান আল্লাহ তাদেরকে বলছেনঃ ‘এর কারণ কি এই যে, আমার এ হুকুম মানছো? কিন্তু আমি তোমাদেরকে বলেছিলাম তোমরা পরস্পর মারামারি করো না, একে অপরকে বাড়ী হতে বের করে দিয়ো না, তা মানছো না কেন? এক হুকুমের ওপর ঈমান আনা এবং অন্য হুকুমকে অমান্য করা, এটা আবার কোন ঈমানদারী?’ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেনঃ নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করো না, নিজেদের লোককে তাদের বাড়ী হতে বের করে দিয়ো না। কেননা তোমরা এক মাযহাবের লোক এবং সবাই এক আত্মার মতো। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ

"مثل المؤمنين في توادهم وتراحمهم وتواصلهم بمنزلة الجسد الواحد، إذا اشتكى منه عضو تداعى له سائر الجسد بالحمى والسهر".

‘সমস্ত মু’মিন পরস্পর বন্ধুত্ব, দয়া ও সাহায্য-সহানুভূতি করার ব্যাপারে একটি শরীরের মতো। কোন একটি অঙ্গের ব্যথার সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে থাকে, শরীরে জ্বর চলে আসে এবং রাতে নিদ্রা হারিয়ে যায়। (সহীহুল বুখারী ১০/৬০১১, সহীহ মুসলিম ৪/৬৬/১৯৯৯, মুসনাদে আহমাদ ৪/২৭০) এরকমই একজন সাধারণ মুসলিমের বিপদে সারা বিশ্ব জাহানের মুসলিমদের অস্থির হওয়া উচিত।

আব্দ খায়ের (রাঃ) বলেনঃ ‘আমরা সালমান ইবনে রাবী‘ (রাঃ) এর নেতৃত্বে ‘বালানজারে’ (চীন দেশের নিকটবর্তী কোন একটি শহরের নাম) জিহাদ করছিলাম। সেটা অবরোধের পর আমরা ঐ শহরটি দখল করি। এর মধ্যে কিছু বন্দীও ছিলো। এদের মধ্যে একটি ক্রীতদাসীকে ‘আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) সাতশ’ দিরহাম দিয়ে কিনে নেন। অতঃপর ‘আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) ইয়াহুদীদেরই একজন ব্যক্তি ‘রাসূল জালুতের’ নিকট দিয়ে গমন কালে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেনঃ হে রাসূল জালূত! এ দাসীটি তোমার ধর্মের নারী। আমি একে সাতশ’ দিরহামের বিনিময়ে কিনেছি। এখন তুমি তাকে কিনে আযাদ করে দাও।’ সে বলেঃ ‘খুব ভালো কথা, আমি চৌদ্দশ’ দিচ্ছি।’ তিনি বলেনঃ ‘আমি চার হাজারের কমে একে বিক্রি করবো না।’ তখন সে বলেঃ ‘তাহলে আমার কেনার প্রয়োজন নেই।’ তিনি বলেনঃ ‘একে ক্রয় করো, নতুবা তোমার ধর্ম চলে যাবে। তাওরাতে লিখিত আছে, বানী ইসরাঈলের কোন একটি লোকও যদি বন্দী হয় তাহলে তাকে কিনে আযাদ করে দাও। সে যদি বন্দি অবস্থায় তোমাদের নিকট আসে তাহলে মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নাও এবং বাস্তুহারা করো না। এখন হয় তাওরাতকে মেনে তাকে ক্রয় করো, আর না হয় তাওরাতকে অস্বীকারা করো।’ সে বুঝে নেয় এবং বলেঃ ‘তুমি কি ‘আবদুল্লাহ ইবনে সালাম? তিনি বলেনঃ ‘হ্যাঁ।’ সুতরাং সে চার হাজার নিয়ে আসে। তিনি দু’হাজার তাকে ফেরত দেন। আদম ইবনে আবি ইয়াস (রহঃ) ও স্বীয় তাফসীরে এমনটি উল্লেখ করেছেন। (সনদ য‘ঈফ)

মোট কথা, কুর’আনুল কারীমের এ আয়াতটিতে ইয়াহুদীদেরকে নিন্দা করা হয়েছে যে, তারা মহান আল্লাহ্‌র নির্দেশাবলী জানা সত্ত্বেও তাকে পৃষ্ঠের পিছনে নিক্ষেপ করেছে। আমানতদারী ও ঈমানদারী তাদের মধ্যে লোপ পেয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর গুণাবলী, তাঁর নির্দেশাবলী, তাঁর জন্মস্থান, তাঁর হিজরাতের স্থান ইত্যাদি সব কিছুতেই তাদের কিতাব লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু এ সবকিছুই তারা গোপন করে রেখেছে। শুধু এটুকুই নয়, বরং তারা তাঁর বিরুদ্ধাচরণও করেছে। এ কারণেই তাদের ওপর ইহলৌকিক লাঞ্ছনা এসেছে এবং পরকালেও তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী কঠিন শাস্তি।