Surah Al Baqarah Tafseer
Tafseer of Al-Baqarah : 26
Saheeh International
Indeed, Allah is not timid to present an example - that of a mosquito or what is smaller than it. And those who have believed know that it is the truth from their Lord. But as for those who disbelieve, they say, "What did Allah intend by this as an example?" He misleads many thereby and guides many thereby. And He misleads not except the defiantly disobedient,
Ibn Kathir Partial
Tafseer 'Ibn Kathir Partial' (BN)
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং অন্য আরো কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। যখন ওপরের তিনটি আয়াতে মুনাফিকদের দু’টি দৃষ্টান্ত বর্ণিত হলো অর্থাৎ আগুন ও পানি, তখন তারা বলতে লাগলো যে, এরকম ছোট ছোট দৃষ্টান্ত মহান আল্লাহ কখনো বর্ণনা করেন না। তার প্রতিবাদে মহান আল্লাহ এই আয়াত দু’টি অবতীর্ণ করেন। (তাফসীর তাবারী ১/৩৯৮) কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, যখন কুর’আনুল হাকীমে মাকড়সা ও মাছির দৃষ্টান্ত বর্ণিত হয়, তখন মুশরিকরা বলতে থাকে যে, কুর’আনের মতো মহান আল্লাহর কিতাবে এরকম নিকৃষ্ট প্রাণীর বর্ণনা দেয়ার প্রয়োজন কী? তাদের এ কথার উত্তরে আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় এবং বলা হয় যে, সত্যের বর্ণনা দিতে মহান আল্লাহ আদৌ লজ্জাবোধ করেন না। তা কমই হোক বা বেশিই হোক। (তাফসীর তাবারী ১/৩৯৯)
পৃথিবীর জীবন যাপনের সাথে তুলনামূলক আলোচনা
রাবী‘ ইবনু আনাস (রহঃ) বলেন যে, এটা একটা মযবূত দৃষ্টান্ত, যা দুনিয়ার দৃষ্টান্তরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মশা ক্ষুধার্ত থাকা পর্যন্ত জীবিত থাকে এবং মোটা তাজা হলেই মৃত্যু বরণ করে। এ রকমই এ লোকেরাও যখন ইহলৌকিক সুখ সম্ভোগ প্রাণভরে ভোগ করে তখনই মহান আল্লাহ তাদেরকে ধরে ফেলেন। যেমন মহান আল্লাহ এক জায়গায় বলেনঃ
﴿فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُكِّرُوْا بِه فَتَحْنَا عَلَیْهِمْ اَبْوَابَ كُلِّ شَیْءٍ﴾
অতঃপর তাদেরকে যা কিছু উপদেশ ও নাসীহত দেয়া হয়েছিলো, তা যখন তারা ভুলে গেলো তখন আমি সুখ শান্তির জন্য প্রতিটি বস্তুর দরজা উন্মুক্ত করে দিলাম। (৬ নং সূরাহ্ আন‘আম, আয়াত নং ৪৪, তাফসীর তাবারী ১/৩৯৮) ইবনু জারীর (রহঃ) এবং ‘আদী ইবনু আবী হাতিম (রহঃ)-এরূপ বর্ণনা করেছেন।
فما فوقها-এর দু’টি অর্থ। একটি হলো যে, তার চেয়েও হালকা ও খারাপ জিনিস। যেমন কেউ কোন লোকের কৃপণতা ইত্যাদির কথা বর্ণনা করলে অন্যজন বলে যে, সে আরো ওপরে। তখন ভাবার্থ এই যে, এই দোষে সে আরো নীচে নেমে গেছে। কাসাঈ এবং আবূ আবীদ এটাই বলে থাকেন।
একটি হাদীসে আছে যে, যদি দুনিয়ার কদর মহান আল্লাহর কাছে একটি মশার ডানার সমানও হতো তবে কোন কাফিরকে এক ঢোক পানিও দেয়া হতো না। দ্বিতীয় অর্থ এই যে, তার চেয়ে বেশি বড়। কেননা মশার চেয়ে ছোট প্রাণী আর কি হতে পারে? কাতাদাহ ইবনু দা‘আমার অভিমত এটাই। আর ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) এ অভিমতকে পছন্দ করেন।
সহীহ মুসলিমে আছেঃ
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُشَاكُ شَوْكَةً فَمَا فَوْقَهَا إِلاَّ كُتِبَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ.
‘যদি কোন মুসলিমের পায়ে কাঁটা ফুঁড়ে অথবা এর চেয়েও বেশি কিছু হয় তাহলে তার জন্যও তার মর্যাদা বেড়ে যায় এবং পাপ মোচন হয়।’ (হাদীস সহীহ। সহীহ মুসলিম ৪/১৯৯১) এ হাদীসেও فَمَا فَوْقَهَا শব্দটি আছে। ভাবার্থ হচ্ছে এই যে, যেমন এ ছোট-বড় জিনিসগুলো সৃষ্টি করতে মহান আল্লাহ লজ্জাবোধ করেন না, তেমনই সেগুলোকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ বর্ণনা করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ও সংকোচ নেই। কুর’আনুল হাকীমে মহান আল্লাহ এক জায়গায় বলেনঃ
﴿یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَه اِنَّ الَّذِیْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ لَنْ یَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَّ لَوِ اجْتَمَعُوْا لَه وَ اِنْ یَّسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَیْـًٔا لَّا یَسْتَنْقِذُوْهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَ الْمَطْلُوْبُ﴾
‘হে লোকসকল! একটি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছে, তোমরা কান লাগিয়ে শোন তোমরা মহান আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ উদ্দেশে তারা সবাই একত্রিত হলেও এবং মাছি যদি তাদের নিকট হতে কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় এটাও তারা এর নিকট হতে উদ্ধার করতে পারবে না; পূজারী ও পূজিত কতোই না দুর্বল!’ (২২ নং সূরাহ্ হাজ্জ, আয়াত নং ৭৩) অন্য স্থানে মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿ مَثَلُ الَّذِیْنَ اتَّخَذُوْا مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ اَوْلِیَآءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبُوْتِ١ۚۖ اِتَّخَذَتْ بَیْتًا وَ اِنَّ اَوْهَنَ الْبُیُوْتِ لَبَیْتُ الْعَنْكَبُوْتِ١ۘ لَوْ كَانُوْا یَعْلَمُوْنَ ﴾
মহান আল্লাহর পরিবর্তে যারা অপরকে অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টান্ত মাকড়সা, যে নিজের জন্য ঘর তৈরী করে; এবং ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই তো দুর্বলতম, যদি তারা জানতো। (২৯ নং সূরাহ্ ‘আনকাবূত, আয়াত নং ৪১) অন্যত্র মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
﴿ اَلَمْ تَرَ كَیْفَ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا كَلِمَةً طَیِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَیِّبَةٍ اَصْلُهَا ثَابِتٌ وَّ فَرْعُهَا فِی السَّمَآءِۙ۲۴ تُؤْتِیْۤ اُكُلَهَا كُلَّ حِیْنٍۭ بِاِذْنِ رَبِّهَا١ؕ وَ یَضْرِبُ اللّٰهُ الْاَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ۲۵ وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِیْثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِیْثَةِ اِ۟جْتُثَّتْ مِنْ فَوْقِ الْاَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ۲۶ یُثَبِّتُ اللّٰهُ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ فِی الْاٰخِرَةِ١ۚ وَ یُضِلُّ اللّٰهُ الظّٰلِمِیْنَ١ۙ۫ وَ یَفْعَلُ اللّٰهُ مَا یَشَآءُ﴾
তুমি কি লক্ষ্য করো না মহান আল্লাহ কিভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎ বাক্যের তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষ যার মূল সুদৃঢ় এবং যার প্রশাখা উর্ধ্বে বিস্তৃত, যা প্রত্যেক মওসুমে ফল দান করে তার রবের অনুমতিক্রমে এবং মহান আল্লাহ মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে। কু-বাক্যের তুলনা এক মন্দ বৃক্ষ যার মূল ভূ-পৃষ্ঠ হতে বিচ্ছিন্ন, যার কোন স্থায়িত্ব নেই। যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে ইহজীবন ও পরজীবনে মহান আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং যারা যালিম, মহান আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন; মহান আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন। (১৪ নং সূরাহ্ ইবরাহীম, আয়াত নং ২৪-২৭) অন্য স্থানে মহান আল্লাহ সেই ক্রীতদাসের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেনঃ
﴿ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا عَبْدًا مَّمْلُوْكًا لَّا یَقْدِرُ عَلٰى شَیْءٍ﴾
মহান আল্লাহ উপমা দিচ্ছেন অপরের অধিকারভুক্ত এক দাসের, যে কোন কিছুর ওপর শক্তি রাখে না। (১৬ নং সূরাহ্ নাহল, আয়াত নং ৭৫) তিনি অন্যত্র বলেনঃ
﴿وَ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا رَّجُلَیْنِ اَحَدُهُمَاۤ اَبْكَمُ لَا یَقْدِرُ عَلٰى شَیْءٍ وَّ هُوَ كَلٌّ عَلٰى مَوْلٰىهُ١ۙ اَیْنَمَا یُوَجِّهْهُّ لَا یَاْتِ بِخَیْرٍ١ؕ هَلْ یَسْتَوِیْ هُوَ١ۙ وَ مَنْ یَّاْمُرُ بِالْعَدْلِ﴾
মহান আল্লাহ আরো উপমা দিচ্ছেন দু’ ব্যক্তির; এদের একজন মূক, কোন কিছুরই শক্তি রাখে না এবং সে তার মালিকের জন্য বোঝা স্বরূপ; তাকে যেখানেই পাঠানো হোক না কেন সে ভালো কিছুই করে আসতে পারে না; সে কি সমান হবে ঐ ব্যক্তির মতো যে ন্যায়ের নির্দেশ দেয়? (১৬ নং সূরাহ্ নাহল, আয়াত নং ৭৬) অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ
﴿ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلًا مِّنْ اَنْفُسِكُمْ١ؕ هَلْ لَّكُمْ مِّنْ مَّا مَلَكَتْ اَیْمَانُكُمْ مِّنْ شُرَكَآءَ فِیْ مَا رَزَقْنٰكُمْ﴾
মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেনঃ তোমাদেরকে আমি যে রিয্ক দিয়েছি তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের কেউ কি তাতে তোমাদের সমান অংশীদার? (৩০ নং সূরাহ্ রূম, আয়াত নং ২৮)
মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ ضَرَبَ اللّٰهُ مَثَلًا رَّجُلًا فِیْهِ شُرَكَآءُ مُتَشٰكِسُوْنَ
‘মহান আল্লাহ একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছেনঃ এক ব্যক্তি যার মুনিব অনেক যারা পরস্পরের বিরোধী।’ (৩৯ নং সূরাহ আয যুমার, আয়াত ২৯) মহান আল্লাহ অন্যত্র আরো বলেনঃ
وَ تِلْكَ الْاَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِۚ وَ مَا یَعْقِلُهَاۤ اِلَّا الْعٰلِمُوْنَ
‘এ সব দৃষ্টান্ত আমি মানুষদের জন্য বর্ণনা করছি, কেবল জ্ঞানীরাই তা বুঝে।’ (২৯ নং সূরাহ আল ‘আনকাবূত, আয়াত-৪৩) কুর’আন মাজীদে এরকম দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে।
পূর্ববর্তী কোন একজন বিদ্যান বলেছেনঃ আমি কুর’আন মাজীদের কোন একটি দৃষ্টান্ত শোনার পর তা অনুধাবন করতে না পারলে ক্রন্দন করি। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿وَ تِلْكَ الْاَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِۚ وَ مَا یَعْقِلُهَاۤ اِلَّا الْعٰلِمُوْنَ﴾
‘এ সব দৃষ্টান্ত আমি মানুষদের জন্য বর্ণনা করছি, কেবল জ্ঞানীরাই তা বুঝে।’ (২৯ নং সূরাহ আল ‘আনকাবূত, আয়াত-৪৩) কুর’আন মাজীদে এরকম দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেনঃ মু’মিনগণ এ কথায় বিশ্বাসী যে, তারা ছোট-বড় যে বিষয়েরই সম্মুখীন হয় তা মহান আল্লাহর তরফ থেকেই হয়ে থাকে এবং মহান আল্লাহ বিশ্বাসীদের সু-পথপ্রদর্শন করেন। (তাফসীর ইবনু আবী হাতিম ১/৯৩)
فَاَمَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا فَیَعْلَمُوْنَ اَنَّهُ الْحَقُّ ‘অতএব যারা ঈমানদার তারা জানে যে, এ সত্য তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে।’ কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, অত্র অংশে ‘তারা জানে’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তারা এটা জানে যে, এ কুর’আন দয়াময় মহান আল্লাহর বাণী এবং তা মহান আল্লাহর নিকট থেকেই আগত। মুজাহিদ, হাসান বাসরী ও রাবী‘ ইবনু আনাস (রহঃ) থেকে এরূপই বর্ণিত হয়েছে।
আবুল ‘আলীয়া (রহঃ) বলেন, ‘অতএব যারা ঈমানদার তারা জানে যে, এ সত্য তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে এসেছে’ এবং ‘আর যারা অবিশ্বাসী তারা বলে যে, মহান আল্লাহ কী উদ্দেশে এ উদাহরণ পেশ করেছেন?’ এগুলো সূরাহ মুদ্দাস্সির এ বর্ণিত নিম্নোক্ত কথাগুলোর মতোই। মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿ وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ إِلَّا مَلَائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادَ الَّذِينَ آَمَنُوا إِيمَانًا وَلَا يَرْتَابَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُونَ وَلِيَقُولَ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ وَالْكَافِرُونَ مَاذَا أَرَادَ اللهُ بِهَذَا مَثَلًا كَذَلِكَ يُضِلُّ اللهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَمَا يَعْلَمُ جُنُودَ رَبِّكَ إِلَّا هُوَ﴾
‘আমিই কেবল ফিরিশতাগণকে জাহান্নামের তত্ত্বাবধায়ক করেছি। আর তাদের এই সংখ্যাকে কাফিরদের জন্য একটা পরীক্ষা বানিয়ে দিয়েছি কেননা তারা এ কথা বিশ্বাসই করতে পারবে না যে মাত্র ঊনিশ জন ফিরিশতা বিশাল জাহান্নামের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে। আর যেন কিতাবধারীগণ তা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে আর ঈমানদারদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায় এবং কিতাবধারীগণ ও ঈমানদারগণ যেন কোন রকম সন্দেহের মধ্যে না থাকে। যাদের অন্তরে রোগ আছে তারা আর কাফিররা যাতে বলে উঠে, “এ ধরনের কথা দিয়ে মহান আল্লাহ কী বোঝাতে চেয়েছেন?” এভাবে মহান আল্লাহ যাকে চান গোমরাহ করেন আর যাকে চান সঠিক পথে পরিচালিত করেন। তোমার প্রতিপালকের বাহিনী কারা এবং এর সংখ্যা কতো সে সম্পর্কে তিনি ছাড়া কেউ জানে না।’ (৭৪ নং সূরাহ আল মুদ্দাসসির, আয়াত ৩১) এভাবে মহান আল্লাহ এখানে বলেছেনঃ
﴿یُضِلُّ بِه كَثِیْرًا١ۙ وَّیَهْدِیْ بِه كَثِیْرًا وَ مَا یُضِلُّ بِهۤ اِلَّا الْفٰسِقِیْنَ﴾
‘তিনি এর দ্বারা অনেককেই বিভ্রান্ত করেন। আবার অনেককেই সৎপথে পরিচালিত করেন। বস্তুত তিনি ফাসিকদের ছাড়া আর কাউকেও বিভ্রান্ত করেন না।’
অত্র আয়াতাংশের তাফসীরে সুদ্দী (রহঃ) বর্ণনা করেন, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ), ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবীগণ (রাঃ) বলেছেন যে, ‘এভাবে সে অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে’ এর অর্থ হলো মুনাফিক। মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে সঠিক পথপ্রদর্শন করেন এবং আয়াত অস্বীকারকারী পথভ্রষ্টদের পথভ্রষ্টতা আরো বাড়িয়ে দেন, যদিও তারা জানে যে, মহান আল্লাহর আয়াত সত্য। আর এটাই হলো মহান আল্লাহ কর্তৃক কাউকে বিপথে চালিত করা। (তাফসীর তাবারী ১/৪০৮)
أَنَّه এখানেও হিদায়াত ও গোমরাহীর বর্ণনা রয়েছে। সাহাবীগণ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। এর দ্বারা মুনাফিক পথভ্রষ্ট হয় এবং মু’মিন সুপথ প্রাপ্ত হয়। মুনাফিকরা ভ্রান্তির মধ্যে বেড়েই চলে, কেননা এ দৃষ্টান্ত যে সত্য তা জানা সত্ত্বেও তারা একে অবিশ্বাস করে, আর মু’মিন এটা বিশ্বাস করে ঈমান আরো বাড়িয়ে নেয়।
فَاسِقِين-এর ভাবার্থ হচ্ছে ‘মুনাফিক’। কেউ কেউ এর অর্থ নিয়েছেন ‘কাফির’- যারা জেনে শুনে অস্বীকার করে। সা‘দ (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা খারেজীদেরকে বুঝানো হয়েছে।
যে ব্যক্তি আনুগত্য হতে বেরিয়ে যায়, ‘আরবী পরিভাষায় তাকে ফাসিক বলা হয়। খোলস সরিয়ে খেজুরের শীষ বের হলে ‘আরবরা فَسَقَت বলে থাকে। ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে ক্ষতি সাধন করতে থাকে বলে তাকেও فَوَيسِقَة বলা হয়। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
خَمْسٌ فَوَاسِقُ يُقْتَلْنَ فِى الْحِلِّ وَالْحَرَمِ الْغُرَابُ والحدأة والعقرب وَالْفَارَةُ وَالْكَلْبُ الْعَقُورُ
‘পাঁচটি প্রাণী ‘ফাসিক।’ কা‘বা ঘরের মধ্যে এবং এর বাইরে এদেরকে হত্যা করা যাবে। এগুলো হচ্ছেঃ ১. কাক, ২. চিল, ৩. বিচ্ছু, ৪. ইঁদুর এবং ৫. কালো কুকুর। (হাদীস সহীহ। সহীহুল বুখারী-৩১৩৬, সহীহ মুসলিম ২/৮৫৬)
সুতরাং কাফির এবং প্রত্যেক অবাধ্য ব্যক্তিই ফাসিকের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কাফিরদের ফাসিকী সবচেয়ে জঘন্য এবং সবচেয়ে খারাপ। আর এ আয়াতে ফাসিকের ভাবার্থ হচ্ছে কাফির। মহান আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন। এর বড় দালীল এই যে, একটু পরেই তাদের দোষ বর্ণনা করা হয়েছে। তা হচ্ছে মহান আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করা, তাঁর নির্দেশ অমান্য করা, যমীনে ঝগড়া-বিবাদ করা, আর কাফিররাই এসব দোষে জড়িত রয়েছে, মু’মিনদের বিশেষণতো এর সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে থাকে। যেমন মহান আল্লাহ মু’মিনদের বিশেষণ উল্লেখ করে ঘোষণা করেনঃ
﴿اَفَمَنْ یَّعْلَمُ اَنَّمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ مِنْ رَّبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ اَعْمٰى١ؕ اِنَّمَا یَتَذَكَّرُ اُولُوا الْاَلْبَابِۙ۱۹ الَّذِیْنَ یُوْفُوْنَ بِعَهْدِ اللّٰهِ وَ لَا یَنْقُضُوْنَ الْمِیْثَاقَۙ۲۰ وَ الَّذِیْنَ یَصِلُوْنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنْ یُّوْصَلَ وَیَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَ یَخَافُوْنَ سُوْٓءَ الْحِسَابِ﴾
‘তোমার রাব্ব হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা যে ব্যক্তি সত্য বলে জানে সে আর যে অন্ধ, তারা উভয়ে কি সমান? উপদেশ গ্রহণ করে শুধু বিবেকবুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিরাই। যারা মহান আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে না, আর মহান আল্লাহ যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ করেছেন যারা তা অক্ষুন্ন রাখে, ভয় করে তাদের রাব্বকে এবং ভয় করে কঠোর হিসাববেক। (১৩ নং সূরাহ্ রা‘দ, আয়াত নং ১৯-২১) তারপরেই বলা হয়েছেঃ
﴿وَ الَّذِیْنَ یَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللّٰهِ مِنْۢ بَعْدِ مِیْثَاقِهٖ وَ یَقْطَعُوْنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنْ یُّوْصَلَ وَ یُفْسِدُوْنَ فِی الْاَرْضِ١ۙ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَ لَهُمْ سُوْٓءُ الدَّارِ﴾
‘যারা মহান আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখতে মহান আল্লাহ আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায়, তাদের জন্য আছে অভিসম্পাত এবং আছে মন্দ আবাস।’ (১৩ নং সূরাহ্ রা‘দ, আয়াত নং ২৫)
অঙ্গীকার নির্ধারণে বিভিন্ন মনিষীগণের উক্তি
অঙ্গীকার হচ্ছে মহান আল্লাহর সম্পূর্ণ নির্দেশ মেনে চলা এবং সমস্ত নিষেধাজ্ঞা থেকে বিরত থাকা। তাকে ভেঙ্গে ফেলার অর্থ হচ্ছে, তার ওপর ‘আমল না করা। কেউ কেউ বলেন যে, অঙ্গীকার ভঙ্গকারীরা হচ্ছে আহলে কিতাবের কাফির ও মুনাফিরা। অঙ্গীকার হচ্ছে সেটাই যা তাওরাতে তাদের কাছে থেকে নেয়া হয়েছিলো যে, তারা এর সমস্ত কথা মেনে চলবে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আনুগত্য স্বীকার করবে, তাঁর নাবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস করবে এবং তিনি মহান আল্লাহর নিকট হতে যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সত্য মনে করবে। আর ‘অঙ্গীকার ভঙ্গ করা’ দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, তারা জেনে-শুনে তাঁর নাবুওয়াত ও আনুগত্য অস্বীকার করেছে এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সেটাকে গোপন রেখেছে, আর পার্থিব স্বার্থের কারণে এর উল্টা করেছে।
কেউ কেউ বলেন যে, এর ভাবার্থ কোন নির্দিষ্ট দলকে বুঝানো হয়নি, বরং সমস্ত কাফির, মুশরিক ও মুনাফিককে বুঝানো হয়েছে। অঙ্গীকারের ভাবার্থ এই যে, মহান আল্লাহর একত্মবাদ এবং তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নাবুওয়াতকে স্বীকার করা, যার প্রমাণে প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী ও বড় বড় মু‘জিযাহ বিদ্যমান রয়েছে। আর এটা ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এবং অস্বীকার করা। এই কথাটিই বেশি মযবূত ও যুক্তিসঙ্গত। ইমাম যামাখ্শারীর (রহঃ)-এর মতামতও এদিকেই। তিনি বলেন যে, অঙ্গীকারের অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহর একত্মবাদের বিশ্বাস করা, যা মানবীয় প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। মহান আল্লাহ বলেনঃ
أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى ‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’ (৭ নং সূরাহ আল ‘আ‘রাফ, ১৭২) তখন সবই উত্তর দিয়েছিলো, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আপনি আমাদের প্রভু।’ অতঃপর যেসব কিতাব দেয়া হয়েছে তাতেও অঙ্গীকার করানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ ﴿وَأَوْفُوا بِعَهْدِي أُوفِ بِعَهْدِكُمْ﴾
‘তোমরা আমার অঙ্গীকার পুরা করো, আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পুরা করবো।’ (২ নং সূরাহ আল বাকারা, আয়াত-৪০) কেউ কেউ বলেন যে, অঙ্গীকারের ভাবার্থ হচ্ছে সেই অঙ্গীকার যা আত্মাসমূহের নিকট হতে নেয়া হয়েছিলো, যখন তাদেরকে আদম (আঃ)-এর পৃষ্ঠদেশ হতে বের করা হয়েছিলো। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى﴾
‘তোমাদের প্রভু যখন আদম (আঃ)-এর সন্তানদের নিকট অঙ্গীকার নিয়েছিলেন, আমিই তোমাদের প্রভু এবং তারা সবাই স্বীকার করেছিলেন।’ (৭ নং সূরাহ আল ‘আ‘রাফ, ১৭২) আর একে ভেঙ্গে দেয়ার অর্থ হচ্ছে একে ছেড়ে দেয়া। এ সমুদয় কথা তাফসীর ইবনু জারীরে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
মুনাফিকের লক্ষণ
আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) বলেনঃ ‘মহান আল্লাহর অঙ্গীকার ভেঙ্গে দেয়া যা মুনাফিকদের কাজ ছিলো, তা হচ্ছে এই ছয়টি অভ্যাসঃ (১) কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, (২) প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা, (৩) গচ্ছিত বস্তু আত্মসাৎ করা, (৪) মহান আল্লাহর অঙ্গীকার দৃঢ় করণের পর তা ভঙ্গ করা, (৫) যা অবিচ্ছিন্ন রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন করা এবং (৬) পৃথিবীতে বিবাদের সৃষ্টি করা। তাদের এই ছয়টি অভ্যাস তখনই প্রকাশ পায় যখন তারা জয়যুক্ত হয়। আর যখন তারা পরাজিত হয় তখন তারা প্রথম তিনটি কাজ করে থাকে।’
সুদ্দী (রহঃ) বলেন যে, কুর’আনের আদেশ ও নিষেধাবলী পড়া, সত্য বলে জানা, তারপর না মানাও ছিলো অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। মহান আল্লাহ যা মিলিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন- এর ভাবার্থ হচ্ছে আত্মীয়তার বন্ধন অবিচ্ছিন্ন রাখা এবং আত্মীয়দের হক আদায় করা ইত্যাদি। যেমন কুর’আন মাজীদে এক জায়গায় আছেঃ
﴿فَهَلْ عَسَیْتُمْ اِنْ تَوَلَّیْتُمْ اَنْ تُفْسِدُوْا فِی الْاَرْضِ وَ تُقَطِّعُوْۤا اَرْحَامَكُمْ ﴾
‘ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। (৪৭ নং সূরাহ্ মুহাম্মাদ, আয়াত নং ২২, তাফসীর তাবারী ১/৪১৬)
ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) একেই প্রাধান্য দিয়েছেন। আবার এটাও বলা হয়েছিলো যে, আয়াতটি সাধারণ। যা মিলিত রাখার ও আদায় করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো তা তারা ছিন্ন করেছিলো এবং আদায় করেনি। خَاسِرُوْنَ-এর অর্থ হচ্ছে আখিরাতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ﴾
“তাদের ওপর হবে লা‘নত এবং তাদের পরিণাম হবে খারাপ।” (১৩ নং সূরাহ্ রা‘দ, আয়াত নং ২৫)
‘ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া’ কী
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেছেন যে, কুর’আন মাজীদে মুসলিম ছাড়া অন্যদেরকে যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে সেখানে ভাবার্থ হবে কাফির এবং যেখানে মুসলিমকে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে সেখানে অর্থ হবে পাপী। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿اُولٰٓىِٕكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَ لَهُمْ سُوْٓءُ الدَّارِ ﴾
তাদের জন্য অভিসম্পাত এবং আছে মন্দ আবাস। (১৩ নং সূরাহ্ রা‘দ, আয়াত নং ২৫)
خَاسِرُوْنَ শব্দটি خَاسِرٌ-এর বহুবচন। জনগণ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে এবং দুনিয়ার মোহে পড়ে মহান আল্লাহর রহমত হতে সরে গেছে বলে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত বলা হয়েছে। মুনাফিক ও কাফির ব্যবসায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মতোই। যখন মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের খুবই প্রয়োজন হবে অর্থাৎ কিয়ামতের দিন। সেই দিন এরা মহান আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত থাকবে।
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings