Surah Al Baqarah Tafseer
Tafseer of Al-Baqarah : 1
Saheeh International
Alif, Lam, Meem.
Ibn Kathir Partial
Tafseer 'Ibn Kathir Partial' (BN)
সূরাহ্ বাক্বারাহ্ মাদীনায় অবতীর্ণ
সূরাহ্ বাক্বারার সম্পূর্ণ অংশই মাদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং মাদীনায় প্রথম যেসব সূরাহ্ অবতীর্ণ হয়েছে, এটিও তার একটি। তবে অবশ্যই এর ﴿وَاتَّقُوْا یَوْمًا تُرْجَعُوْنَ فِیْهِ اِلَى اللّٰهِ﴾ ‘তোমরা সেদিনের ভয় করো, যেদিন তোমাদের মহান আল্লাহ্র দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ (২ নং সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্, আয়াত নং ২৮১) বলা হয়ে থাকে যে, এ আয়াতটি কুর’আনের সর্বশেষে অবতীর্ণ হয়েছে। আর তা এরূপ হওয়ার সম্ভাবনাই রাখে। এভাবে সুদের নিষিদ্ধতার আয়াতগুলোও শেষের দিকে নাযিল হয়েছে। খালিদ ইবনু মি‘দান সূরাহ্ আল বাক্বারাকে فُسْطَاط القُرْآنِ অর্থাৎ কুর’আনের শিবির বলতেন। কিছু সংখ্যক ‘আলিমের উক্তি আছে যে, এর মধ্যে এক হাজার সংবাদ, এক হাজার আদেশ এবং এক হাজার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এতে দু’শ’ সাতাশিটি আয়াত আছে। এর শব্দ হচ্ছে ছয় হাজার দু’শ’ একুশটি এবং এতে অক্ষর আছে পঁচিশ হাজার পাঁচশ’টি। মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এ সূরাটি মাদানী। ‘আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রাঃ), যায়দ ইবনু সাবিত (রাঃ) এবং বহু ইমাম, ‘আলিম এবং মুফাস্সির থেকে সর্বসম্মতভাবে এটাই বর্ণিত হয়েছে।
ইবনু মারদুওয়াই আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা সূরাহ বাকারাহ, সূরাহ আলি ‘ইমরান, সূরাহ আন্ নিসা এমনিভাবে কুর’আনে উল্লিখিত কোন সূরাকেই এভাবে নাম উল্লেখ করে বলো না। বরং তোমরা বলো, ঐ সূরাহ যাতে গাভীর আলোচনা রয়েছে। ঐ সূরাহ যাতে ‘ইমরানের পরিবার পরিজনের কথা উল্লেখ আছে। এভাবে কুর’আনে উল্লিখিত সকল সূরাহ বলার ক্ষেত্রে এ নীতির অনুস্মরণ করবে।” (হাদীসটি য‘ঈফ) তবে হাদীসটি গারীব। মারফূ‘ ভাবে বর্ণনা করা কোনক্রমেই শুদ্ধ নয়। অত্র হাদীসের সনদে ‘ঈসা ইবনু মায়মূন যিনি আবূ সালামাহ আল খাওয়াস। তিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে য‘ঈফ। তার মাধ্যমে কোন দালীল সাব্যস্ত করা যায় না। (মুসান্নিফ ইবনু কাসীরের ন্যায় হায়সামী (রহঃ) ও স্বীয় মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডের ১৫৭ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন। আর ইমাম তাবারানী স্বীয় আওসাত নামক গ্রন্থে বলেছেন এর সনদে ‘ঈসা ইবনু মায়মূন একজন মাতরূক তথা বর্জনীয় রাবী)
অবশ্য সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি ‘বাত্নে ওয়াদীতে শায়তানের ওপর পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন। বায়তুল্লাহ তাঁর বাম দিকে ছিলো ও মিনা ছিলো তাঁর ডান দিকে এবং তিনি বলছিলেনঃ ‘এ স্থান থেকেই রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন যাঁর ওপর সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ অবতীর্ণ হয়েছিলো।’
ইবনু মিরদুওয়াই (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে কিছু শিথিলতা লক্ষ্য করলেন তখন মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে يَا اَصْحَابَ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ বলে ডাক দিলেন। খুব সম্ভব এটা হুনায়নের যুদ্ধের ঘটনা হবে। যখন মুসলিম সৈন্যদের পদস্খলন ঘটেছিলো, তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নির্দেশক্রমে ‘আব্বাস (রাঃ) তাদেরকে ‘হে গাছওয়ালাগণ!’ অর্থাৎ ‘হে বায়‘আতে রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারীগণ’ এবং ‘হে সূরাহ্ বাক্বারাহ্ ওয়ালাগণ’ বলে ডাক দিয়েছিলেন। যেন তাঁদের মধ্যে আনন্দ ও বীরত্বের সৃষ্টি হয়। সুতরাং সেই ডাক শোনা মাত্রই সাহাবীগণ (রাঃ) চতুর্দিক থেকে বিদ্যুৎ গতিতে দৌঁড়ে এলেন। মুসায়লামাতুল কাজ্জাব নাবুওয়াতের যে মিথ্যা দাবী করেছিলো, তার সাথে যুদ্ধ করার সময়ও ইয়ামামার রণ প্রান্তরে বানূ হানীফার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মুসলিমদেরকে বেশ বিচলিত ও সন্ত্রস্ত করেছিলো এবং তাঁদের পা টলমল করে উঠছিলো। তখন সাহাবীগণ (রাঃ) এভাবেই লোকদেরকে يَا اَصْحَابَ سُوْرَةِ الْبَقَرَةِ বলে ডাক দিয়েছিলেন। সে শব্দ শুনে সবাই ফিরে এসে একত্রিত হয়েছিলেন, আর এমন শৌর্য ও বীরত্বের সাথে প্রাণপণে যুদ্ধ করছিলেন যে, মহান আল্লাহ সেই ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে মুসলিমদেরকেই জয়ী করেছিলেন, মহান আল্লাহ তাঁর রাসূল ও সাহাবীগণের ওপর সব সময় সন্তুষ্ট থাকুন। (আল মাজমা’ ৬/১৮০)
সূরাহ্ আল বাক্বারার গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও গুণাবলী
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ) মা‘কাল ইবনু ইয়াসির (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
اَلْبَقَرَةُ سَنَامُ الْقُرْآنِ وَذُرْوَتُهُ نَزَلَ مَعَ كُلِّ آيَةٍ مِنْهَا ثَمَانُونَ مَلَكًا وَاسْتُخْرِجَتْ {الله لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ } مِنْ تَحْتِ الْعَرْشِ فَوُصِلَتْ بِهَا أَوْ فَوُصِلَتْ بِسُورَةِ الْبَقَرَةِ وَيس قَلْبُ الْقُرْآنِ لَا يَقْرَؤُهَا رَجُلٌ يُرِيدُ اللهَ تَبَارَكَ وَتَعَالَى وَالدَّارَ الْآخِرَةَ إِلَّا غُفِرَ لَهُ وَاقْرَءُوهَا عَلَى مَوْتَاكُمْ.
‘সূরাহ আল বাকারা কুর’আনের কূজ ও তার চূড়া। এর প্রতিটি আয়াতের সাথে ৮০ জন করে ফিরিশতা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। আর اَللهُ لَا إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ আয়াতটি ‘আরশে ‘আযীম এর নিচ থেকে নির্গত করে এই সূরাহ্ আল বাকারার সাথে মিলে দেয়া হয়েছে। আর সূরাহ ইয়াসীন হলো কুর’আনুল কারীমের হৃদয় বা অন্তর। কোন ব্যক্তি মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং পরকাল লাভের জন্য পড়লে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর তোমরা এ সূরাহটি মুমূর্ষ ব্যক্তির নিকট পাঠ করো। ইমাম আহমাদ একাই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (হাদীসটি য‘ঈফ। মুসনাদ আহমাদ, ৫/২৬, হাদীস ২০৩০০, এর মধ্যে একজন অপরিচিত রাবী আছে যার নাম উল্লেখ করা হয়নি। অবশ্য ইবনু কাসীর (রহঃ) উক্ত অস্পষ্ট রাবীর নাম আবূ ‘উসমান বলে উল্লেখ করেছেন, তবে তিনি আবূ ‘উসমান আন নাহদী নয়। ইবনু হাজার এই আবূ ‘উসমানকে মাকবূল বা গ্রহণযোগ্য রাবী বলেছেন। আর ‘আল্লামাহ নাসিরুদ্দীন আলবানী হাদীসটিকে তাঁর সিলসিলাতুয য‘ঈফার মধ্যে উল্লেখ করা সত্তেও য‘ঈফ বলেছেন এবং সিলসিলাতুয য‘ঈফার মধ্যেও তা বর্ণনা করেছেন) অবশ্য ইমাম আহমাদ অত্র হাদীসটি ‘আরিম থেকে তিনি ‘আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক থেকে তিনি সুলাইমান আত তায়মী থেকে তিনি আবূ ‘উসমান থেকে তিনি তাঁর পিতা থেকে তিনি মা‘কাল ইবনু ইয়াসির (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ اِقْرَءُوهَا عَلَى مَوْتَاكُمْ ‘তোমরা এ সূরাহটি অর্থাৎ সূরাহ ইয়াসীন মুমুর্ষ ব্যক্তির নিকট পাঠ করো। (হাদীসটি য‘ঈফ। সুনান আবূ দাঊদ ৩/৩১২১, ইবনু মাজাহ, ১/১৪৪৮, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫৬৫, মুসনাদ আহমাদ ৫/২৬, ২৭, সুনানুল কুবরা লিলবায়হাকী ৩/৩৮৩, ইমাম হাকিম বলেন যে, ইয়াহ্ইয়া ইবনু সা‘ঈদ এবং অন্যান্যগণ সুলায়মান আত তায়মী থেকে মাওকূফ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম যাহাবীও মাওকূফ বলেছেন) তবে তিনি আবূ ‘উসমান আন নাহদী নন। আর এ সূত্র উল্লেখ করার মাধ্যমে আমরা পূবের্র সনদে বর্ণিত অস্পষ্ট রাবী‘কে স্পষ্ট করলাম। আর ইমাম তিরমিযী (রহঃ) য‘ঈফ সনদে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘প্রতিটি বস্তুর একটা কূজ থাকে আর কুর’আনের কূজ হলো সূরাহ আল বাকারাহ। আর এই সূরাতে একটি আয়াত আছে যা কুর’আনের আয়াতসমূহের নেতা। আর তা হলো আয়াতুল কুরসী।’ (হাদীস য‘ঈফ। জামি‘ তিরমিযী, ৫/২৮৭৮, ইমাম তিরমিযী বলেন, এই হাদীসটি গারীব, এই সূত্র ব্যতীত অন্য কোন সূত্রে এই হাদীসটি আমাদের জানা নেই)
মুসনাদ আহমাদ, সহীহ মুসলিম, জামি‘ তিরমিযী এবং সুনান নাসাঈতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্র্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِى تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ.
‘তোমরা নিজেদের ঘরকে কবরে পরিণত করো না, যে ঘরে সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ পাঠ করা হয় সেখানে শায়তান প্রবেশ করতে পারে না।’ (হাদীসটি সহীহ। সহীহ মুসলিম ১/২১২, ৫৩৯, মুসনাদ আহমাদ ২/২৮৪, ৩৩৭, জামি‘ তিরমিযী ৫/২৮৭৭, নাসাঈ ৫/১৩/৮০১৫। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) একে হাসান সহীহ বলেছেন) অন্য একটি হাদীসে আছে যে, যে ঘরে সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ পড়া হয় সেখান থেকে শায়তান পলায়ন করে। হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রহঃ) তাঁর ‘আল ইয়াওমু ওয়াল লাইলা’ নামক গ্রন্থে এবং ইমাম হাকিম স্বীয় গ্রন্থ ‘মুসতাদরাক’ এ বর্ণনা করেছেন।(হাদীসটি য‘ঈফ। সুনান আবূ দাউদ ৩/৩১২১, ইবনু মাজাহ১/১৪৪৮, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫৬৫, মুসনাদ আহমাদ ৫/২৬,২৭, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ৩/৩৮৩)
মুসনাদ দারিমীতে ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। যে ঘরে সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ পড়া হয় সেই ঘর থেকে শায়তান গুহ্যদ্বার দিয়ে বায়ু নিঃসরণ করতে করতে পলায়ন করে।
‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-এর উক্তি আছে যে, যে ব্যক্তি রাতে সূরাহ্ আল বাক্বারার দশটি আয়াত তিলাওয়াত করে, সে রাতে উক্ত ঘরে শায়তান প্রবেশ করেনা। আর সে আয়াতগুলো হলো উক্ত সূরার প্রথম চারটি আয়াত, আয়াতুল কুরসী, তার পরবর্তী দু’টি আয়াত এবং সবশেষের তিনটি আয়াত। অন্য বর্ণনায় আছে যে, শায়তান সে ঘরে ঐ রাতে যেতে পারে না এবং সেদিন ঐ বাড়ীর লোকদের শায়তান অথবা কোন খারাপ জিনিস কোন ক্ষতি করতে পারে না। এ আয়াতগুলো পাগলের ওপর পড়লে তার পাগলামীও দূর হয়ে যায়। (দারিমী ২/৩২২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ‘যেমন প্রত্যেক জিনিসের উচ্চতা থাকে তেমনই কুর’আনের উচ্চতা হচ্ছে সূরাহ্ বাকারাহ। যে ব্যক্তি রাত্রিকালে নীরবে নিজের নিভৃত কক্ষে তা পাঠ করে তিন রাত্রি পর্যন্ত শায়তান সেই ঘরে যেতে পারে না। আর দিনের বেলায় যদি পড়ে তাহলে তিন দিন পর্যন্ত সেই ঘরে শায়তান পা দিতে পারে না। (হাদীসটি য‘ঈফ। সিলসিলাতুয য‘ঈফা, ১৩৪৯, শু‘আবুল ঈমান লিল বায়হাকী ২/৪৮৮। তাবারানী ৬/১৬৩, ইবনু হিব্বান ২/৭৮)
জামি‘ তিরমিযী, সুনান নাসাঈ এবং সুনান ইবনু মাজায় রয়েছে যে, একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেনাবাহিনীর একটি ছোট্ট কাফিলাকে এক জায়গায় পাঠালেন এবং তিনি তার নেতৃত্বভার এমন ব্যক্তির ওপর অর্পণ করলেন যিনি বলেছিলেনঃ ‘আমার সূরাহ্ বাকারাহ মুখস্থ আছে।’ সে সময় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বললেনঃ ‘আমিও তা মুখস্ত করতাম। কিন্তু পরে আমি এই ভয় করেছিলাম যে, না জানি আমি তার ওপর ‘আমল করতে পারবো কি-না।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
‘কুর’আন শিক্ষা করো, কুর’আন পাঠ করো। যে ব্যক্তি তা শিখে ও পাঠ করে, অতঃপর তার ওপর ‘আমলও করে, তার উপমা এ রকম যেমন মিশ্ক পরিপূর্ণ পাত্র, যার সুগন্ধি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আর যে ব্যক্তি তার শিক্ষা করলো, অতঃপর ঘুমিয়ে পড়লো তার দৃষ্টান্ত সেই পাত্রের মতো যার মধ্যে মিশ্ক তো ভরা রয়েছে, কিন্তু ওপর হতে মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’ ইমাম তিরমিযী (রহঃ) একে হাসান বলেছেন এবং মুরসাল বর্ণনাও রয়েছে। মহান আল্লাহই এ সম্পর্কে ভালো জানে। (হাদীসটি সহীহ। সুনান নাসাঈ ৫/২২৭, জামি‘ তিরমিযী ৫/২৮৭৬, সুনান ইবনু মাজাহ, ১/২১৭,)
সহীহুল বুখারীতে রয়েছে, ‘উসাইদ ইবনু হুজাইর (রাঃ) একবার রাতে সূরাহ্ বাকারাহ পাঠ করেন। তাঁর ঘোড়াটি, যা তাঁর পার্শ্বেই বাঁধা ছিলো, হঠাৎ করে লাফাতে শুরু করে। তিনি পাঠ বন্ধ করলে ঘোড়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আবার তিনি পড়তে আরম্ভ করলে ঘোড়াও লাফাতে শুরু করে। তিনি পুনরায় পড়া বন্ধ করেন এবং ঘোড়াটিও স্তব্ধ হয়ে থেমে যায়। তৃতীয় বারও এরূপই ঘটে। তাঁর শিশু পুত্র ইয়াহ্ইয়া ঘোড়ার পাশেই শুইয়ে ছিলো। কাজেই তিনি ভয় করলেন যে, না জানি ছেলের আঘাত লেগে যায়। সুতরাং তিনি পড়া বন্ধ করে ছেলেকে উঠিয়ে নেন। তারপর তিনি আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করেন যে, ঘোড়ার চমকে উঠার কারণ কি? সকালে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে হাযির হয়ে ঘটনাটি বর্ণনা করেন। তিনি শুনতে থাকেন ও বলতে থাকেনঃ ‘উসাইদ! তুমি পড়েই যেতে! ‘উসাইদ (রাঃ) বলেনঃ ‘হে মহান আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তৃতীয় বারের পরে প্রিয় পুত্র ইয়াহ্ইয়ার কারণে আমি পড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অতঃপর আমি মাথা আকাশের দিকে উঠালে ছায়ার ন্যায় একটি জ্যোতির্ময় জিনিস দেখতে পাই এবং দেখতে দেখতেই তা ওপরের দিকে উত্থিত হয়ে শুন্যে মিলে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
وتدري ما ذاك؟ " . قال: لا. قال: " تلك الملائكة دنت لصوتك ولو قرأت لأصبحت (১১) ينظر الناس إليها لا تتوارى منهم.
‘তুমি কি জানো সেটা কি ছিলো? তাঁরা ছিলেন গগণ বিহারী অগণিত জ্যোতির্ময় ফিরিশতা। তোমার পড়ার শব্দ শুনে তাঁরা ত্রস্তপদে নিকটে এসেছিলেন। যদি তুমি পাঠ বন্ধ না করতে তাঁরা সকাল পর্যন্ত এরকমই থাকতেন এবং মাদীনার সকল লোক তা দেখে চক্ষু জুড়াতো। একটি ফিরিশতাও তাদের দৃষ্টির অন্তরাল হতেন না।’ (হাদীস সহীহ। সহীহুল বুখারী ৮/৫০১৮, সহীহ মুসলিম ১/২২৪/৫৪৮, মুসনাদ আহমাদ ৩/৮১। ফাতহুল বারী ৮/৬৮০) এ হাদীসটি ইমাম কাসিম ইবনু সালাম স্বীয় কিতাব ‘কিতাবু ফাযাইলিল কুর’আন’ এ রিওয়ায়াত করেছেন।
সূরাহ্ বাকারাহ ও সূরাহ্ আলি ‘ইমরানের বৈশিষ্ট্য
ইমাম আহমাদ (রহঃ) আবূ না‘ঈম থেকে বর্ণনা করেন, নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
" تعلموا سورة البقرة، فإن أخذها بركة، وتركها حسرة، ولا تستطيعها البطلة " . قال: ثم سكت ساعة، ثم قال: " تعلموا سورة البقرة، وآل عمران، فإنهما الزهراوان، يُظلان صاحبهما يوم القيامة، كأنهما غمامتان أو غيايتان، أو فرْقان من طير صَوافّ، وإن القرآن يلقى صاحبه يوم القيامة حين ينشق عنه قبره كالرجل الشاحب، فيقول له: هل تعرفني؟ فيقول: ما أعرفك. فيقول: أنا صاحبك القرآن الذي أظمأتك في الهواجر، وأسهرت ليلك، وإن كل تاجر من وراء تجارته، وإنك اليوم من وراء كل تجارة. فيعطى الملك بيمينه والخلد بشماله، ويوضع على رأسه تاج الوقار، ويكسى والداه حلتين، لا يقوم لهما (৮) أهل الدنيا، فيقولان: بم كسينا هذا؟ فيقال: بأخذ ولدكما القرآن، ثم يقال: اقرأ واصعد في دَرَج الجنة وغرفها، فهو في صعود ما دام يقرأ هَذًّا كان أو ترتيلا ".
‘তোমরা অভিনিবেশ সহকারে সূরাহ্ বাকারাহ শিক্ষা করো। কারণ এর শিক্ষা অতি কল্যাণকর এবং এ শিক্ষার বর্জন অতি বেদনাদায়ক। আর বাতিলপন্থীরা এর ক্ষমতা রাখে না।’ অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেনঃ ‘সূরাহ্ বাকারাহ ও সূরাহ্ আলি ‘ইমরান শিক্ষা করো। এ দু’টি হচ্ছে জ্যোতির্ময় নূর বিশিষ্ট সূরাহ্। কিয়ামতের দিন এরা এদের পাঠকের ওপর সামিয়ানা, মেঘমালা অথবা পাখির ঝাঁকের ন্যায় ছায়া বিস্তার করবে। কুর’আনের পাঠক কবর থেকে উঠে দেখতে পাবে যে, এক জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল বিশিষ্ট সুন্দর যুবক তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছেঃ ‘তুমি আমাকে চিনো কি?’ এ বলবে না।’ সে বলবেঃ ‘আমি সেই কুর’আন যে তোমাকে দিনে ক্ষুধার্থ ও পিপাসার্ত রেখেছিলো এবং রাতে বিছানা থেকে দূরে সরিয়ে সদা জাগ্রত রেখেছিলো। প্রত্যেক ব্যবসায়ী তার ব্যবসার পিছনে রয়েছে; কিন্তু আজ সমুদয় ব্যবসা তোমার পিছনে আছে।’ আজ তার ডান হাতে রাজ্য এবং অনন্তকালের জন্য বাম হাতে চির অবস্থান দেয়া হবে। তার বাপ-মাকে এমন দু’টি সুন্দর মূল্যবান পরিধেয় বস্তু পরানো হবে যার মূল্যের সামনে সারা দুনিয়াও অতি নগণ্য মনে হবে। তারা বিচলিত হয়ে বলবেঃ ‘এ দয়া ও অনুগ্রহ, এ পুরষ্কার ও অবদানের কারণ কি?’ তখন তাদেরকে বলা হবেঃ ‘তোমাদের ছেলেদের কুর’আন পাঠের কারণে তোমাদেরকে এ পুরষ্কার দেয়া হয়েছে।’ তারপর তাদেরকে বলা হবেঃ ‘পড়ে যাও এবং ধীরে ধীরে জান্নাতের সোপানে আরোহণ করো।’ সুতরাং তারা পড়তে থাকবে ও উচ্চ হতে উচ্চতর সোপানে আরোহণ করবে। সে ধীরে ধীরে পাঠ করুক বা তাড়াতাড়ি পাঠ করুক।’ (হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আহমাদ ৫/৩৪৮, ৩৬১, দারিমী ২/৩৩৯১, মুসতাদরাক হাকিম ১/৫৬০, সুনান ইবনু মাজাহ ২/৩৭৮১) সুনান ইবনু মাজায় বাশীর ইবনু মুহাজির থেকে এ হাদীসটি আংশিকভাবে বর্ণিত আছে। (হাদীস সহীহ। সুনান ইবনু মাজাহ, হাদীস নং ২/১২৪২) ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী এর সনদ হাসান। এর বর্ণনাকারী ইবনু মুহাজির হতে ইমাম মুসলিম (রহঃ)-ও বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম ইবনু মু‘ঈন তাকে নির্ভরযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। ইমাম নাসাঈর (রহঃ)-এর মতে এতে কোন দোষ নেই। তবে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ) তাকে মুনকারুল হাদীস বলেছেন এবং এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, আমি তার হাদীসগুলো অনুসন্ধান করে দেখতে পেলাম যে, তা বিস্বয়কর বা অদ্ভুত হাদীস। ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন যে, তার কিছু হাদীসের বিরোধিতা করা হয়েছে। আবূ হাতিম আর রাযী (রহঃ) বলেন যে, তার হাদীস লেখা যাবে তবে তা দ্বারা হুজ্জাত প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ইবনু ‘আদী (রহঃ) বলেন যে, তিনি এমন কিছু বর্ণনা করেছেন যেগুলো অনুসরণ যোগ্য নয়। আর ইমাম দারাকুতনী বলেন যে, তিনি শক্তিশালী নন। আমি বলবো যে, অন্য সনদে তার এই বর্ণনার কিছু কিছু শাহিদ বিদ্যমান আছে।
মুসনাদ আহমাদে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ شَافِعٌ لِأَصْحَابِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ اقْرَءُوا الزَّهْرَاوَيْنِ الْبَقَرَةَ وَآلَ عِمْرَانَ فَإِنَّهُمَا يَأْتِيَانِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا غَيَايَتَانِ أَوْ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ يُحَاجَّانِ عَنْ أَهْلِهِمَا ثُمَّ قَالَ اقْرَءُوا الْبَقَرَةَ فَإِنَّ أَخْذَهَا بَرَكَةٌ وَتَرْكَهَا حَسْرَةٌ وَلَا تَسْتَطِيعُهَا الْبَطَلَةُ.
‘কুর’আন পাঠ করতে থাকো, কারণ তা তার পাঠকের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে।’ দু’টি জ্যোতির্ময় সূরাহ্, সূরাহ্ বাকারাহ ও সূরাহ্ আলি ‘ইমরান পড়তে থাকো। এ দু’টি সূরাহ্ কিয়ামতের দিন এমনভাবে আসবে যেন তা দু’টি সামিয়ানা, দু’টি মেঘ খণ্ড অথবা পাখির দু’টি বিরাট ঝাঁক। তাছাড়া সে তার পাঠকদের পক্ষ হতে মহান আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবে।’ পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, ‘সূরাহ্ বাকারাহ পাঠ করতে থাকো; কেননা এর পাঠে বরকত আছে এবং তা বর্জন বা পরিত্যাগ করায় খুবই আফসোস রয়েছে। কারণ বাতিলপন্থীরা তার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবে না।’ ইমাম মুসলিম (রহঃ)ও সালাত পর্বে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেছেন।(হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আহমাদ ৫/২৪৯, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৩) اَلزَّهْرَاوَيْنِ হলো আলোকবর্তিকা, الغيابة হলো ওপর থেকে ছায়া দেয় এমন বস্তু, যেমন সামিয়ানা। الفرق বস্তুর টুকরা বিশেষ। الصواف বিরাট ঝাক। البطلة দ্বারা উদ্দেশ্য যাদুকর। لَا تَسْتَطِيعُهَا এর অর্থ তাদের মুখস্ত করা বা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়।
মুসনাদ আহমাদের আরেকটি হাদীস আছেঃ
يُؤْتَى بِالْقُرْآنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَهْلِهِ الَّذِينَ كَانُوا يَعْمَلُونَ بِهِ تَقَدَّمُهُمْ سُورَةُ الْبَقَرَةِ وَآلِ عِمْرَانَ وَضَرَبَ لَهُمَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثَلَاثَةَ أَمْثَالٍ مَا نَسِيتُهُنَّ بَعْدُ قَالَ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ ظُلَّتَانِ أَوْ سَوْدَاوَانِ بَيْنَهُمَا شَرْقٌ كَأَنَّهُمَا فِرْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ يُحَاجَّانِ عَنْ صَاحِبِهِمَا.
‘কিয়ামতের দিন কুর’আন ও কুর’আন পাঠকদের আহ্বান করা হবে। সূরাহ্ বাকারাহ ও আলি ‘ইমরান আগে আগে চলবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিনটি উপমা দিলেন যা আমি ভুলিনি। মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন উক্ত সূরাহ দু’টি যেন দু’টি মেঘমালা অথবা দু’টি কালো সামিয়ানা, যার মাঝে সূর্য বিদ্যমান। অথবা পাখির দু’টি বিরাট ঝাঁক যা উক্ত সূরাহদ্বয় পাঠকারীর পক্ষে বিশ্ব প্রভুর নিকট সুপারিশ করবে। (হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আহমাদ ৪/১৮৩, সহীহ মুসলিম ১/২৫৩, ৫৫৪, জামি‘ তিরমিযী ৫/২৮৮৩) সহীহ মুসলিম ও জামি‘ তিরমিযীতেও এ হাদীসটি রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) একে হাসান গারীব বলেছেন।
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) একটি সূত্র উল্লেখ করে বলেন, জনৈক ব্যক্তি সালাতে সূরাহ আল বাকারাহ্ ও সূরাহ্ আলি ‘ইমরান পাঠ করলেন, অতঃপর তার সালাত শেষ হলে কা‘ব (রাঃ) তাকে বললেন, তুমি কি সূরাহ আল বাকারাহ ও সূরাহ আলি ‘ইমরান পাঠ করলে? লোকটি বললো, হ্যাঁ। কা‘ব (রাঃ) বললেন, ঐ সত্তার সপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, এ দু’টি সূরাহতে মহান আল্লাহর এমন একটি নাম আছে যার মাধ্যমে প্রার্থনা করা হলে তিনি সাড়া দেন। লোকটি বললো, তাহলে উক্ত নামটি আমাকে জানিয়ে দিন। কা‘ব (রাঃ) বললেন, না, আল্লাহর শপথ আমি তোমাকে বলবো না। কেননা আমার আশংকা হয় যে, আমি যদি তোমাকে বলি তাহলে তুমি হয়তো তাকে এমন বিষয়ে আহ্বান করবে যে, তাতে আমাকে ও তোমাকে ধ্বংস করা হবে। (হাদীসটি য‘ঈফ)
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) আবূ উমামা (রাঃ) বলেনঃ তোমাদের ভাইকে স্বপ্নে দেখানো হয়েছে যে, কিছু মানুষ উঁচু পাহাড়ের ওপর চড়ে রয়েছে। আর সেই পাহাড়ের চূড়ায় দু’টি সবুজ বৃক্ষ আছে। আর সেই বৃক্ষদ্বয়ের আওয়াজ দিচ্ছে যে, তোমাদের মাঝে সূরাহ বাকারার পাঠক আছে কি? তোমাদের মাঝে সূরাহ্ আলি ‘ইমরানের পাঠক আছে কি? তিনি বলেন, যখনই কোন ব্যক্তি বলে যে, হ্যাঁ আছে, তখনই বৃক্ষ দু’টি ফলসহ তার দিকে ঝুকে পড়ছে। আর লোকটি বৃক্ষ দু’টির সাথে লটকে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ বৃক্ষ দু’টি তাকে নিয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে।
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) উম্মু দারদা (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন, নিশ্চয় কুর’আন পাঠকারীদের মধ্য থেকে কোন ব্যক্তি তার প্রতিবেশির ওপর হঠাৎ আক্রমন করে যেন তাকে হত্যা করলো, আর হত্যার বিনিময়ে হত্যার আইনে তাকেও হত্যা করা হয়। ফলে কুর’আন এক একটি সূরাহ হিসেবে তার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। অবশেষে সপ্তাহ ব্যাপী সূরাহ আল বাক্বারার ও সূরাহ আলি ‘ইমরান অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু এক জুমু‘আহ্ তথা এক সপ্তাহ পর সূরাহ আলি ‘ইমরানও পৃথক হয়ে পড়ে। এককভাবে সূরাহ আল বাক্বারাহ্ এক সপ্তাহ যাবৎ অবশিষ্ট থাকার পর নৈস্বর্গিক ভাবে বলা হয় যেঃ
﴿مَا یُبَدَّلُ الْقَوْلُ لَدَیَّ وَ مَاۤ اَنَا بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِیْدِ﴾
‘আমার কথা কখনো পরিবর্তন হয় না। আর আমি আমার বান্দাদের প্রতি যুল্মকারীও নই।’ (৫০ নং সূরাহ ক্বাফ আয়াত নং ২৯) তিনি বলেন, ফলে সূরাহ্ আল বাক্বারাহও বড় একটি মেঘ খণ্ডের ন্যায় হয়ে পৃথক হয়ে যাবে। আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) বলেন, ভাবার্থ যেন এরূপ যে, এই সূরাহ দু’টি বিপদ ও শাস্তির প্রতিবন্ধকতা স্বরূপ কবরে তার সাথী হয়ে থাকে। অতঃপর কুর’আনের অন্যান্য সূরাহ সমূহের মধ্যে এ সূরাহ দু’টিই তার সর্বশেষ সাথী হিসেবে থাকে। কিন্তু তার পাপের আধিক্যের ফলে এদের সুপারিশও কাজে আসে না।
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) ইয়াযিদ ইবনু আসওয়াদ আল জুরাশীর সূত্রেও উল্লেখ করেছেন যে, যে ব্যক্তি দিনের বেলা সূরাহ আল বাক্বারাহ্ ও সূরাহ আলি ‘ইমরান পাঠ করবে, সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নিফাক তথা কপটতা থেকে মুক্ত থাকবে। আর যে ব্যক্তি রাতে তা পাঠ করবে সেও সকাল পর্যন্তনিফাক তথা কপটতা থেকে মুক্ত থাকবে। তিনি বলেন, স্বয়ং ইয়াযিদ ইবনু আসওয়াদ আল জুরাশী প্রতি রাত ও দিনে অন্যান্য পারার পাশাপাশি এ দু’টো সূরাহ পাঠ করতেন।
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি রাতের বেলা সূরাহ আল বাক্বারাহ্ ও সূরাহ্ আলি ‘ইমরান পাঠ করবে, তাকে অনুগত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তবে এতে সূত্রের বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। অবশ্য সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ সূরাহ্ দু’টি রাতের সালাতে এক রাক‘আতে পাঠ করতেন। (হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আহমাদ ৪/১৮৩, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৪, জামি‘ তিরমিযী ৮/১৯১)
সাতটি দীর্ঘ সূরার মর্যদা
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ) ওয়াসিলা ইবনু আসকা‘ (রাঃ)-এর সূত্র উল্লেখ করে বলেন যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
أُعْطِيْتُ السَّبْعَ الطُّوَالَ مَكَانَ التَّوْرَاةِ، وَأُعْطِيْتُ الْمِئِيْنَ مَكَانَ الْإِنْجِيْلِ وَأُعْطِيْتُ الْمَثَانِيْ مَكَانَ الزَّبُوْرِ، وَفُضِّلَتْ بِالْمُفَصَّلِ.
তাওরাতের স্থলে আমাকে দীর্ঘ সাতটি সূরাহ দেয়া হয়েছে, ইনজীলের স্থলে আমি দু’শ’ আয়াত বিশিষ্ট সূরাহসমূহ প্রাপ্ত হয়েছি। আর যাবূরের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আমাকে দু’শ’র কম বিশিষ্ট সূরাহগুলো দেয়া হয়েছে। আর মুফাস্সাল তথা সূরাহ ক্বাফ থেকে শেষ পর্যন্ত সূরাহ গুলোর মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। (হাদীসটি সহীহ। মুসনাদ আবূ দাউদ আত ত্বায়ালিসী ১৩৬ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ১০১২, শু‘আবুল ঈমান লিল বায়হাকী ২/৪৭৮, আল মাজমা‘উয যাওয়ায়িদ ৭/১৫৮, তাফসীরে ত্বাবারানী ১ম খণ্ড, ৮৪ পৃষ্ঠা, হাদীস ১২৬) এই হাদীসটি গারীব। এ হাদীসের বর্ণনাকারী সা‘ঈদ ইবনু বাশীর সম্পর্কে শিথীলতার অভিযোগ রয়েছে।
অবশ্য আবূ উবাইদ (রহঃ) অনুরূপ বর্ণনা সা‘ঈদ ইবনু আবূ হিলাল থেকেও করেছেন। অপর একটি বর্ণনায় ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
مَنْ أَخَذَ السَّبْعَ فَهُوَ حَبْرٌ
যে ব্যক্তি এই সাতটি সূরাহ মুখস্থ করবে, সে একজন বড় ‘আলিম। এ হাদীসও গারীব। অত্র হাদীসের বর্ণনাকারী হুবাইব ইবনু হিনদ ইবনু আসমা ইবনু হুনদুব ইবনু হারিসা আল আসলামী থেকে ‘আমর ইবনু আবূ আমর ও ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবূ বাকরা বর্ণনা করেছেন। আবূ হাতিম আর রাযী (রহঃ)-ও তার নাম উল্লেখ করেছেন এবং কোন ত্র“টি নেই বলে আখ্যায়িত করেছেন। সর্ববিষয়ে মহান আল্লাহই ভালো জানেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহঃ)-ও বিভিন্ন সূত্রে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) ও আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকেও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। যাতে রয়েছে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
مَنْ أَخَذَ السَّبْعَ الأُوَلَ مِنَ الْقُرْآنِ فَهُوَ حَبْرٌ.
যে ব্যক্তি এই কুর’আনুল কারীমের প্রথম সাতটি সূরাহ মুখস্থ করবে, সে একজন বড় ‘আলিম। (হাদীস হাসান। মুসনাদ আহমাদ ৬/৮২, ইবনু নাসর ফি কিয়ামুল লাইল, ৬৯ পৃষ্ঠা, মুসতাদরাক হাকিম ওয়াল খাতীব ১০/১০৮। ইমাম হাকিম সহীহ বলেছেন)
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার একটি সৈন্যদল পাঠালেন যারা সংখ্যায় অনেক ছিলো। এতদসত্বেও তিনি শুধু মাত্র সূরাহ আল বাকারাহ মুখস্থ থাকার কারণে অল্প বয়সি একজন লোককে আমীর নিযুক্ত করে বললেন তুমি যাও, তুমিই তাদের আমীর। (হাদীসটি য‘ঈফ। জামি‘ তিরমিযী-২৮৭৬)
আবূ ‘উবাইদ (রহঃ)-এরপর সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রাঃ) থেকে وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন, যাতে তিনি বলেছেন যে, তা হলো সাতটি লম্বা সূরাহ, যথা সূরাহ্ আল বাকারাহ, সূরাহ্ আলি ‘ইমরান, সূরাহ্ আন্ নিসা, সূরাহ্ আল মায়িদাহ, সূরাহ্ আল আন‘আম, সূরাহ্ আল আ‘রাফ ও সূরাহ্ ইউনুস। তিনি বলেন, মুজাহিদ (রহঃ)ও বলেন, তা হলো সাতটি লম্বা সূরাহ। আর মাকহুল (রহঃ), ‘আতিয়্যাহ ইবনু কায়িস, আবূ মুহাম্মাদ আল ফারিসি, ইয়াহ্ইয়া ইবনু হারিস জিমারী (রহঃ) হতেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে।
একক অক্ষরসমূহের বিশ্লেষণ
الٓمّٓ-এর মতো مُقَطَّعَة বা খণ্ডকৃত অক্ষরগুলো যা অনেক সূরার প্রথমে এসেছে, এগুলো তাফসীরের ব্যাপারে মুফাস্সিরদের মধ্যে বেশ মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ বলেন যে, এগুলোর মর্মাথ শুধুমাত্র মহান আল্লাহই অবহিত। অন্য কেউ এগুলোর অর্থ জানে না। এ জন্য তারা এ অক্ষরগুলোর কোন তাফসীর করেন না। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এ কথা আবূ বাকর (রাঃ), ‘উমার (রাঃ), ‘উসমান (রাঃ) এবং ইবনু মাস‘ঊদ (রহঃ) হতে নকল করেছেন। আর ‘আমির শা‘বী, সুফইয়ান সাওরী, রাবী‘ ইবনু খায়সাম এরূপ বলেছেন। ইবনু আবি হাতীম উক্ত মতকে সমর্থন করেছেন। আবার তাদের কেউ কেউ এ অক্ষরগুলোর তাফসীর করেছেন এবং সে গুলোর অর্থ নির্ণয়ে মতভেদ করেছেন। ‘আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসলাম বলেছেন ‘এ অক্ষরগুলো হলো কুর’আন মাজীদের সূরাহসমূহের নাম।’ ‘আল্লামাহ আবুল কাসিম মাহমূদ ইবনু ‘উমার যামাখশারী স্বীয় তাফসীর গ্রন্থ ‘কাশ্শাফ’ এর মধ্যে উল্লেখ করেছেন যে, অধিকাংশ লোক এ কথার ওপরই একমত। ব্যাকরণবিদ সিবওয়াইহও সমর্থন করেছেন। আর এ মতকে সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হাদীসটি শক্তিশালী করে, যা আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জুমু‘আর দিন ফজরের সালাতে الم السجدة ও هل أتى على الإنسان পাঠ করতেন।
সুফইয়ান সাওরী মুজাহিদ (রহঃ)-এর একটি সূত্রে বলেছেন, الم ,حم , المص ও ص এ গুলো সূরার প্রথম অংশ যা দ্বারা মহান আল্লাহ সূরাহসমূহ আরম্ভ করে থাকেন। অন্যান্যরাও মুজাহিদ থেকে অনুরূপ মত পোষণ করেছেন।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, الم হলো কুর’আনের নামসমূহের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র নাম। কাতাদাহ ও যায়দ ইবনু আসলাম (রহঃ)-এরও মত এরূপই। এ উক্তির অর্থ ও ভাবার্থ ‘আব্দুর রহমান ইবনু যায়দ ইবনু আসলামের উক্তির মতোই, কেননা তিনিও বলেছেন এগুলো সূরাহ সমূহেরই নাম, কুর’আনের নাম নয়। প্রতিটি সূরার ওপর কুর’আনের নাম প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু المص কুর’আনের পূর্ণ নাম হতে পারে না। কারণ যখন কোন লোক বলে, আমি المص পড়েছি, তখন বাহ্যিকভাবে এটাই বোঝা যাবে যে, সে সূরাহ আ‘রাফ পড়েছে। পূর্ণ কুর’আন পড়েনি। মহান আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞানী।
কেউ কেউ মনে করেন যে, এ গুলো মহান আল্লাহরই নাম। যেমন শা‘বী বলেন যে, সূরাহ প্রথম অংশগুলো মহান আল্লাহর নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত। সালিম ইবনু ‘আবদুল্লাহ ও ইসমা‘ঈল ইবনু ‘আব্দুর রহমান সুদ্দী কাবীরও অনুরূপ বলেছেন। শু‘বা (রহঃ) ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর একটি সূত্রে বলেন যে, الم মহান আল্লাহর নামসমূহের একটি নাম। অন্য বর্ণনায় আছে যে, حم, طس এবং الم এগুলো মহান আল্লাহর বিশেষ নাম। ‘আলী ইবনু আবূ তালিব থেকেও এরূপ বর্ণনা রয়েছে। একটি বর্ণনায় এটাও আছে যে, এগুলো মহান আল্লাহর কসম বা শপথ এবং তার নামও বটে। ইকরামাহ (রহঃ) বলেন এগুলো কসম।
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে এক বর্ণনায় এটাও আছে যে, এগুলোর অর্থ হলো أنا الله أعلم তথা আমিই আল্লাহ সবচেয়ে বেশি জান্তা। সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রহঃ)-এরূপ বলেছেন। সা‘ঈদ ইবনু যুবাইর (রাঃ) থেকেও এটা বর্ণিত আছে।
অপর একটি বর্ণনায় ইবনু ‘আব্বাস ও ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) এবং আরো কয়েকজন সাহাবী থেকে বর্ণিত আছে যে, এ গুলো হলো মহান আল্লাহর নামের পৃথক পৃথক অক্ষর।
আবুল ‘আলিয়া বলেন যে, الف , لام এবং ميم এই তিনটি অক্ষর ‘আরবী বর্ণমালার উনত্রিশটি অক্ষরসমূহের অন্তর্গত যা সমস্ত ভাষায় সমভাবে এসে থাকে। সে গুলোর প্রত্যেকটি অক্ষর মহান আল্লাহর এক একটি নামের আদ্যাক্ষর এবং তাঁর নি‘য়ামত ও বিপদ আপদের নাম। আর এর মধ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সময়কাল ও তাদের আয়ূও বর্ণনা সম্পর্কে ইঙ্গিত রয়েছে। ‘ঈসা ইবনু মারইয়াম (আঃ) বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, আমার বিস্ময় লাগে তাদের ব্যাপারে যারা মহান আল্লাহর নামে কথা বলে এবং তাঁর দেয়া রিযক খেয়ে জীবন ধারণ করা সত্তেও কিভাবে তারা তাঁর সাথে কুফরী করতে পারে। এখানে মহান প্রতিপাকের الله নামটি الف দ্বারা لطيف নামটি لام দ্বারা এবং مجيد নামটি ميم দ্বারা আরম্ভ হয়েছে। الف এর অর্থ ألاء তথা নি‘য়ামত, لام এর অর্থ মহান আল্লাহর لطف তথা তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও করুণা। আর ميم এর অর্থ মহান আল্লাহর مجد তথা তাঁর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। الف অর্থ এক বছর, لام অর্থ ত্রিশ বছর এবং ميم অর্থ চল্লিশ বছর। এ শব্দগুলো ইবনু আবী হাতিম (রহঃ)-এর। ইবনু জারীর (রহঃ)-ও অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি এসব মতের মাঝে সামঞ্জস্য দান করেছেন। অর্থাৎ তিনি সমাধান দিয়ে বলেন যে, এর মধ্যে এমন কোন মতবিরোধ নেই যা একে অপরের উল্টো। হতে পারে যে, এগুলো যেমন সূরাহসমূহের নাম তেমনি মহান আল্লাহর নাম অনুরূপভাবে সূরার আদ্য শব্দসমূহও বটে। এর এক একটি অক্ষর দ্বারা মহান আল্লাহর এক একটি নাম, এক একটি গুণ ও সময় প্রভৃতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এর এক একটি শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাবী‘ ইবনু আনাস এবং আবুল ‘আলিয়া প্রমূখ বলেন যে, এ গুলো দ্বারা মহান আল্লাহর নাম, তার গুণাবলী বা সময়কালও বোঝা যেতে পারে। যেমন أمة শব্দটি। এর একটি অর্থ হচ্ছে ‘দ্বীন’ বা ধর্ম। যেমন কুর’আনুল কারীমে রয়েছেঃ
﴿اِنَّا وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا عَلٰۤى اُمَّةٍ﴾
‘আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের এক ধর্মমত পালনরত পেয়েছি।’ (৪৩ নং সূরাহ আয যুখরুফ, আয়াত-২২)
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে বান্দা। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿ِ اِنَّ اِبْرٰهِیْمَ كَانَ اُمَّةً قَانِتًا لِّلّٰهِ﴾
‘নিশ্চয় ইব্রাহীম ছিলো মহান আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত একনিষ্ঠ এক বান্দা।’ (১৬ নং সূরাহ আন নাহল, আয়াত-১২০)
তৃতীয় অর্থ হচ্ছে দল। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَجَدَ عَلَیْهِ اُمَّةً مِّنَ النَّاسِ یَسْقُوْنَ﴾
‘সে একদল লোককে দেখলো তারা তাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাচ্ছে।’ (২৮ নং সূরাহ আল কাসাস, আয়াত ২৩) অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَ لَقَدْ بَعَثْنَا فِیْ كُلِّ اُمَّةٍ رَّسُوْلًا﴾
‘প্রত্যেক দল বা জাতির কাছে আমি রাসূল পাঠিয়েছি।’ (১৬ নং সূরাহ আন নাহল, আয়াত-৩৬)
চতুর্থ অর্থ হচ্ছে সময় বা কাল। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿وَقَالَ الَّذِیْ نَجَا مِنْهُمَا وَ ادَّكَرَ بَعْدَ اُمَّةٍ اَنَا اُنَبِّئُكُمْ بِتَاْوِیْلِه فَاَرْسِلُوْنِ﴾
দু’জনের মধ্যে যে জন জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলো আর দীর্ঘকাল পর যার স্মরণ হলো সে বললো, ‘আমি তোমাদের তার ব্যাখ্যা বলে দিবো, তবে তোমরা আমাকে জেলখানায় ইউসুফের কাছে পাঠাও।’ (১২ নং সূরাহ ইউসুফ, আয়াত ৪৫)
সুতরাং এখানে أمة শব্দের যেমন কয়েকটি অর্থ হলো, অনুরূপভাবে এটাও সম্ভব যে, এই حروف مقطعة এরও কয়েকটি অর্থ হবে।
ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ)-এর এই বিশ্লেষণের বিপক্ষে আমরা বলতে পারি যে, আবুল ‘আলিয়া যে তাফসীর করেছেন তার ভাবার্থ হচ্ছে, একটি শব্দ এক সাথে একই স্থানে এসব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর أمة ইত্যাদি শব্দগুলো কয়েকটি অর্থে আসে যাকে ‘আরবী পরিভাষায় ألفاظ مشتركة বলা হয়। এগুলোর অর্থ তো অবশ্যই প্রত্যেক স্থলে পৃথক পৃথক হয়। কিন্তু প্রত্যেক স্থলে একটি অর্থ হয়ে থাকে যা রচনা পদ্ধতির ইঙ্গিত দ্বার বুঝা যায়। একই স্থানে সমস্ত অর্থ হতে পারে না এবং একই স্থানে সমস্ত অর্থ গ্রহণ করার ব্যাপারে উসূল শাস্ত্রবিদগণের মাঝে ব্যাপক মতবিরোধ রয়েছে। যা আমাদের তাফসীরের বিষয়বস্তু নয়। মহান আল্লাহই এসম্পর্কে ভলো জানেন।
দ্বিতীয়তঃ أمة প্রভৃতি শব্দগুলোর অর্থ অনেক এবং এ গুলো এ জন্যই গঠন করা হয়েছে, আর তা পূর্বেও বাক্য ও শব্দের ওপর ঠিকভাবে বসে যাচ্ছে। কিন্তু একটি অক্ষরকে এমন একটি নামের সাথে চিহ্নিত হতে পারে এবং একে অপরের ওপর কোন দিক দিয়েই কোন মর্যাদাও নেই, তাহলে এরূপ কথা জ্ঞান ও বিবেক দ্বারা অনুধাবন করা যায় না। তবে যদি নকল করা হয়ে থাকে সেটা অন্য কথা। কিন্তু এখানে মতৈক্য না থেকে ররং মতানৈক্য রয়ে গেছে। কাজেই এ ফায়সালা বেশ চিন্তা সাপেক্ষ।
এখন কতকগুলো ‘আরবী কবিতা যা একথার দালীলরূপে পেশ করা হয় যে, শব্দের বর্ণনার জন্যে শুধুমাত্র প্রথম অক্ষরটি বলা হয়ে থাকে, যেমন কবির উক্তিঃ
قُلْنَا قَفِيْ لَنَا فَقَالَتْ قَافْ ... لَا تَحْسَبِِي أَنَّا نَسِيْنَا الْإِيْجَافَ
‘আমরা বললাম, তুমি আমাদের জন্য দাঁড়াও, সে বললো আমি দাঁড়িয়েছি। তুমি মনে করো না যে, আমরা ঘোড়া চালানো ভুলে গিয়েছি।’ এখানে قاف বলে وقفتُ তথা আমি দাঁড়িয়েছি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অন্য এক কবি বলেনঃ
مَا لِلظَّلِيْمِ عَالَ كَيْفَ لَا يَا ... يَنْقَدُّ عَنْهُ جِلْدُهُ إِذَا يَا
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন, কবি যেন এখানে একথা বলতে চেয়েছেন যে, إِذَا يَفْعَلْ كَذَا وكَذَا অতঃপর তিনি পূর্ণ বাক্য না বলে শুধু يَفْعَلْ এর يا এর ওপর ক্ষ্যান্ত করেছেন।
অন্য এক কবি বলেনঃ
بالخير خيرات وإن شرًا فا ... ولا أريد الشر إلا أن تا
পূর্ণরূপ ছিলো, وَإِنَّ شَرًا فَشَرٌّ، وَلَا أُرِيْدُ الشَّرَّ إِلَّا أَنْ تَشَاءُ অতঃপর فشر না বলে শুধু فا এর ওপর এবং تَشَاءُ না বলে تا এর ওপর ক্ষ্যান্ত করা হয়েছে।
কিন্তু এটা বাক্যরীতির বাহ্যিক দিক, একটা অক্ষর বলা মাত্রই পুরো কথাটি বোধগম্য হয়ে যায়। মহান আল্লাহই এসম্পর্কে ভলো জানেন। কুরতুবী (রহঃ) বলেন, একটি হাদীসে আছেঃ
مَنْ أَعَانَ عَلَى قَتْلِ مُسْلِمٍ بِشَطْرِ كَلِمَةٍ.
অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি মুসলমানকে হত্যা করার কাজে অর্ধেক কথা দিয়েও সাহায্য করে’, এর ভাবার্থ এই যে, اُقْتُلْ এর স্থলে اُقْ বলা। (হাদীসটি য‘ঈফ। ইবনু মাজাহ ২/২৬২০)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে, সূরাহ্সমূহের প্রথমে যে অক্ষরগুলো আছে যেমন الر طسم، حم، ص، ق ইত্যাদি এ সবগুলোই حُرُوْف هِجَا কোন কোন ‘আরবী ভাষাবিদ বলেন যে, এই অক্ষরগুলো যা পৃথক পৃথকভাবে ২৮টি আছে, তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করে বাকীগুলোকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেমন কেউ বলে থাকেঃ ‘আমার পুত্র ا، ب، ت، ث লিখে, তখন ভাবার্থ এই দাঁড়ায় যে, তার পুত্র এ ধরনের ২৮টি অক্ষর লিখে। কিন্তু প্রথম কয়েকটির নাম উল্লেখ করে বাকীগুলো ছেড়ে দেয়া হয়েছে। (তাফসীর তাবারী ১/২০৮)
একক অক্ষর দিয়ে বিভিন্ন সূরার শুরু
পুনরুক্ত অক্ষরগুলো বাদ দিয়ে সূরাসমূহের প্রথমে এ প্রকারের চৌদ্দটি অক্ষর আছে। অক্ষরগুলো হচ্ছেঃ
ا، ل، م، ص، ر، ك، ه، ى، ع، ط، س، ح، ق، ن
এসব একত্রিত করলে نَصَّ حَكِيْمٌ فَاطِعٌ لَهُ سَرٌّ গঠিত হয়। সংখ্যা হিসাবে এ অক্ষরগুলো হয় চৌদ্দটি এবং মোট অক্ষর হলো আটাশটি। সুতরাং এগুলো পুরা অর্ধেক হচ্ছে এবং এগুলো পরিত্যক্ত অক্ষরগুলো থেকে বেশি মর্যাদাপূর্ণ। এটাও পরিলক্ষিত হয় যে, যতো প্রকারের অক্ষর রয়েছে ততো প্রকারেরই অধিক সংখ্যক এর মধ্যে এসে গেছে।
অর্থাৎ رِخْوَةٌ، شَدِيْدَةٌ، مُطْبِقَةٌ، مَفْتوحة، مستعلية، منخفضة، وحروف قلقلة، مجهورة، مهموسة. ইত্যাদি। সুবহানাল্লাহ! প্রত্যেক জিনিসের মধ্যেই বিশ্বপ্রভুর মাহাত্ম্য প্রকাশ পাচ্ছে।
এটা সুনিশ্চিত কথা যে, মহান আল্লাহর কথা কখনো বাজে ও অর্থহীন হতে পারে না। তাঁর কথা এ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। কিন্তু কতকগুলো নির্বোধ বলে থাকে যে, এসব অক্ষরের কোন তাৎপর্য নেই। তারা সম্পূর্ণ ভুলের ওপর রয়েছে। এ গুলোর কোন না কোন অর্থ অবশ্যই আছে। যদি নিষ্পাপ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে তার অর্থ সাব্যস্ত হয় তাহলে আমরা সেই অর্থ করবো ও বুঝবো। আর যদি মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কোন অর্থ না করে থাকেন তাহলে আমরাও কোন অর্থ করবো না, বরং বিশ্বাস স্থাপন করবো যে, তা মহান আল্লাহর নিকট থেকে এসেছে।
﴿ اٰمَنَّا بِهۙ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ رَبِّنَا﴾
আমরা এতে বিশ্বাস করি, সবই আমাদের রবের নিকট হতে এসেছে। (৩ নং সূরাহ্ আলি ‘ইমরান, আয়াত নং ৭)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা দান করেননি এবং ‘আলিমগণের মধ্যে এ ব্যাপারে অত্যধিক মতভেদ রয়েছে। যদি কারো কোন কথার দালীল জানা থাকে তাহলে ভালো কথা, সে তা মেনে নিবে। নতুবা মঙ্গল এই যে, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার কথা তা বিশ্বাস করবে এবং এও বিশ্বাস করবে যে, এগুলোর অর্থ অবশ্যই আছে, যা একমাত্র মহান আল্লাহই ভালো জানেন, আমাদের নিকট তা প্রকাশ পায়নি।
এ অক্ষরগুলো আরেকটি অন্তর্নিহিত হিকমত ও কারণ এই যে, এ গুলো দ্বারা সূরাহসমূহের সূচনা জানা যায়। কিন্তু এ কারণটি দুর্বল। কেননা এছাড়াও অন্য জিনিস দ্বারা সূরাহগুলোর বিভিন্নতা জানা যায়। আর যে সূরাহগুলোর প্রথমে এ অক্ষরগুলো নেই সেগুলোর প্রথম ও শেষ কি জানা যায় না? আবার সূরাহগুলোর প্রথমে বিসমিল্লাহর লিখন ও পঠন কি ওগুলোকে অন্য সূরাহ থেকে পৃথক করে দেয় না? ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ)-এর একটি রহস্য এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, যেহেতু মুশরিকরা মহান আল্লাহর কিতাব শুনতোই না, কাজেই তাদেরকে জানাবার জন্য অক্ষরগুলো আনা হয়েছে যেন নিয়মিত পাঠ আরম্ভ দ্বারা তাদের মন কিছুটা আকর্ষণ করা যায়। কিন্তু এ কারণটি দুর্বল। কেননা যদি এরূপই হতো, তাহলে প্রত্যেক সূরাহ এই অক্ষরগুলো দ্বারা আরম্ভ করা হতো, অথচ তা করা হয়নি। বরং অধিকাংশ সূরাই তা থেকে মুক্ত রয়েছে। তাছাড়া উক্ত মতটি সঠিক হলে এটাও আবশ্যক হতো যে, যখনই মুশরিকদের সম্পর্কে কথা আসতো তখনই এ অক্ষরগুলো দ্বারা তা শুরু করা। এটাও চিন্তার বিষয় যে, এই সূরাহ তথা সূরাহ আল বাক্বারাহ ও সূরাহ আলি ‘ইমরান মাদীনাতে অবতীর্ণ হয়েছে, অথচ এ দু’টো সূরাহ অবতীর্ণ হওয়ার সময় মাক্কার মুশরিকরা তথাই ছিলোই না। তা হলে এ দু’টো সূরার পূর্বে অক্ষরগুলো আনা হলো কেন?
একক অক্ষরগুলো মু‘জিযাহ প্রকাশ করছে
আর উক্ত প্রশ্নের জবাবে বলা যায় যে, এখানে আরেকটি হিকমাত বর্ণনা করা হয়েছে। তা এই যে, এগুলো উল্লেখ করায় কুর’আন মাজীদের একটি মু‘জিযাহ বা আলৌকিকত্ব প্রকাশ পেয়েছে, যা আনয়ন করতে সমস্ত সৃষ্টজীব অপরাগ হয়েছে। অক্ষরগুলো দৈনন্দিন ব্যবহৃত অক্ষর দ্বারা বিন্যস্ত হলেও তা সৃষ্টজীবের কথা হতে সম্পূর্ণ পৃথক। মুবার্রার (রহঃ) এবং মুহাক্কিক ‘আলিমগণের একটি দল ফার্রা (রহঃ) ও কাতরাব (রহঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে।
‘আল্লামাহ যামাখ্শারী (রহঃ) তাফসীরে কাশ্শাফের মধ্যে এ কথার সমর্থনে অনেক কিছু বলেছেন। শায়খ ইমাম ‘আল্লামাহ্ আবুল ‘আব্বাস ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ) এবং হাফিয মুজতাহিদ আবুল হাজ্জাজ মিজ্জী (রহঃ)-ও ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহঃ)-এর সূত্রে হিকমাতটি বর্ণনা করেছেন। যামাখ্শারী (রহঃ) বলেন যে, সমস্ত অক্ষর একত্রিতভাবে না আসার এটাই কারণ। তবে হ্যাঁ, ঐ অক্ষরগুলোকে বার বার আনার কারণ হচ্ছে মুশরিকদের বার বার অপরাগ ও লা-জবাব করে দেয়া, তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করা। যেমনিভাবে কুর’আনুল কারীমের মধ্যে অধিকাংশ কাহিনী ও ঘটনা কয়েকবার বর্ণনা করা হয়েছে এবং বার বার স্পষ্ট ভাষায় আল কুর’আনের অনুরূপ কিতাব আনার ব্যাপারে তাদের অপারগতার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
কোন স্থানে শুধুমাত্র একটি অক্ষর এসেছে। যেমন ق، ن، ص, কোন কোন স্থানে এসেছে দু’টি অক্ষর, যেমন حم কোন জায়গায় তিনটি অক্ষর এসেছে, যেমন الم কোন কোন স্থানে চারটি অক্ষর এসেছে, যেমন الر ও المص এবং কোন কোন জায়গায় এসেছে পাঁচটি অক্ষর যেমন كهيعص এবং حم عسق কেননা ‘আরবদের শব্দগুলো সবই এরকমই এক অক্ষর বিশিষ্ট, দুই অক্ষর বিশিষ্ট, তিন অক্ষর বিশিষ্ট, চার অক্ষর বিশিষ্ট এবং পাঁচ অক্ষর বিশিষ্ট। তাদের পাঁচ অক্ষরের বেশি শব্দ নেই।
যখন এ কথাই সাব্যস্ত হলো যে, এ অক্ষরগুলো কুর’আন মাজীদের মধ্যে মু‘জিযাহ বা অলৌকিক স্বরূপ আনা হয়েছে, তখন যে সূরাহ্গুলোর প্রথমে এ অক্ষরগুলো এসেছে সেখানে কুর’আনেও আলোচনা হওয়া এবং এর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা হওয়া উচিত। হয়েছেও তাই। ঊনত্রিশটি সূরায় এগুলো এসেছে। যেমনঃ
الٓمّٓۚ ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ١ۛۖۚ فِیْهِ
আলিফ- লাম- মীম। এটা ঐ মহান কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। (২ নং সূরাহ্ আল বাকারা আয়াত-১)
এখানেও এ অক্ষরগুলোর পরে বর্ণনা আছে যে, এই কুর’আন মহান আল্লাহর কালাম হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অন্য স্থানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
﴿الٓمَّٓۙ۱ اللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ١ۙ الْحَیُّ الْقَیُّوْمُؕ۲ نَزَّلَ عَلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ﴾
আলিফ, লাম, মিম। মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনই ইলাহ বা উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও নিত্য বিরাজমান। তিনি সত্যসহ তোমার প্রতি গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছেন, যা পূর্ববর্তী বিষয়ের সত্যতা প্রতিপাদনকারী। (৩ নং সূরাহ্ আলি ‘ইমরান, ১-৩)
অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
﴿الٓمّٓصٓۚ۱ كِتٰبٌ اُنْزِلَ اِلَیْكَ فَلَا یَكُنْ فِیْ صَدْرِكَ حَرَجٌ﴾
আলিফ লাম-মিম-সাদ। ‘এ একটি কিতাব যা তোমার ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, সুতরাং তোমার অন্তরে যেন মোটেই সঙ্কীর্ণতা না আসে। (৭ নং সূরাহ্ আ‘রাফ, আয়াত নং ১-২) অন্যত্র আছেঃ
﴿الٓرٰ١۫ كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَى النُّوْرِ١ۙ۬ بِاِذْنِ رَبِّهِمْ﴾
আলিফ লাম রা। এই কিতাব, এটা আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানব জাতিকে তাদের প্রভুর নির্দেশক্রমে বের করে আনতে পারো অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। (১৪ নং সূরাহ্ ইবরাহীম, আয়াত নং ১) আবার ইরশাদ হচ্ছেঃ
﴿الٓمّٓۚ۱ تَنْزِیْلُ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ﴾
আলীফ-লাম-মীম। এই কিতাব জগতসমূহের প্রভুর নিকট থেকে অবতীর্ণ, এতে কোন সন্দেহ নেই। (৩২ নং সূরাহ্ সাজদাহ আয়াত নং ১-২) মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ
﴿حٰمٓۚ۱ تَنْزِیْلٌ مِّنَ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ﴾
হা-মীম। এটা দয়াময়, পরম দয়ালুর নিকট থেকে অবতীর্ণ। (৪১ নং সূরাহ্ হা-মীম সাজদাহ, আয়াত নং ১-২) অন্য এক জায়গায় তিনি ইরশাদ করেনঃ
﴿حٰمٓۚ۱ عٓسٓقٓ۲ كَذٰلِكَ یُوْحِیْۤ اِلَیْكَ وَ اِلَى الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكَ١ۙ اللّٰهُ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ﴾
হা, মীম। ‘আইন, সীন, কাফ। পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময় মহান আল্লাহ এভাবেই তোমার পূর্ববর্তীদের মতই তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেন। (৪২ নং সূরাহ্ শূরা, আয়াত নং ১-৩)
এরকমই অন্যান্য সূরার সূচনাংশের প্রতি চিন্তা করলে জানা যাবে যে, এসব অক্ষরের পরে পবিত্র কালামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহান মর্যাদার বর্ণনা রয়েছে, যা দ্বারা এ কথা ভালোভাবে জানা যায় যে, এ অক্ষরগুলো মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অপারগতা প্রমাণ করার জন্যই আনা হয়েছে। মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
কিন্তু যারা মনে করেন যে, এ অক্ষরগুলো দ্বারা সময়কাল জানানো হয়েছে এবং হাঙ্গামা, ফিতনা ও যুদ্ধ ইত্যাদির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাদের এ দাবীটি একটি ভীত্তিহীন দাবী, এর পক্ষে যে হাদীসটি দালীল হিসেবে পেশ করে তা খুবই দুর্বল বা য‘ঈফ। অন্যদিকে হাদীসটি তাদের দাবীর সত্যতার চেয়ে বাতিল হওয়ার প্রতিই বেশি প্রমাণ বহণ করে। আর উক্ত হাদীসটি মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক ইবনু ইয়াসার বর্ণনা করেছেন, যিনি একজন প্রসিদ্ধ যুদ্ধ বিগ্রহের ইতিহাস লেখক। যা তিনি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে যে, আবূ ইয়াসির ইবনু আখতাব নামের ইয়াহূদী তার কয়েকজন সাথীকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট দিয়ে অতিক্রম কালে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সূরাহ আল বাকারার প্রথম দিক থেকে الٓمّٓۚ ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ١ۛۖۚ فِیْهِ পাঠ করতে শোনে। অতঃপর সে ইয়াহূদীদের মাঝে অবস্থিত তার ভাই হুওয়াই ইবনু আখতাবের নিকট এসে বলে যে, আমি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সূরাহ আল বাকারার প্রথম দিক থেকে الٓمّٓۚ ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ١ۛۖۚ فِیْهِ পাঠ করতে শুনেছি। তার ভাই বললো তুমি নিজে শুনেছো? সে বললো হ্যাঁ, অতঃপর হুওয়াই ইবনু আখতাব তার ইয়াহূদী সাথীদেরকে নিয়ে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো যে, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি কি এ আয়াত পাঠ করেছিলেন? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তারা বললো, তোমার নিকট মহান আল্লাহর নিকট থেকে জিবরাঈল এসেছিলো? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। তারা বললো, তোমার পূর্বে আগত কোন নবীকেই তার রাজত্বকাল কতোদিন থাকবে এবং তার উম্মাতের আয়ূস্কাল কতোদিন হবে তা বলা হয়নি। যা তোমাকে বলা হয়েছে। অতঃপর হুওয়াই ইবনু আখতাব তার সাথীদের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে যে, الف দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এক, لام দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ত্রিশ, আর মীম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চল্লিশ। এই মোট একাত্তর বছর। অতএব তোমরা কি এমন নবীর ধর্মে প্রবেশ করবে, যার রাজত্বকাল এবং উম্মাতের আয়ূস্কাল মাত্র একাত্তর বছর? অতঃপর সে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর দিকে অগ্রসর হয়ে বললো, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! এর সাথে কি আরো কিছু আছে? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। সে বললো, তা কি? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, المص সে বললো, এটা খুব ভারী ও লম্বা। الف দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এক, لام দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ত্রিশ, আর মীম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চল্লিশ, ص দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সত্তর। এই মোট একশত একত্রিশ বছর। হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! এর সাথে কি আরো কিছু আছে? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। সে বললো, তা কি? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, الر সে বললো, এটা খুব ভারী ও লম্বা। الف দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এক, لام দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ত্রিশ, আর ر দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দুই শত। এই মোট দুই শত একত্রিশ বছর। হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! এর সাথে কি আরো কিছু আছে? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ। সে বললো, তা কি? মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, المر সে বললো, এটা খুব ভারী ও লম্বা। الف দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এক, لام দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ত্রিশ, মীম দ্বারা উদ্দেশ্য হলো চল্লিশ, আর ر দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দুই শত। এই মোট দুই শত একাত্তর বছর।
অতঃপর সে বললো, তোমার বিষয়টি আমাদেরকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে, হে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! ফলে আমরা নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছি না যে, তোমাকে অল্প বয়স দেয়া হয়েছে না কি বেশি বয়স দেয়া হয়েছে। অতঃপর তার অনুসারীদের বললো, তোমরা তার থেকে সরে দাঁড়াও। অতঃপর আবূ ইয়াসির তার ভাই হুওয়াই ইবনু আখতাবকে এবং তার সাথে আরো যারা পণ্ডিতবর্গ ছিলো তাদের উদ্দেশ্যে বললো, তোমাদের মতামত কি? হয়তো এ সবই মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য যোগ করে সাত শত চার বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। তারাও উত্তরে বললো বিষয়টি আমাদের কাছেও সংশয়ের সৃষ্টি করছে। অতএব তারা ভাবলো যে, এ আয়াতটি তাদের উদ্দেশ্যেই অবতীর্ণ হয়েছেঃ
﴿هُوَ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ عَلَیْكَ الْكِتٰبَ مِنْهُ اٰیٰتٌ مُّحْكَمٰتٌ هُنَّ اُمُّ الْكِتٰبِ وَ اُخَرُ مُتَشٰبِهٰتٌ﴾
‘তিনিই তোমার ওপর এমন কিতাব নাযিল করেছেন, যার কতিপয় আয়াত মৌলিক-সুস্পষ্ট অর্থবোধক, এগুলো হলো কিতাবের মূল। আর অন্যগুলো পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।’ (৩ নং সূরাহ্ আলি ‘ইমরান, ৭) এ হাদীসের কেন্দ্রবিন্দু মূলত মুহাম্মাদ ইবনু সাইব আল কালবী। আর সে একা একা কোন হাদীস বর্ণনা করলে তা দ্বারা হুজ্জাত প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাছাড়া এ হাদীস যদি সহীহ মেনেও নেয়া হয় বাস্তবতা তা প্রত্যখ্যান করবে। কেননা আমরা যে চৌদ্দটি উল্লেখ করেছি, সেগুলোর সংখ্যা অনেক হয়ে যাবে। আর যদি বার বার আগত অক্ষরগুলোও গণনা করি তাহলে তো গণনার সংখ্যা আরো দীর্ঘ, বড় ও লম্বা হয়ে যাবে। মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings