Surah At Tawbah Tafseer
Tafseer of At-Tawbah : 73
Saheeh International
O Prophet, fight against the disbelievers and the hypocrites and be harsh upon them. And their refuge is Hell, and wretched is the destination.
Ibn Kathir Full
Tafseer 'Ibn Kathir Full' (BN)
৭৩-৭৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার এবং তাদের প্রতি কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। আর তাঁর অনুসারী মুমিনদের সাথে নম্র ব্যবহার করার আদেশ করছেন। তিনি সংবাদ দিচ্ছেন যে, কাফিরদের মূল স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। ইতিপূর্বে আমীরুল মুমিনীন আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে চারটি তরবারীসহ প্রেরণ করা হয়েছে। একখানা মুশরিকদের (বিরুদ্ধে ব্যবহারের) জন্যে। আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো অতীত হয়ে যাবে তখন মুশরিকদেরকে যেখানে পাও বধ কর।” (৯:৫) দ্বিতীয় তরবারী আহলে কিতাবের কাফিরদের (বিরুদ্ধে চালনার) জন্যে। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেসব আহলে কিতাব আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে না এবং কিয়ামতের দিবসের প্রতিও না, আর ঐ বস্তুগুলোকে হারাম মনে করে না যেগুলোকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) হারাম বলেছেন, এবং সত্য ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকো, যে পর্যন্ত না তারা অধীনতা স্বীকার করে প্রজারূপে জিযিয়া দিতে স্বীকৃত হয়।” (৯:২৯) তৃতীয় তরবারী মুনাফিকদের (বিরুদ্ধে ব্যবহারের) জন্যে। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর।” আর চতুর্থ তরবারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধের জন্যে)। মহা পরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমরা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে।” (৯:৪৯) এর দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, মুনাফিকরা যখন তাদের নিফাক (কপটতা) প্রকাশ করতে শুরু করবে তখন তাদের বিরুদ্ধে তরবারী দ্বারা যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ)-এর পছন্দনীয় মতও এটাই। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, হাত দ্বারা না পারলে তাদেরকে তাদের মুখের উপর ধমক দিতে হবে। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা কাফিরদের বিরুদ্ধে তরবারী দ্বারা যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন, আর মুনাফিকদের সাথে মুখে জিহাদ করার হুকুম করেছেন এবং তাদের সাথে নম্র ব্যবহার করার কথা বলেছেন। মুজাহিদ (রঃ)-এরও উক্তি প্রায় এটাই। তাদের উপর শরঈ হদ জারী করাও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই বটে। ভাবার্থ এই যে, প্রয়োজন বোধে মাঝে মাঝে তাদের বিরুদ্ধে তরবারীও উঠাতে হবে। তবে কাজ চললে তাদেরকে মুখে বলাই যথেষ্ট। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হবে।
আল্লাহ তা'আলার উক্তিঃ “তারা শপথ করে করে বলে যে, তারা (অমুক কথা) বলেনি, অথচ নিশ্চয়ই তারা কুফরী কথা বলেছিল এবং নিজেদের (বাহ্যিক) ইসলাম গ্রহণের পর খোলাখুলিভাবে কুফরী করেছে।” কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়। ঘটনা এই যে, এক জুহনী ও এক আনসারীর মধ্যে লড়াই বেঁধে যায়। জুহনী আনসারীর উপর চেপে বসে (আনসারীকে কাবু করে ফেলে) তখন আব্দুল্লাহ (মুনাফিকদের নেতা) আনসারদেরকে বলে, তোমরা কি তোমাদের ভাই আনসারীকে সাহায্য করবে না? আল্লাহর শপথ! আমাদের দৃষ্টান্ত ও মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঠিক উক্তিকারীর নিম্নের উক্তির মতঃ “তোমার কুকুরটি মোটা তাজা হয়েছে (অর্থাৎ তুমি খাওয়ায়ে মোটা তাজা করেছে), ওটা কিন্তু তোমাকেই খাবে (কামড়াবে)।” আল্লাহর কসম! যদি আমরা এখন মদীনায় ফিরে যাই তবে সম্মানিতরা হীন লোকদেরকে তথা হতে বহিষ্কার করে দেবে। একজন মুসলিম রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে গিয়ে তার এ কথা বলে দেয়। তিনি তাকে ডেকে এটা জিজ্ঞেস করলে সে কসম করে তা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।
আনাস (রাঃ) বলেন, আমার কওমের যেসব লোক হুররার যুদ্ধে শহীদ হন। তাদের জন্যে আমি খুবই দুঃখ প্রকাশ করি। এ সংবাদ যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ)-এর কাছে পৌছলে তিনি আমার কাছে একখানা চিঠি পাঠান। তাতে তিনি লিখেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি আনসারদেরকে এবং তাদের সন্তানদেরকে ক্ষমা করে দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর এ দুআ’য় আনসারদের পৌত্রদের উল্লেখ করেছিলেন কি না এ ব্যাপারে বর্ণনাকারী ইবনুল ফযল (রঃ) সন্দেহ করেছেন । আনাস (রাঃ) তাঁর পাশের একটি লোককে যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন ঃ “তিনি হচ্ছেন সেই যায়েদ যার কানে শোনা কথার সত্যতার সাক্ষ্য স্বয়ং সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ তা'আলা দিয়েছেন।” ঘটনা এই যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় এক মুনাফিক বলে ওঠেঃ “যদি এ ব্যক্তি সত্যবাদী হন তবে আমরা গাধার চেয়েও বেশী নির্বোধ।” তখন যায়েদ (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর শপথ! নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (সঃ) সত্যবাদী এবং অবশ্যই তুমি গাধার চাইতেও নির্বোধ।” অতঃপর তিনি এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কানে পৌছিয়ে দেন। কিন্তু ঐ মুনাফিক ওটা অস্বীকার করে বসে এবং বলে যে, যায়েদ (রাঃ) মিথ্যা কথা বলেছেন। তার এ কথার প্রতিবাদে আল্লাহ তাআলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন এবং যায়েদ (রাঃ)-এর সত্যবাদিতা প্রকাশ করে দেন।
কিন্তু প্রসিদ্ধ উক্তি এই যে, এটা হচ্ছে বানী মুসতালিক যুদ্ধের ঘটনা। খুব সম্ভব এই আয়াতের উল্লেখের ব্যাপারে বর্ণনাকারীর সন্দেহ হয়েছে এবং অন্য আয়াতের পরিবর্তে এ আয়াতটিকে বর্ণনা করে দিয়েছেন। এই হাদীসই সহীহ বুখারীতেও রয়েছে। কিন্তু তাতে নিম্নের বাক্য পর্যন্ত রয়েছে- “যার কানে শোনা কথার সত্যতার সাক্ষ্য দিয়েছেন স্বয়ং সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ।” সম্ভবতঃ পরের অংশটুকু বর্ণনাকারী মূসা ইবনে উকবা (রঃ)-এর নিজের উক্তি। তারই একটি বর্ণনায় পরবর্তী এ অংশটুকু ইবনে শিহাব (রঃ)-এর উক্তিতে বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
উমুভী (রঃ) তাঁর ‘মাগাযী’ গ্রন্থে কা'ব ইবনে মালিক (রাঃ)-এর তাবুক সম্পর্কীয় ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে যে, কা’বকে তাঁর কওমের লোকেরা বলেঃ “আপনি তো একজন কবি মানুষ। আপনি ইচ্ছা করলে কোন কারণ দর্শিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে ওযর পেশ করতে পারেন। অতঃপর ঐ পাপের জন্যে আপনি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। এরপর বিশদভাবে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তাতে এ কথাও রয়েছে যে, যেসব মুনাফিক পিছনে রয়ে গিয়েছিল এবং যাদের ব্যাপারে কুরআন কারীমের আয়াত নাযিল হয়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাসুলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথেও ছিল। জাল্লাস ইবনে সাভীদ ইবনে সামিতও ছিল তাদের মধ্যে একজন। উমাইর ইবনে সাদ (রাঃ)-এর মাতা তার ঘরে (স্ত্রীরূপে) ছিলেন, যিনি সা’দকেও (রাঃ) সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। (উমাইর ইবনে সা'দ (রাঃ) তার মাতার অন্য স্বামীর ঔরসজাত পুত্র ছিলেন। উমাইর (রাঃ)-এর পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মাতার সাথে জাল্লাসের দ্বিতীয় বিয়ে হয় এবং বিয়ের পর তিনি তার পুত্র উমাইরকেও (রাঃ) সঙ্গে নিয়ে জাল্লাসের বাড়ীতে আসেন) যখন ঐ মুনাফিকদের ব্যাপারে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন জাল্লাস বলেঃ “আল্লাহর কসম! যদি এ ব্যক্তি (মুহাম্মাদ সঃ) তাঁর কথায় সত্যবাদী হন তবে তো আমরা এই গাধার চেয়েও নিকৃষ্ট!” এ কথা শুনে উমাইর ইবনে সা'দ (রাঃ) বলে উঠলেনঃ “আপনি তো আমার কাছে অত্যন্ত প্রিয় এবং আপনার কষ্ট আমার কষ্টের চাইতেও আমার কাছে বেশী পীড়াদায়ক। কিন্তু এখন আপনি আপনার মুখ থেকে এমন একটা কথা বের করলেন যে, যদি আমি তা পৌছিয়ে দেই তবে আমার জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনা, আর না পৌছালে রয়েছে ধ্বংস। তবে লাঞ্ছনা অবশ্যই ধ্বংস হতে হালকা।” একথা বলেই তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে ঐ কথা বলে দিলেন। জাল্লাস এ সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে শপথ করে বলেঃ “উমাইর ইবনে সা'দ (রাঃ) মিথ্যা কথা বলেছে। আমি কখনও এ কথা বলিনি।” তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। বর্ণিত আছে যে, এরপর জাল্লাস তাওবাহ করে নেয় এবং ঠিক হয়ে যায়। তবে সম্ভবতঃ তার তাওবাহ্ করার কথাটা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ)-এর নিজের উক্তি হবে, কা'ব (রাঃ)-এর উক্তি নয়। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
উরওয়া ইবনে যুবাইর (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি জাল্লাস ইবনে সাভীদ ইবনে সামিতের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। ঘটনা এই যে, সে এবং তার স্ত্রীর (পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত) পুত্র মুসআব (রাঃ) কুবা থেকে আসছিল। হঠাৎ করে জাল্লাস বলে ফেলেঃ “মুহাম্মাদ (সঃ) যা নিয়ে এসেছেন তা যদি সত্য হয় তবে তো। আমরা যে গাধার উপর সওয়ার হয়ে আছি এর থেকেও আমরা নির্বোধ!” তখন মুসআব (রাঃ) তাকে বলেনঃ “ওরে আল্লাহর শত্রু! আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে এ সংবাদ দিয়ে দেবো। আমি ভয় পাচ্ছি যে, না জানি আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত নাযিল হয়ে যায় বা আমার উপর আল্লাহর কোন শাস্তি এসে পড়ে, অথবা এই পাপে আমার বৈপিত্রের সাথে আমাকেও শরীক করে নেয়া হয়!” তাই আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে হাযির হয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি এবং জাল্লাস কুবা থেকে আসছিলাম। ঐ সময় সে এরূপ এরূপ বলেছে। আমি যদি এ ভয় না করতাম যে, এ অপরাধে আমার্কেও জড়িয়ে ফেলা হবে, তবে আমি আপনাকে এ খবর দিতাম না। বর্ণনাকারী বলেন যে, মুসআব (রাঃ)-এর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) জাল্লাসকে ডেকে পাঠান এবং তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “মুসআব (রাঃ) যে কথা বলেছে সে কথা কি তুমি (সত্যি) বলেছো?" তখন সে আল্লাহর কসম করে তা অস্বীকার করে বসে। তখন আল্লাহ তা'আলা (আরবী)-এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।
তাফসীরে ইবনে জারীরে ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি গাছের ছায়ায় বসেছিলেন। ঐ সময় তিনি (সাহাবীদেরকে) বলেনঃ “এখনই তোমাদের কাছে একটি লোক আসবে এবং সে তোমাদের দিকে শয়তানের দৃষ্টিতে তাকাবে। যখন সে আসবে তখন তোমরা তার সাথে কথা বলবে না।” তখনই কয়রা চক্ষু বিশিষ্ট একটি লোক এসে গেল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি ও তোমার সঙ্গীরা আমাকে গালি দাও কেন?” তৎক্ষণাৎ সে গিয়ে তার সঙ্গী সাথীদেরকে নিয়ে আসলো এবং সবাই আল্লাহর নামে শপথ করে বললো যে, তারা এসব কথা বলেনি। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। তখন মহা মহিমান্বিত আল্লাহ (আরবী)-এ আয়াত অবতীর্ণ করেন।
আল্লাহ পাকের (আরবী) (তারা এমন বিষয়ের সংকল্প করেছিল যা তারা কার্যকরী করতে পারেনি) এ উক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা জাল্লাসের সংকল্পকে বুঝানো হয়েছে। সে সংকল্প করেছিল যে, তার স্ত্রীর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত যে ছেলেটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তার কথা বলে দিয়েছিলেন তাকে সে হত্যা করবে। একটি উক্তি এই যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হত্যা করার সংকল্প করেছিল। একটি উক্তি এও আছে যে, কতকগুলো লোক ইচ্ছা করেছিল, মুহাম্মাদ (সঃ) সম্মত না হলেও তারা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে তাদের সরদার বানাবে। এটাও বর্ণিত আছে যে, দশজনের বেশী লোক তাবুকের যুদ্ধে গমনের সময় পথে প্রতারণা করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হত্যা করার সংকল্প করেছিল। হুযাইফা (রাঃ) বলেনঃ “আমি এবং আম্মার (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উষ্ট্রীর আগে ও পিছনে চলছিলাম। একজন পিছন থেকে হাঁকাচ্ছিলাম এবং অন্যজন আগে আগে লাগাম ধরে টানছিলাম। আমরা আকাবা নামক স্থানে ছিলাম। এমন সময় দেখি যে, বারোজন লোক মুখের উপর ঢাকনা দিয়ে আসলো এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উষ্ট্রীটিকে ঘিরে ধরলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করলেন। সুতরাং তারা পালিয়ে গেল। তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমরা তাদেরকে চিনতে পেরেছো কি?” আমরা উত্তর দিলামঃ না, তবে তাদের সওয়ারীগুলো আমাদের চোখের সামনে রয়েছে (অর্থাৎ তাদের সওয়ারীগুলো আমরা চিনতে পেরেছি)। তিনি বললেনঃ “এরা হচ্ছে মুনাফিক এবং কিয়ামত পর্যন্ত এদের অন্তরে নিফাক (কপটতা) থাকবে। এরা কোন্ উদ্দেশ্যে এসেছিল তা তোমরা জান কি?” আমরা উত্তরে বললামঃ না। তিনি বললেনঃ “এরা এসেছিল আকাবায় আল্লাহর রাসূল (সঃ)-কে পেরেশান করা ও কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি তাদের গোত্রগুলোর কাছে এ সংবাদ পাঠাবো না যে, প্রত্যেক কওম যেন তাদের এই প্রকারের লোকের (কর্তিত) মস্তক আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয় (অর্থাৎ তার গর্দান উড়িয়ে দেয়। তিনি উত্তরে বললেনঃ “না, (এটা করা যায় না) তাহলে লোকেরা সমালোচনা করবে যে, মুহাম্মাদ (সঃ) প্রথমে তো এই লোকদেরকে নিয়েই শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছেন, আবার নিজের সেই সঙ্গীদেরকে হত্যা করে দিলেন।” অতঃপর তিনি বদ্ দুআ করলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি এদের অন্তরে আগুনের ফোঁড়া সৃষ্টি করে দিন।”
মুসনাদে আহমাদে আবুত তুফাইল (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাবুকের যুদ্ধ হতে ফিরবার পথে ঘোষণা করে দেনঃ “আমি আকাবার পথে গমন করবো। কেউ যেন এই পথে না আসে।” হুযাইফা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সওয়ারীর লাগাম ধরেছিলেন এবং আম্মার (রাঃ) পিছন থেকে হাঁকিয়ে যাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় এক দল লোক তাদের উষ্ট্রীগুলোর উপর সওয়ার হয়ে উপস্থিত হয়। আম্মার (রাঃ) তাদের উষ্ট্রীগুলোকে মারতে শুরু করেন। আর হুযাইফা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশক্রমে তার সওয়ারীকে নীচের দিকে চালাতে শুরু করেন। যখন নীচের মাঠ এসে পড়ে তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সওয়ারী হতে নেমে পড়েন। ইতিমধ্যে আম্মারও (রাঃ) ফিরে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) আম্মার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ঐ লোকগুলোকে চিনতে পেরেছে। কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “তাদের মুখ তো ঢাকা ছিল, তবে তাদের সওয়ারীগুলো আমি চিনতে পেরেছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “তারা কি উদ্দেশ্যে এসেছিল তা জান কি?” তিনি জবাবে বললেনঃ “না।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তারা চেয়েছিল গোলমাল ও চীৎকার করে আমার উন্ত্রীকে উত্তেজিত করতে, যাতে আমি উন্ত্রী থেকে পড়ে যাই।” আম্মার (রাঃ) একজন লোককে জিজ্ঞেস করেনঃ “আমি তোমাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছিআকাবার ঐ লোকগুলো কতজন ছিল?" সে উত্তরে বলেঃ “চৌদ্দজন।" তখন আম্মার (রাঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি যদি তাদের অন্তর্ভুক্ত হও তবে পনেরো জন হবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের মধ্যে তিনজনের নাম গণনা করেন। তারা বলেঃ “আল্লাহর শপথ! না আমরা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর আহ্বানকারীর আহ্বান শুনেছি, না আমরা আমাদের সঙ্গীদের কুমতলব অবগত ছিলাম। আম্মার (রাঃ) বলেনঃ “অবশিষ্ট বারোজন লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে জিহাদকারী, দুনিয়াতেও এবং আখিরাতেও। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) অনেক লোকের নামও বলেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, আহলে আকাবার মধ্যকার একটি লোকের সাথে আম্মার (রাঃ)-এর কিছুটা সম্পর্ক ছিল। তাই তিনি লোকটিকে আল্লাহর কসম দিয়ে আহলে আকাবার সংখ্যা জিজ্ঞেস করেন। তখন লোকেরাও তাকে তাদের সংখ্যা বলতে বলে। সে বলেঃ “আমি জানতে পেরেছি যে, তারা ছিল চৌদ্দজন। আর আমাকেও যদি তাদের অন্তর্ভুক্ত ধরা যায় তবে সংখ্যা দাঁড়াবে পনেরো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের তিনজনের নাম বলে দিলে তারা বলেঃ “আল্লাহর শপথ! আমরা আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর আহ্বানকারীর আহ্বানও শুনিনি এবং ঐ কওমের কি উদ্দেশ্য ছিল সেটাও আমরা জানতাম না।” অবশিষ্ট বারোজন দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী। গরমের মৌসুম ছিল। পানি ছিল খুবই কম। তাই তিনি বলেছিলেনঃ “আমার পূর্বে কেউ যেন সেখানে না পৌছে।” কিন্তু তবুও কিছু লোক সেখানে পৌছে গিয়েছিল। তিনি তাদের উপর অভিশাপ দেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার সহচরদের মধ্যে বারোজন মুনাফিক রয়েছে। তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং ওর সুগন্ধও পাবে না। আটজনের কাঁধে আগুনের ফোড়া হবে যা বক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। তা তাদেরকে ধ্বংস করে দিবে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) একমাত্র হুযায়ফা (রাঃ)-কে ঐ মুনাফিকদের নাম বলেছিলেন বলেই তাকে তার রাযদার (যিনি গোপন কথা জানেন) বলা হতো। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
ইমাম তিবরানী (রঃ) তাঁর কিতাবে আসহাবে আকাবার নিম্নরূপ নাম দিয়েছেনঃ
(১) মু'তাব ইবনে কুশাইর, (২) ওয়াদীআ' ইবনে সাবিত, (৩) জাদ্দ ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে নাবীল, এ ছিল আমর ইবনে আউফের গোত্রের লোক, (৪) হারিস ইবনে ইয়াযীদ আত্তায়ী, (৫) আউস ইবনে কাইযী, (৬) হারিস ইবনে সাভীদ, (৭) সা’দ ইবনে যারারা, (৮) কায়েস ইবনে ফাহদ, (৯) বানু হুবলা গোত্রের সাভীদ ইবনে দাইস, (১০ কায়েস ইবনে আমর ইবনে সাহল, (১১) যায়েদ ইবনে লাসীত এবং (১২) সালালা ইবনে হামাম। শেষোক্ত দু’ব্যক্তি বানু কাইনুকা গোত্রের লোক। তারা সবাই বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
এ আয়াতেই এর পরে বলা হয়েছে। তারা শুধু এরই প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। যে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাঁর রাসূল (সঃ)-এর মাধ্যমে তাদেরকে মালদার করেছেন। যদি তাদের উপর আল্লাহ তাআলার পূর্ণ অনুগ্রহ হতো তবে তাদের ভাগ্যে হিদায়াতও জুটতো। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আনসারদেরকে বলেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পাইনি, অতঃপর আমার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন? তোমরা কি বিচ্ছিন্ন ছিলে না, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে প্রেমের সূত্রে আবদ্ধ করেছেন? তোমরা কি দরিদ্র ছিলে না, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে ধনী করেছেন?” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে আনসাররা বলছিলেনঃ “নিশ্চয়ই আমাদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর এর চেয়েও বেশী ইহসান রয়েছে। মোটকথা, বর্ণনা এই যে, বিনা কারণে ও বিনা দোষে এই লোকগুলো শত্রুতা ও বেঈমানী করে বসেছে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ “কাফিররা মুমিনদের শুধু এরই প্রতিশোধ নিয়েছিল যে, তারা প্রবল পরাক্রান্ত ও মহা প্রশংসিত আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ইবনে জামীল শুধু এরই প্রতিশোধ নিচ্ছে যে, সে দরিদ্র ছিল, অতঃপর আল্লাহ তাকে সম্পদশালী করেছেন।”
এরপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাওবার দিকে ডাক দিয়ে বলেনঃ “এখনও যদি তারা তাওবা করে নেয় তবে তা তাদের জন্যে কল্যাণকর হবে। আর যদি তারা তাদের নীতির উপরই অটল থাকে তবে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে বেদনাদায়ক শাস্তি প্রদান করবেন।” অর্থাৎ যদি তারা তাদের পন্থা ও নীতিকেই আঁকড়ে ধরে থাকে তবে আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়ায় যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন হত্যা, দুঃখ এবং চিন্তার দ্বারা, আর পরকালে জাহান্নামের অপমানজনক ও কষ্টদায়ক আযাব দ্বারা।
আল্লাহ তা'আলার উক্তিঃ “দুনিয়ায় তাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই।” অর্থাৎ দুনিয়ায় এমন কেউ নেই যে তাদেরকে কোন সাহায্য করতে পারবে। না পারবে তারা তাদের কোন উপকার করতে এবং না পারবে তাদের কোন কষ্ট দূর করতে। অসহায়ভাবেই তারা জীবন কাটাবে।
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings