Surah At Tawbah Tafseer
Tafseer of At-Tawbah : 27
Saheeh International
Then Allah will accept repentance after that for whom He wills; and Allah is Forgiving and Merciful.
Ibn Kathir Full
Tafseer 'Ibn Kathir Full' (BN)
২৫-২৭ নং আয়াতের তাফসীর:
মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, সূরায়ে বারাআতের এটাই প্রথম আয়াত যাতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের উপর তার বড় ইহসানের কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি স্বীয় নবী (সঃ)-এর সহচরদেরকে সাহায্য করতঃ তাঁদের শত্রুদের উপর তাদেরকে জয়যুক্ত করেছেন। এক জায়গায় নয়, বরং প্রতিটি জায়গায় তাদের উপর তাঁর সাহায্য থেকেছে। এ কারণেই বিজয় ও সফলতা কখনও তাদের সঙ্গ ছাড়েনি। এটা ছিল একমাত্র আল্লাহ তাআলারই সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতার ফল, মাল ও যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্রের আধিক্যে নয়। আর এটা সংখ্যাধিক্যের কারণেও ছিল না। আল্লাহ পাক মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলেনঃ “তোমরা হুনায়েনের দিনটি স্মরণ কর। সেই দিন তোমরা তোমাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে কিছুটা গর্ববোধ করেছিলে। তখন তোমাদের অবস্থা এই দাঁড়ালো যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে! মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক শুধু নবী (সঃ)-এর কাছে থাকলো । ঐ সময়েই আল্লাহর সাহায্য অবতীর্ণ হলো এবং তিনি তোমাদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করলেন যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পার যে, বিজয় লাভ শুধু আল্লাহর সাহায্যের মাধ্যমেই সম্ভব। তার সাহায্যের ফলেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল। বড় বড় দলের উপর বিজয়ী হয়ে থাকে। আল্লাহর সাহায্য ধৈর্যশীলদের সাথেই থাকে।” এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে আমরা ইনশাআল্লাহ এখনই বর্ণনা করছি। মুসনাদে আহমাদে ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “উত্তম সহচর হচ্ছে চার জন। উত্তম ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর সংখ্যা হচ্ছে চারশ’। উত্তম বৃহৎ সেনাবাহিনীর সংখ্যা হলো চার হাজার। আর বারো হাজারের সেনাবাহিনীর তো স্বল্পতার কারণে পরাজিত হতেই পারে না।” (এ হাদীসটি সুনানে আবি দাউদ ও জামিউত তিরমিযীতেও রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান গারীব বলেছেন। একজন বর্ণনাকারী ছাড়া অন্য সবাই এটাকে মুরসাল’ রূপে বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) ও ইমাম বায়হাকীও (রঃ) এটা বর্ণনা করেছেন। এসব বিষয় আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর শাওয়াল মাসে হুনায়েনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মক্কা বিজয়ের ঘটনা হতে অবকাশ লাভের পর নবী (সঃ) প্রাথমিক সমুদয় কার্য সম্পাদন করেন, আর এদিকে মক্কার প্রায় সব লোকই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সকলকে আযাদও করে দেন। এমতাবস্থায় তিনি অবহিত হন যে, হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা সম্মিলিতভাবে একত্রিত হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। তাদের নেতা হচ্ছে মালিক ইবনে আউফ নাসরী। সাকীফের সমস্ত গোত্রও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। অনুরূপভাবে বানু জাশম এবং বানু সা’দ ইবনে বকরও তাদের সাথে রয়েছে। বানু হিলালের কিছু লোকও ইন্ধন যোগাচ্ছে। বানু আমর ইবনে আমির এবং আউন ইবনে আমিরের কিছু লোকও তাদের সাথে আছে। এসব লোক একত্রিতভাবে নিজেদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এবং বাড়ীর ধন-সম্পদ নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে বেরিয়ে পড়লো। এমন কি তারা তাদের বকরী ও উটগুলোকে সাথে নিলো। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর সাথে মুহাজির ও আনসারদেরকে নিয়ে তাদের মুকাবিলার জন্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। মক্কার প্রায় দু’হাজার নওমুসলিমও তার সাথে যোগ দেন। মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী উপত্যকায় উভয় সেনাবাহিনী মিলিত হলো। এ স্থানটির নাম ছিল হুনাইন। অতি সকালে আঁধার থাকতেই গুপ্তস্থানে গোপনীয়ভাবে অবস্থানকারী হাওয়াযেন গোত্র মুসলিমদের অজান্তে আকস্মিকভাবে তাদেরকে আক্রমণ করে বসে। তারা অসংখ্যা তীর বর্ষণ করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হয় এবং তরবারী চালনা শুরু করে দেয়। ফলে মুসলিমদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তাঁদের মধ্যে পলায়নের হিড়িক পড়ে যায় । কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের দিকে অগ্রসর হন। এ সময় তিনি সাদা খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন। আব্বাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জন্তুটির লাগামের ডান দিক ধরে ছিলেন এবং আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) বাম দিক ধারণ করেছিলেন। এ দু’জন জন্তুটির দ্রুতগতি প্রতিরোধ করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) উচ্চৈঃস্বরে নিজের পরিচয় দিচ্ছিলেন এবং মুসলিমদেরকে ফিরে আসার নির্দেশ দান করছিলেন। তিনি জোর গলায় বলছিলেনঃ “হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা কোথায় যাচ্ছ? এসো, আমি আল্লাহর সত্য রাসূল। আমি মিথ্যাবাদী নই। আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর।” ঐ সময় তার সাথে মাত্র আশি থেকে একশজন সাহাবা উপস্থিত ছিলেন। আবু বকর (রাঃ), উমার (রাঃ), আব্বাস (রাঃ), আলী (রাঃ), ফযল ইবনে আব্বাস (রাঃ), আৰূ সুফিয়ান ইবনে হারিস (রাঃ), আইমান ইবনে উম্মে আইমান (রাঃ), উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ) প্রমুখ মহান ব্যক্তিবর্গ তার সাথেই ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর চাচা উচ্চৈঃস্বর বিশিষ্ট ব্যক্তি আব্বাস (রাঃ)-কে হুকুম দিলেন যে, তিনি যেন গাছের নীচে বায়আত গ্রহণকারীদেরকে পালাতে নিষেধ করে দেন। সুতরাং আব্বাস (রাঃ) উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিলেনঃ “হে বাবলা গাছের নীচে দীক্ষা গ্রহণকারীগণ! হে সূরায়ে বাকারার বহনকারীগণ!” এ শব্দ যাঁদেরই কাছে পৌঁছলো তারাই চারদিক থেকে লাব্বায়েক লাব্বায়েক বলতে বলতে ঐ শব্দের দিকে দৌড়িয়ে আসলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পার্শ্বে এসে দাড়িয়ে গেলেন। এমন কি কারো উট ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলে তিনি স্বীয় বর্ম পরিহিত হয়ে উটের উপর থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়েন এবং পায়ে হেঁটে নবী (সঃ)-এর সামনে হাযির হয়ে যান। যখন কিছু দল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর চারদিকে একত্রিত হয়ে যান তখন তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করতে শুরু করেন। প্রার্থনায় তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি আমার সাথে যে ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ করুন। অতঃপর তিনি এক মুষ্টি মাটি নেন এবং তা কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করেন। তাদের এমন কেউ বাকী থাকলো না যার চোখে ও মুখে ঐ মাটির কিছু না পড়লো । ফলে তারা যুদ্ধ করতে অপারগ হয়ে গেল এবং পরাজয় বরণ করলো। এদিকে মুসলিমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলেন। মুসলিমদের বাকী সৈন্য রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট চলে গেলেন। যারা শত্রুদের পিছনে ছুটেছিলেন তারা তাদের কিছু সংখ্যক লোককে হত্যা করে ফেলেন এবং অবশিষ্টদেরকে বন্দী করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে এনে হাযির করেন। মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, আবু আবদির রহমান ফাহরী, যার নাম ইয়াযীদ ইবনে উসাইদ অথবা ইয়াযীদ ইবনে আনীস এবং যাকে কুরও বলা হয়, তিনি বলেন, আমি এই যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম। আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত গরম । দুপুরের সময় আমরা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম গ্রহণ করি। সূর্য পশ্চিমে চলে যাওয়ার পর আমি আমার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হই এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর তাঁবুতে পৌছি। সালামের পর আমি তাঁকে বলি, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এখন বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তিনি বলেনঃ “হ্যাঁ, ঠিক আছে।” অতঃপর তিনি ডাক দেনঃ “বিলাল!” ঐ সময় বিলাল (রাঃ) একটি গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ডাক শোনা মাত্রই (আরবী) এ কথা বলতে বলতে তিনি হাযির হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “আমার সওয়ারী ঠিক কর।" তখনই তিনি তার। ঘোড়ার জিন কষে দেন, যার পাল্লা দু’টি ছিল খেজুর পাতার রঞ্জু। সেখানে ছিল না কোন গর্ব ও অহংকারের বস্তু! জিন কষা শেষ হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঘোড়ার উপর আরোহণ করেন। আমরা কাতারবন্দী হয়ে যাই। সন্ধ্যা ও রাত্রি এভাবেই কেটে যায়। অতঃপর উভয় সৈন্যদল মুখোমুখী হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে মুসলিমরা পালাতে শুরু করেন, যেমন আল্লাহ পাক কুরআন কারীমে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সবাইকে ডাক দিয়ে বলেনঃ “হে আল্লাহর বান্দারা! আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। হে মুহাজির দল! আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।” এরপর তিনি ঘোড়া হতে অবতরণ করেন এবং এক মুষ্টি মাটি নিয়ে বলেনঃ “এটা যেন তাদের চেহারায় পতিত হয়।”এ কথা বলে তিনি ঐ মাটি কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করেন। এতেই মহান আল্লাহ তাদেরকে পরাজিত করেন। ঐ মুশরিকরাই বর্ণনা করেছে- “আমাদের মধ্যে এমন কেউই বাকী ছিল না যার চোখে ও মুখে এ মাটি পড়েনি। ঐ সময় আমাদের মনে হচ্ছিল যেন যমীন ও আসমানের মাঝে কোন লোহার থালায় লোহা পতিত হচ্ছে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম হাফিয বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
একটি বর্ণনায় আছে যে, পলায়নকারী মুসলিমদের মধ্যে একশজন যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফিরে আসলেন তখন ঐ সময়েই তিনি কাফিরদেরকে আক্রমণ করার আদেশ দান করলেন। প্রথমতঃ তিনি আনসারদেরকে আহ্বান করেছিলেন। অতঃপর এ আহ্বান শুধু খাজরাজদের উপরেই রয়ে যায়। এ গোত্রটি যুদ্ধের সময় বড়ই ধৈর্যের পরিচয় দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সওয়ারীর উপর থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের দৃশ্য অবলোকন করছিলেন। তিনি বলেনঃ “এখন ঘোরতর যুদ্ধ চলছে। এতে এই হলো যে, আল্লাহ তা'আলা কাফিরদের যাদেরকে চাইলেন হত্যা করালেন এবং যাদেরকে চাইলেন বন্দী করালেন। আর তাদের মাল ও সন্তানগুলো ‘ফাই’ হিসেবে স্বীয় নবী (সঃ)-কে দান করলেন।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তাকে একটি লোক বলেনঃ “হে আবূ আম্মারাহ (রাঃ)! আপনারা কি হুনায়েনের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “(এ কথা সত্য বটে) কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পা মুবারক একটুও পিছনে সরেনি। ব্যাপার ছিল এই যে, হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা তীরন্দাজীতে উস্তাদ ছিল। আল্লাহর ফযলে আমরা প্রথম আক্রমণেই তাদেরকে পরাস্ত করে দেই। কিন্তু লোকেরা যখন গনীমতের মালের উপর ঝুঁকে পড়ে তখন হাওয়াযেন গোত্রের লোকেরা সুযোগ বুঝে পুনরায় তীর বর্ষণ শুরু করে দেয়। ফলে মুসলিমদের মধ্যে পলায়নের হিড়িক পড়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! সেদিন দেখেছি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পূর্ণ সাহস ও বীরত্বপণা! মুসলিম সৈন্যেরা পলায়ন করেছে। তিনি এমন কোন দ্রুতগামী সওয়ারীর আরোহী ছিলেন না যে, সেটা দৌড়িয়ে পালাতে কাজে আসবে। বরং তিনি একটি খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন এবং মুশরিকদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তিনি নিজেকে গোপন করে রাখেননি। বরং নিজের নাম উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করতে করতে চলছিলেন। যেন তাকে যারা চিনে না তারাও চিনতে পারে । চিন্তা করে দেখুন যে, একক সত্তার উপর তার কি পরিমাণ ভরসা! আর আল্লাহ তাআলার সাহায্যের উপর তার কত পূর্ণ বিশ্বাস! তিনি জানতেন যে, আল্লাহ তাআলা রিসালাতের ব্যাপারটাকে অবশ্যই পূর্ণ করবেন এবং তার দ্বীনকে দুনিয়ার সমস্ত দ্বীনের উপর বিজয়ী করে রাখবেন। সুতরাং সদা সর্বদা তার উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক!”
এখন আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর উপর ও মুসলিমদের উপর প্রশান্তি অবতীর্ণ করার কথা বলছেন এবং আরো বলছেন যুদ্ধে ফেরেশতা প্রেরণের কথা যাদেরকে কেউই দেখতে পায়নি।
ইমাম আবু জাফর ইবনে জারীর (রঃ) একজন মুশরিকের উক্তি নকল করেছেন যে, ঐ মুশরিক বর্ণনা করেছে- “হুনায়েনের দিন যখন আমরা যুদ্ধের জন্যে মুসলিমদের মুখোমুখী হই তখন তাদেরকে আমরা একটি বকরি দোহনে যে সময় লাগে এতটুকু সময়ও আমাদের সামনে টিকতে দেইনি, এর মধ্যেই তারা পরাজিত হয়ে যায় এবং তারা পালাতে শুরু করে। আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করি। এমতাবস্থায় একটি লোককে আমরা খচ্চরের উপর সওয়ার দেখতে পাই। আমরা আরো দেখতে পাই যে, কয়েকজন সুন্দর সাদা উজ্জ্বল চেহারার লোক তার চারদিকে রয়েছে এবং তাদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, ‘তোমাদের চেহারাগুলো নষ্ট হাক, তোমরা ফিরে যাও। তাদের একথা বলার পরক্ষণেই আমাদের পরাজয় ঘটে যায়। শেষ পর্যন্ত মুসলিমরা আমাদের কাঁধে চেপে বসে।"
ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুনায়েনের যুদ্ধের দিন আমিও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথেই ছিলাম। তার সাথে মাত্র আশিজন মুহাজির ও আনসার রয়ে গিয়েছিলেন। আমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিনি। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাদা খচ্চরের উপর সওয়ার হয়ে শত্রুদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর জন্তুটি হোঁচট খেলো । সুতরাং তিনি জিনের উপর থেকে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। আমি তাকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি উপরে উঠে যান। আল্লাহ আপনাকে উপরেই রাখবেন। তিনি তখন আমাকে বললেন, “এক মুষ্টিপূর্ণ মাটি নিয়ে এসো।” আমি তাঁকে এক মুষ্টিপূর্ণ মাটি এনে দিলাম। তিনি তা কাফিরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। ওটা তাদের চোখে পড়লো। অতঃপর তিনি বললেনঃ “মুহাজির ও আনসার কোথায়?” আমি উত্তরে বললাম, তারা এখানে আছে। তিনি বললেনঃ “তাদেরকে ডাক দাও।" আমি তাদেরকে ডাক দেয়া মাত্রই তারা তরবারী নিয়ে দ্রুত বেগে ধাবিত হলো। তখন মুশরিকরা দিশাহারা হয়ে পালাতে শুরু করলো।” (এ হাদীসটি হাফিয় বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম আহমাদ (রঃ) তাঁর মুসনাদে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন)
শায়বা ইবনে উসমান (রাঃ) বলেন, হুনায়েনের যুদ্ধের দিন যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আমি এমন অবস্থায় দেখি যে, মুসলিম সৈন্যেরা পরাজিত হয়ে পালাতে শুরু করেছেন এবং তিনি একাকী রয়ে গেছেন, তখন আমার বদরের দিনের কথা স্মরণ হয়ে যায়। ঐদিন আমার পিতা ও চাচা আলী (রাঃ) ও হামযা (রাঃ)-এর হাতে মারা যায়। আমি মনে মনে বলি যে, এর প্রতিশোধ গ্রহণের এর চেয়ে বড় সুযোগ আর কি হতে পারে? অতঃপর আমি নবী (সঃ)-কে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার ডান দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি যে, সেখানে আব্বাস ইবনে আব্দিল মুত্তালিব (রাঃ) চাঁদির ন্যায় সাদা বর্ম পরিহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি ভাবলাম যে, তিনি স্বীয় ভ্রাতুস্পুত্রকে পূর্ণভাবে রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। তাই আমি তার বাম দিকে চলে গেলাম। সেখানেও দেখি যে, আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদিল মুত্তালিব (রাঃ) দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চিন্তা করলাম যে, তিনি তাঁর চাচাতো ভাইকে অবশ্যই রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করবেন। সুতরাং আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছন দিকে চলে গেলাম। আমি তাঁকে তরবারী দ্বারা আঘাত করতে উদ্যত হয়েছি এমন সময় দেখি যে, একটি আগুনের কোড়া বিদ্যুতের মত চমকিত হয়ে আমার উপর পতিত হচ্ছে। আমি দু'চোখ বন্ধ করে নিলাম এবং পশ্চাদপদে পিছন দিকে সরতে লাগলাম। ঐ সময়েই রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেনঃ “হে শায়বা! আমার কাছে এসো।" অতঃপর বললেনঃ “হে আল্লাহ! তার সাথের শয়তানদেরকে দূর করে দিন!” চোখ খুলে আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দিকে তাকালাম। আল্লাহর শপথ! ঐ সময় তিনি আমার কাছে আমার চক্ষু ও কর্ণ অপেক্ষাও অধিক প্রিয় ছিলেন। তিনি আমাকে বললেনঃ “হে শায়বা! যাও, কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করগে।” শায়বা (রাঃ) বলেন, ঐ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে আমিও ছিলাম। কিন্তু ইসলামের কারণে বা ইসলামের পরিচয় লাভের ভিত্তিতে বের হইনি। বরং আমি এটা চাইনি যে, হাওয়াযেন গোত্র কুরায়েশ গোত্রের উপর জয়যুক্ত হাক। আমি তার কাছেই দণ্ডায়মান ছিলাম, এমন সময় আমি সাদা কালো মিশ্রিত রং-এর ঘোড়া দেখে বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি তো সাদা কালো মিশ্রিত রং-এর ঘোড়া দেখতে পাচ্ছি! তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “হে শায়বা! এটা তো কাফিরগণ ছাড়া আর কারো দৃষ্টিগোচর হয় না!" অতঃপর তিনি আমার বক্ষে হাত রেখে দুআ করলেনঃ “হে আল্লাহ! আপনি শায়বাকে সুপথ প্রদর্শন করুন!" তারপর তিনি দ্বিতীয়বার ও তৃতীয়বার এরূপই করলেন এবং এটাই বললেন। আল্লাহর শপথ! তাঁর হাত আমার বক্ষ হতে সরে যাওয়ার পূর্বেই আমার অন্তরে তার প্রতি সারা দুনিয়া অপেক্ষা বেশী ভালবাসা সৃষ্টি হয়। (হাফিয বায়হাকী (রঃ)-এ হাদীসটি তাখরীজ করেছেন) তিনি পূর্ণ হাদীসটি বর্ণনা করেন, যাতে রয়েছে প্রাথমিক অবস্থায় মুসলিমদের পরাজয় বরণ, আব্বাস (রাঃ)-এর তাদেরকে আহ্বান, আল্লাহর কাছে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাহায্য প্রার্থনা এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলার মুশরিকদেরকে পরাজিতকরণ।
জুবাইর ইবনে মুতইম (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “হুনায়েনের যুদ্ধে আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলাম। আমি লক্ষ্য করি যে, আকাশ থেকে যেন কালো পিপড়ার মত কিছু অবতীর্ণ হচ্ছে, যা সারা মাঠকে ঘিরে ফেললো। তখনই মুশরিকদের পরাজয় ঘটে গেল। ওটা যে আসমানী মদদ বা সাহায্য ছিল এতে আমাদের কোনই সন্দেহ নেই।
ইয়াযীদ ইবনে আমির সুওয়াঈ (রাঃ) তাঁর কুফরীর যুগে হুনায়েনের যুদ্ধে কাফিরদের সাথে ছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ “ঐ সময় আপনাদের মনের ভীতি ও ত্রাসের অবস্থা কেমন ছিল?” তখন তিনি থালায় কংকর রেখে তা বাজাতে বাজাতে বলেনঃ “আমাদের অন্তরে এরূপ শব্দ অনুভূত হচ্ছিল। ফলে আমাদের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠছিল এবং অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছিল।” সহীহ মুসলিমে আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাকে ‘রুব’ বা ভক্তিযুক্ত ভয় দ্বারা সাহায্য করা হয়েছে এবং আমাকে সমুদয় কালেমা প্রদান করা হয়েছে। মোটকথা আল্লাহ তাআলা কাফিরদেরকে এই শাস্তি প্রদান করেন এবং ওটা ছিল তাদের কুফরীরই বিনিময়। হাওয়াযেন গোত্রের বাকী লোকদের উপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হয়। তাদেরও সৌভাগ্য লাভ হয় যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়। ঐ সময় তিনি বিজয়ী বেশে প্রত্যাবর্তনের পথে মক্কার নিকটবর্তী জেয়েররানা নামক স্থানে পৌছেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বিশদিন অতিক্রান্ত হয়েছিল। এ জন্যেই তিনি তাদেরকে বলেছিলেনঃ “দুটোর মধ্যে যে কোন একটি তোমরা পছন্দ করে নাও, বন্দী অথবা মাল!” তারা বন্দীদেরকে ফিরিয়ে নেয়াই পছন্দ করলো । ঐ বন্দীদের ছোট-বড়, নর-নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক প্রভৃতির মোট সংখ্যা ছিল ছয় হাজার। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সব বন্দীকেই তাদেরকে ফিরিয়ে দেন এবং তাদের মালকে গনীমত হিসেবে মুসলিমদের মধ্যে বন্টন করে দেন। তিনি মক্কার আযাদকৃত নও মুসলিদেরকেও ঐ মাল থেকে কিছু কিছু প্রদান করেন, যেন তাদের অন্তর পুরোপুরিভাবে ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মালিক ইবনে আউফ নাসরীকেও তিনি একশটি উট প্রদান করেন এবং তাকেই তার কওমের নেতা বানিয়ে দেন, যেমন সে ছিল। এরই প্রশংসায় সে তার প্রসিদ্ধ কবিতায় বলেছিলঃ (অনুবাদ) “আমি তো মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মত কাউকেও দেখিওনি, শুনিওনি। দান খয়রাতে এবং অপরাধ ক্ষমাকরণে তিনি হচ্ছেন বিশ্বের মধ্যে অদ্বিতীয়। কাল কিয়ামতের দিনে যা কিছু ঘটবে তা সবই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বীরত্ব ও সাহসিকতায়ও তিনি অতুলনীয়। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি সিংহের ন্যায় গর্জন করতে করতে শত্রুদের দিকে অগ্রসর হয়ে থাকেন। ”
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings