Surah Al Imran Tafseer
Tafseer of Ali 'Imran : 174
Saheeh International
So they returned with favor from Allah and bounty, no harm having touched them. And they pursued the pleasure of Allah, and Allah is the possessor of great bounty.
Ibn Kathir Full
Tafseer 'Ibn Kathir Full' (BN)
১৬৯-১৭৫ নং আয়াতের তাফসীর:
এখানে আল্লাহ তা'আলা বলেন-“আল্লাহর পথে শহীদ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলেও আখেরাতে তাদের আত্মা জীবিত থাকে এবং আহার্য প্রাপ্ত হয়। এ আয়াতটির শান-ই-নমূল এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) 'চল্লিশ অথবা সত্তরজন সাহাবীকে ‘বীরে মুআওনাহ' -এর দিকে পাঠিয়েছিলেন। এ দলটি যখন ঐ কূপের উপরে অবস্থিত গুহা পর্যন্ত পৌছেন তখন তারা তথায় শিবির স্থাপন করেন। তারা পরস্পর বলাবলি করেন, এমন কে আছে যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আল্লাহর রাসূলে (সঃ)-এর কালেমাকে ঐ পর্যন্ত পৌছাতে পারে? একজন সাহাবী ঐ জন্য প্রস্তুত হয়ে যান এবং ঐসব লোকের বাড়ীর নিকটে এসে উচ্চৈঃস্বরে বলেন, “হে বীরে মুআওনার অধিবাসীবৃন্দ! জেনে রেখো যে, আমি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর একজন দূত। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলাই একমাত্র মা’রূদ এবং মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।' এ কথা শুনামাত্রই এক কাফির তীর নিয়ে বাড়ী হতে বেরিয়ে আসে এবং এমনভাবে লক্ষ্য করে চালিয়ে দেয় যে, তার পঞ্জরের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। ঐ সাহাবীর মুখ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে যায়ঃ (আরবী) অর্থাৎ কা’বার প্রভুর শপথ! আমি সফলকাম হয়েছি। তখন কাফিরেরা পদচিহ্ন ধরে ঐ গুহা পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং তাদের নেতা আমের ইবনে তোফায়েল ঐ সব মুসলমানকে শহীদ করে দেয়। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, ‘তাদের সম্বন্ধে কুরআন কারীমের আয়াত অবতীর্ণ হয়। তাঁদের উক্তি যেন নিম্নরূপ, আমাদের পক্ষ হতে আমাদের সম্প্রদায়কে এ সংবাদ জানিয়ে দাও যে, আমরা আমাদের প্রভুর সাথে মিলিত হয়েছি। তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আমরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছি। আমরা বরাবর এ আয়াতগুলো পড়তে থাকি। অতঃপর কিছুদিন পর ঐগুলো রহিত করে দিয়ে উঠিয়ে নেয়া হয় এবং (আরবী)-এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। (মুহাম্মাদ ইবনে জারীর) সহীহ মুসলিম শরীফে রয়েছে, হযরত মাসরূক (রঃ) বলেন, 'আমরা হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ)-কে এ আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ ‘আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ আয়াতের ভাবার্থ জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বলেছিলেনঃ তাদের আত্মাসমূহ সবুজ রং-এর পাখীর দেহের মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্যে আরশে লটকান প্রদীপসমূহ রয়েছে। সারা জান্নাতের মধ্যে তারা যে কোন জায়গায় বিচরণ করে এবং ঐ প্রদীপসমূহে আরাম লাভ করে থাকে। তাদের প্রভু তাদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বলেন-“তোমরা কিছু চাও কি?' তারা বলেঃ “হে আল্লাহ! আমরা আর কি চাবো? জান্নাতের সর্বত্র আমরা ইচ্ছেমত চলে ফিরে বেড়াচ্ছি। এরপরে আমরা আর কি চাইতে পারি? আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে পুনরায় এটাই জিজ্ঞেস করেন এবং তারা ঐ এক উত্তরই দেয়। তৃতীয় বার আল্লাহ পাক ঐ প্রশ্নই করেন। তারা যখন দেখে যে, কিছু চাওয়া ছাড়া উপায় নেই তখন বলে, “হে আমাদের প্রভু! আমরা চাই যে, আমাদের আত্মাগুলো আপনি আমাদের দেহে ফিরিয়ে দিন। আমরা আবার দুনিয়ায় গিয়ে আপনার পথে যুদ্ধ করবো এবং শহীদ হবো’। তখন জানা হয়ে যায় যে, তাদের আর কোন জিনিসের প্রয়োজন নেই। সুতরাং তোমরা আর কি চাও?' এ প্রশ্ন করা হতে আল্লাহ তা'আলা বিরত থাকেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ যারা মারা যায় এবং আল্লাহর নিকট উত্তম স্থান লাভ করে তারা কখনও দুনিয়ায় ফিরে আসা পছন্দ করে না। কিন্তু শহীদগণ এ আকাংখা করে যে, তাদেরকে যেন পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং তারা দ্বিতীয় বার আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে শহীদ হতে পারে। কেননা, তারা স্বচক্ষে শাহাদাতের মর্যাদা দেখেছে'। (মুসনাদ-ই-আহমাদ) সহীহ মুসলিম শরীফে এ হাদীসটি রয়েছে। মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ)-কে বলেনঃ “হে জাবির! তুমিও জান যে, আল্লাহ তাআলা তোমার পিতাকে জীবিত করেছেন এবং তাকে বলেছেন-'হে আমার বান্দা! কি চাবে চাও? তখন সে বলেছে, হে আল্লাহ! পৃথিবীতে আবার আমাকে পাঠিয়ে দিন, যেন আমি দ্বিতীয়বার আপনার পথে যুদ্ধ করে শহীদ হতে পারি।' আল্লাহ তাআলা তখন বলেন-“এটা তো আমি ফায়সালা করেই ফেলেছি যে, এখান হতে কেউ দ্বিতীয়বার ফিরে যাবে না। তাঁর নাম ছিল হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম আনসারী (রাঃ)। সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে, হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, “আমার পিতার শাহাদাত লাভের পর আমি কাঁদতে আরম্ভ করি এবং তাঁর মুখমণ্ডল হতে কাপড় সরিয়ে সরিয়ে বার বার তার চেহারা দেখতে থাকি। সাহাবীগণ আমাকে নিষেধ করছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ) নীরব ছিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বলেনঃ “হে জাবির! ক্রন্দন করো না। যে পর্যন্ত তোমার পিতাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া না হবে সে পর্যন্ত ফেরেশতাগণ তাদের ডানা দিয়ে তাকে ছায়া করে থাকবেন। মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের ভাইদেরকে যখন উহুদের যুদ্ধে শহীদ করা হয় তখন আল্লাহ তা'আলা তাদের আত্মাগুলোকে সবুজ পক্ষীসমূহের দেহের মধ্যে নিক্ষেপ করেন যারা জান্নাতের বৃক্ষরাজির ফল ভক্ষণ করে, জান্নাতী নদীর পানি পান করে এবং আরশের ছায়ার নীচে লটকানো প্রদীপের মধ্যে আরাম ও শান্তি লাভ করে। যখন পানাহারের এরূপ উত্তম জিনিস তারা প্রাপ্ত হয় তখন বলতে থাকে, আমাদের জগতবাসী ভাইয়েরা যদি আমাদের উত্তম সুখভোগের সংবাদ পেতো, তাহলে তারা জিহাদ হতে মুখ ফিরিয়ে নিতো না এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো না। আল্লাহ পাক বলেনঃ “তোমরা নিশ্চিত থাক। আমি জগতবাসীকে এ সংবাদ পৌঁছিয়ে দেবো।' তাই আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এও বর্ণিত আছে যে, এ আয়াতগুলো হযরত হামযা (রাঃ) এবং তাঁর সঙ্গীদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। (মুসতাদরিক-ই-হাকিম) তাফসীর কারকগণ এ কথাও বলেছেন যে, উহুদের শহীদগণের ব্যাপারেই এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। আবু বকর ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ) হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, হযরত জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে দেখে বলেনঃ “হে জাবির (রাঃ)! তোমার কি হয়েছে যে, আমি তোমাকে চিন্তিত দেখছি?' আমি বলি, “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমার পিতা শহীদ হয়েছেন এবং তার উপর অনেক ঋণের বোঝা রয়েছে। তা ছাড়া আমার বহু ছোট ভাই বোনও রয়েছে। তিনি বলেনঃ “জেনে রেখো, আল্লাহ তাআলা যার সঙ্গে কথা বলেছেন পর্দার আড়াল থেকেই বলেছেন। কিন্তু তোমার পিতার সঙ্গে তিনি মুখখামুখী হয়ে কথা বলেছেন। তিনি তাকে বলেছেনঃ “তুমি আমার নিকট চাও। যা চাইবে তাই আমি তোমাকে দেবো। তোমার আব্বা বলেছে, “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এই চাচ্ছি যে, আপনি আমাকে পুনরায় দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন, যেন আমি আপনার পথে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে আসতে পারি।' মহা সম্মানিত আল্লাহ তখন বলেছেন, এ কথা তো আমি পূর্ব হতেই নির্ধারিত করে রেখেছি। যে, কেউই এখান হতে দ্বিতীয়বার দুনিয়ায় ফিরে যাবে না। তখন তোমার পিতা বলেন, হে আমার প্রভু! আমার পরবর্তীদেরকে তাহলে আপনি এ মর্যাদার সংবাদ পৌঁছিয়ে দিন। তখন আল্লাহ তা'আলা এ আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। বায়হাকীর মধ্যে এটুকু আরও বেশী আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহ! আমি তো আপনার ইবাদতের হকও আদায় করতে পারিনি।' মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যে রয়েছে যে, শহীদগণ জান্নাতের দরজার উপর নদীর ধারে সবুজ গম্বুজের উপর রয়েছে। সকাল-সন্ধ্যায় তাদের নিকট জান্নাতী দান পৌঁছে যায়। হাদীস দুটির মধ্যে অনুরূপতা এই যে, কতগুলো শহীদ এমন রয়েছেন যাদের আত্মাগুলো পাখীর দেহের অভ্যন্তরে রয়েছে, আবার কতগুলো এমন রয়েছেন যাদের অবস্থান স্থল হচ্ছে এ গম্বুজ। আর এও হতে পারে যে, তারা জান্নাতের মধ্যে ঘুরাফেরা করার পর এখানে একত্রিত হন এবং এখানেই তাদেরকে আহার করান হয়। এখানে এ হাদীসগুলো আনয়ন করাও খুবই উপযোগী হবে যেগুলোর মধ্যে প্রত্যেক মুমিনের জন্যে এ সুসংবাদই রয়েছে। মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মুমিনের আত্মা হচ্ছে একটি পাখী যে জান্নাতের বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করে বেড়ায়। শেষে কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তা'আলা সকলকে দাঁড় করাবেন তখন ঐ আত্মাকে তার দেহে ফিরিয়ে দেবেন। এ হাদীসের বর্ণনাকারীগণের মধ্যে তিনজন মর্যাদাসম্পন্ন ইমাম রয়েছেন, যারা এমন চারজন ইমামেরই অন্তর্ভুক্ত যাদের মাযহাব মান্য করা হয়। প্রথম হচ্ছেন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রঃ)। তিনি এ হাদীসটি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে ইদরীস শাফিঈ (রঃ) হতে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর শিক্ষক হচ্ছেন ইমাম মালিক ইবনে আনাস আসবাহী (রঃ)। সুতরাং ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম শাফিঈ (রঃ) এবং ইমাম মালিক (রঃ) এ তিনজন খ্যাতনামা ইমাম হচ্ছেন এ হাদীসের বর্ণনাকারী। অতএব, এ হাদীসের দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, ঈমানদারের আত্মা জান্নাতী পাখীর আকারে জান্নাতে অবস্থান করে এবং শহীদগণের আত্মা পূর্ব বর্ণনা হিসেবে সবুজ রং-এর পাখীর দেহে অবস্থান করে। এ আত্মাগুলো তারকারাজির ন্যায়। সাধারণ মুমিনদের আত্মা এই মর্যাদা লাভ করবে না। ওরা নিজে নিজেই উড়ে বেড়ায়। পরম দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা এই যে, স্বীয় অনুগ্রহ ও করুণার মাধ্যমে ঈমান ও ইসলামের উপর। আমাদের মৃত্যু দান করেন, আমীন!
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেন- এ শহীদগণ যেসব সুখ ও শান্তির মধ্যে রয়েছে তাতে তারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট এবং তাদের নিকট এটাও খুশীর বিষয় যে, তাদের বন্ধু যারা তাদের পরে আল্লাহর পথে শহীদ হবে ও তাদের নিকট আগমন করবে, আগামীর জন্যে তাদের কোন ভয় থাকবে না এবং তারা যা দুনিয়ায় ছেড়ে এসেছে তজ্জন্যে তাদের কোন দুঃখ হবে না। আল্লাহ পাক আমাদেরকেও জান্নাত দান করুন! হযরত মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেনঃ ‘এর ভাবার্থ এই যে, তারা সন্তুষ্ট, কেননা তাদের ভাই বন্ধুদের মধ্যে যারা জিহাদে লিপ্ত রয়েছে তারাও শহীদ হয়ে তাদের সুখের অংশীদার হবে এবং আল্লাহ তা'আলার প্রতিদানে উপকৃত হবে।' হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ শহীদকে একখানা পত্র দেয়া হয় যে, অমুক দিন তোমার নিকট অমুকের আগমন ঘটবে এবং অমুক দিন অমুক আসবে। সুতরাং যেমন দুনিয়াবাসী কোন অনুপস্থিত ব্যক্তির আগমন সংবাদে খুশী হয়ে থাকে, তদ্রুপ এ শহীদগণ ঐ শহীদদের আগমন সংবাদে সন্তুষ্ট হবে। হযরত সাঈদ ইবনে যুবায়ের (রঃ) বলেন, ভাবার্থ এই যে, যখন শহীদগণ জান্নাতে গমন করেন এবং তথায় স্বীয় স্থান, করুণা ও সুখ-শান্তি দর্শন করেন তখন বলেন, 'যদি এ অবগতি আমাদের ঐ ভাইদের থাকতো যারা এখন পর্যন্ত দুনিয়াতেই রয়েছে, তবে তারা বীরত্বের সাথে প্রাণপণে যুদ্ধ করতো এবং এমন জায়গায় প্রবেশ করতো যেখান হতে জীবিত ফিরে আসার আশা থাকতো না, তাহলে তারাও আমাদের এ সুখ ভোগের অংশীদার হতো।' সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণকে তাঁদের এ সম্ভোগের কথা জানিয়ে দেন। আর আল্লাহ তা'আলা তাদেরকে বলেন- 'আমি তোমাদের সংবাদ তোমাদের নবীর নিকট পৌছিয়ে দিয়েছি। ফলে তারা অত্যন্ত খুশী হন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বীরে মুআওনার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাঁরা ছিলেন সত্তরজন সাহাবী। তারা সবাই একই দিনে সকালে কাফিরদের তরবারীর আঘাতে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। তাঁদের হত্যাকারীদের জন্যে একমাস পর্যন্ত প্রত্যেক নামাযে কুনুতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বদদু'আ করেন এবং তাদেরকে অভিশাপ দেন। তাদের ব্যাপারেই কুরআন কারীমের নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল-“আমাদের সম্প্রদায়কে আমাদের সংবাদ পৌছিয়ে দিন যে, আমরা আমাদের প্রভুর সঙ্গে মিলিত হয়েছি। তিনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং আমরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছি। আল্লাহ পাক বলেন-“তারা আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ লাভ করার দরুন আনন্দিত হয়, আর এ জন্যেও আনন্দিত হয় যে, আল্লাহ মুমিনদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না। হযরত আব্দুর রহমান (রঃ) বলেন যে, (আরবী)-এ আয়াতটি সমস্ত মুমিনের ব্যাপারে প্রযোজ্য, শহীদ হোক আর নাই হোক। এরূপে খুব কম স্থানই রয়েছে যেখানে আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীদের মর্যাদার কথা বর্ণনা করার পর মমিনদের প্রতিদানের বর্ণনা না করেন। অতঃপর ঐ খাটি মমিনদের প্রশংসামূলক বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যারা হামরা-ই-আসাদের যুদ্ধে আহত ও ক্ষত বিক্ষত হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নির্দেশক্রমে জিহাদের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান। মুশরিকরা মুসলমানদেরকে বিপদ পৌছিয়ে ছিল, অতঃপর তারা বাড়ীর দিকে প্রস্থান করেছিল। কিন্তু পরে তাদের ধারণা হয় যে, সুযোগ খুব ভাল ছিল। মুসলমানেরা পরাজিত হয়েছিল এবং আহতও হয়েছিল, আর তাদের বড় বড় বীর পুরুষেরা শহীদও হয়েছিল। কাজেই তাদের মতে তারা একত্রিত হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধ করলে কাজই ফায়সালা হয়ে যেতো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের এ মনোভাবের কথা জানতে পেরে মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতঃ বলেনঃ “তোমরা আমার সাথে চল। আমরা মুশরিকদের পিছনে ধাওয়া করবো যেন তাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি হয় এবং তারা যেন জেনে নেয় যে, মুসলমানেরাও শক্তিহীন হয়নি। তিনি শুধু তাদেরকেই সাথে নিয়েছিলেন যারা উহুদের যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন। তারা ছাড়া তিনি শুধু হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়েছিলেন। ক্ষত-বিক্ষত হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আহ্বানে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেন। হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, যখন মুশরিকরা উহুদ হতে প্রত্যাবর্তন করে তখন পথে তারা চিন্তা করতঃ পরস্পর বলাবলি করে, না তোমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করলে, না মুসলমানদের স্ত্রীদেরকে ধরে ফেললে। দুঃখের বিষয় তোমরা কিছুই করনি। চল, ফিরে যাই। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এ সংবাদ পৌছলে তিনি মুসলমানদেরকে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেন। তাঁরা সব প্রস্তুত হয়ে যান এবং মুশরিকদের পশ্চাদ্ধাবন করেন। অবশেষে তারা হামরাউল আসাদ বা বীরে আবি উয়াইনা পর্যন্ত পৌছেন। মুশরিকরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং “আচ্ছা, আগামী বছর দেখা যাবে’ -এ কথা বলে তারা মক্কার দিকে প্রত্যাবর্তন করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-ও মদীনায় ফিরে আসেন। এটাকেও একটি পৃথক যুদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। এ পবিত্র আয়াতে ওরই বর্ণনা রয়েছে। উহুদের যুদ্ধ ১৫ই শাওয়াল রোজ শনিবার সংঘটিত হয়েছিল। ১৬ই শাওয়াল রোজ রবিবার রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আহ্বানকারী ডাক দিয়ে বলেন, “হে জনগণ! শত্রুদের অনুসন্ধানে চলুন এবং শুধুমাত্র তারাই যাবেন যারা গতকল্য যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। এ আহ্বান শুনে হযরত জাবির (রাঃ) উপস্থিত হয়ে আরয করেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! গতকালের যুদ্ধে আমি উপস্থিত ছিলাম না। কেননা, আমার পিতা হযরত আব্দুল্লাহ (রাঃ) আমাকে বলেছিলে, বৎস! তোমার সাথে তোমার এ ছোট ছোট বোনেরা রয়েছে। তুমি বা আমি কেউই এদেরকে একাকী এখানে ছেড়ে দু’জনই যাওয়া পছন্দ করি না। একজন যাবে এবং একজন এখানে থাকবে। আমার দ্বারা এটা হতে পারে না যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে তুমি যাবে আর আমি এখানে বসে থাকবো। এ জন্যেই আমার আনন্দ এই যে, তুমি তোমার বোনদের নিকট অবস্থান কর এবং আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে গমন করি।' এ কারণেই আমি ওখানেই ছিলাম এবং আমার পিতা আপনার সাথে এসেছিলেন। এখন আমার আকাঙ্খা এই যে, আজ আপনি আমাকে আপনার সাথে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করুন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, শত্রু যেন ভীত হয়ে পড়ে এবং তাদের পিছনে আসতে দেখে বুঝে নেয় যে, মুসলমানদেরও শক্তি কম নেই এবং তাদের সাথে মোকাবিলা করতে তারা অসমর্থ নয়। বানূ আব্দুশ শাহল গোত্রের একজন সাহাবী বর্ণনা করেন, “উহুদের যুদ্ধে আমরা দু' ভাই উপস্থিত ছিলাম। ভীষণভাবে আহত হয়ে আমরা ফিরে আসছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর আহ্বানকারী যখন শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবনের জন্যে ডাক দেন তখন আমরা দু’ ভাই পরস্পর বলাবলি করিঃ বড়ই দুঃখের বিষয় যে, না আমাদের নিকট কোন সোয়ারী আছে যে ওর উপর সোয়ার হয়ে আল্লাহর নবী (সঃ)-এর সঙ্গে গমন করি, না জখমের কারণে শরীরে এতটুকু শক্তি আছে যে, তার সাথে পদব্রজে চলি ।
সুতরাং বড়ই আফসোস যে, এ যুদ্ধ আমাদের হাত থেকে ছুটে যাবে। আমাদের অসংখ্য গভীর জখম আজ আমাদেরকে গমন হতে বিরত রাখবে। কিন্তু আবার আমরা সাহসে বুক বেঁধে নেই। আমার ভাইয়ের তুলনায় আমার জখম কিছু হালকা ছিল। যখন আমার ভাই সম্পূর্ণরূপে অপারগ হয়ে যেতে এবং তার পা উঠতো না তখন কোনও রকমে আমি তাকে উঠিয়ে নিতাম। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তাম তখন নামিয়ে দিতাম। এভাবে অতি কষ্টে আমরা সৈন্যদের নিকট পৌছেই গেলাম’! (সীরাত-ই-ইবনে ইসহাক) সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) হযরত উরওয়া (রঃ)-কে বলেন, “হে ভাগৃনে! তোমার দু' পিতা ঐ লোকদেরই অন্তর্ভুক্ত যাদের সম্বন্ধে (আরবী)-এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ হযরত যুবায়ের (রাঃ) ও হ্যরত সিদ্দীক (রাঃ)। উহুদের যুদ্ধে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং মুশরিকরা সামনে অগ্রসর হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ধারণা হয় যে, না জানি এরা পুনরায় ফিরে আসে। তাই, তিনি বলেনঃ তাদের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারে এরূপ কেউ আছে কি? এ কথা শুনা মাত্রই সত্তরজন সাহাবী প্রস্তুত হয়ে যান যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং একজন ছিলেন হযরত যুবায়ের (রাঃ)। এ বর্ণনাটি আরও অনেক সনদে বহু কিতাবে রয়েছে। ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ)-এর গ্রন্থে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার দু’জন পিতা ঐ লোকদের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটা মার’ রূপে বর্ণনা করা ভুল ছাড়া কিছুই নয়। কেননা, এর ইসনাদগুলো বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীদের উল্টো। তারা এ বর্ণনাটিকে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে মাওকুফরূপে এনেছেন। তাছাড়া এ জন্যেও যে, অর্থের দিক দিয়ে এর বিপরীত সাব্যস্ত আছে। হযরত যুবায়ের (রাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর বাপ-দাদা কেউই হতেন না। সঠিক কথা এই যে, এ বর্ণনাটি হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর ভাগ্নে হযরত আসমা বিনতে আবু বকর (রাঃ)-এর ছেলে হযরত উরওয়া (রাঃ)-কে বলেছিলেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, আল্লাহ তা'আলা আৰূ সুফইয়ানের অন্তরে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন এবং যদিও তিনি উহুদের যুদ্ধে কিছুটা সফলকাম হয়েছিলেন, তথাপি মক্কার দিকে গমন করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীগণকে বলেনঃ আবু সুফইয়ান তোমাদের ক্ষতি করে চলে গিয়েছেন। আল্লাহ তা'আলা তার অন্তরে ভীতি সৃষ্টি করেছেন।' উহুদের যুদ্ধ শাওয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছিল এবং ব্যবসায়ীগণ যীকা’দী মাসে মদীনায় এসেছিলো। প্রতি বছর তারা বদর-ই-সুগরায় তাদের শিবির স্থাপন করতো। এবারও তারা এ ঘটনার পরে এখানে আগমন করেন। মুসলমানগণ যুদ্ধে আহত হওয়ায় ক্ষত-বিক্ষত ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট তাঁরা নিজেদের কষ্টের কথা বর্ণনা করছিলেন এবং তাঁরা ভীষণ বিপদের মধ্যে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জনগণকে এ কথার উপর উত্তেজিত করেন যে, তাঁরা যেন তার সাথে গমন করেন। এ লোকগুলো এখন চলে যাবে এবং আবার হজ্বের সময় আসবে। সুতরাং আগামী বছর পর্যন্ত তাদের উপর এ ক্ষমতা চলবে না। কিন্তু শয়তান মুসলমানদেরকে ধমক দিতে এবং পথভ্রষ্ট করতে আরম্ভ করে। সে তাদেরকে বলে, তোমাদেরকে ধ্বংস করার জন্যে মুশরিকরা সৈন্য প্রস্তুত করে ফেলেছে। এতে মুসলমানদের মন দমে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাদেরকে বলেনঃ ‘তোমাদের একজনও না গেলেও আমি একাই যাবো। অতঃপর উৎসাহ প্রদানের ফলে হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), হযরত যুবায়ের (রাঃ), হযরত সা'দ (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ), হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ), হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রাঃ), হযরত আবূ উবাইদাহ ইবনে জাররাহ (রাঃ) প্রভৃতি সত্তর জন সাহাবী তার সাথে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান। এ পবিত্র সেনাদল আবু সুফইয়ানের অনুসন্ধানে বদর-ই-সুগরা পর্যন্ত পৌঁছে যান। তাঁদেরই মর্যাদা ও বীরত্বের বর্ণনা এ মুবারক আয়াতে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ সফরে মদীনা হতে আট মাইল দূরে হামরা-ই-আসাদ’ নামক স্থান পর্যন্ত পৌছে যান। মদীনায় তিনি হযরত ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ)-কে স্বীয় প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। তথায় তিনি সোম, মঙ্গল ও বুধ এ তিন দিন অবস্থান করেন এবং তৎপর মদীনায় ফিরে আসেন। তথায় অবস্থানকালীন সময়ে খুযাআ গোত্রের নেতা মা’বাদ খুযায়ী সেখান দিয়ে গমন করে। লোকটি নিজে মুশরিক ছিল। কিন্তু ঐ পুরো গোত্রের সাথে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সন্ধি হয়েছিল। ঐ গোত্রের মুশরিক ও মুমিন নির্বিশেষে তাঁর মঙ্গলাকাঙখী ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলে, “আপনার সঙ্গীদেরকে কষ্ট পৌছেছে বলে আমরা খুব দুঃখিত। আল্লাহ তা'আলা আপনাকে ও আপনার সহচরগণকে নিরাপদে রাখুন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হামরা-ইআসাদে পৌছার পূর্বেই আবু সুফইয়ান প্রস্থান করেছিলেন। যদিও তার ও তার সঙ্গীদের ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল যে, মুসলমানদেরকে হত্যা করে এবং আহত করে তাদের উপর বিজয় লাভের পরেও তাদের অবশিষ্টদেরকে হত্যা না করা ভুল হয়েছে। কাজেই ফিরে গিয়ে তাদের সকলকেই হত্যা করা উচিত। একথা পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, মা'বাদ খুযায়ীর তথায় আগমন ঘটেছিল। আবু সুফইয়ান তাকে জিজ্ঞেস করেন, বল, সংবাদ কি? সে বলে, রাসূলুল্লাহ স্বীয় সাহাবীবর্গসহ তোমাদের পিছনে আসছেন। তারা অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছেন। যারা পূর্ব যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি তারাও আসছেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে গেছে এবং তারা পূর্ণ শক্তির সাথে আক্রমণে উদ্যত হয়েছেন। আমি এরূপ সেনাবাহিনী পূর্বে কখনও দেখিনি।' একথা শুনে আবু সুফইয়ানের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। তিনি মা'বাদ খুযায়ীকে বলেন, “তোমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়া ভালই হলো। নতুবা আমরা তো স্বয়ং তাদের দিকে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত ছিলাম। মা’বাদ বলে, কখনও এরূপ ইচ্ছে করে না। আমার কথা কি? তোমরা এ স্থান ত্যাগ করার পূর্বেই হয়তো স্বয়ং ইসলামী সেনাবাহিনীর অশ্বসমূহ দেখতে পাবে। আমি তাঁদের সেনাবাহিনী, তাঁদের বীরত্ব, ক্রোধ, প্রস্তুতি এবং দৃঢ় সংকল্পের কথা ভাষায় প্রকাশ করতে অক্ষম। আমি তোমাদেরকে স্পষ্টভাবে বলছি যে, তোমরা অতি তাড়াতাড়ি পলায়ন কর ও নিজেদের প্রাণ রক্ষা কর। আমি তাদের ভয়াবহ প্রস্তুতির কথা পূর্ণভাবে বর্ণনা করতে পারছি না। সংক্ষেপ কথা এই যে, প্রাণ বাঁচাতে হলে শীঘ্রই এখান হতে প্রস্থান কর।' আবূ সুফইয়ান ও তার সঙ্গীরা হতবুদ্ধি হয়ে মক্কার পথ ধরে।
আবদুল কায়েস গোত্রের লোক, যারা ব্যবসার উদ্দেশ্যে মদীনা যাচ্ছিল, তাদেরকে আবু সুফইয়ান বলেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আমাদের সম্বন্ধে এ সংবাদ দেবে যে, আমরা তাদেরকে হত্যা করার জন্যে সৈন্য সংগ্রহ করছি এবং আমরা তাদের দিকে প্রত্যাবর্তনের সংকল্প করে ফেলেছি। যদি তোমরা তার নিকট এ সংবাদ পৌছিয়ে দাও তবে আমরা তোমাদেরকে উকাযের বাজারে অনেক কিসমিস প্রদান করবো।' অতএব তারা হামরা-ই-আসাদে এসে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এ ভয়াবহ সংবাদ শুনিয়ে দেয়। কিন্তু সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ) অত্যন্ত ধৈর্য ও বীরত্বের সাথে উত্তর দেন, “আমাদের জন্যে আল্লাহ পাকই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কার্যসম্পাদনকারী। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি তাদের জন্যে একটি পাথরের চিহ্ন ঠিক করে রেখেছি। যদি তারা ফিরে আসে তবে তথায় পৌছে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে যেমন গতকালকের দিনটি ছিল। কতগুলো লোক এও বলেছেন যে, এ আয়াত বদরের যুদ্ধের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু সঠিক কথা এই যে, এটা হামরা-ই-আসাদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হয়। ভাবার্থ এই যে, আল্লাহর শত্রুরা মুসলমানদেরকে হতোদ্যম করার জন্যে শত্রুদের সাজ-সরঞ্জাম ও সংখ্যাধিক্যের ভয় দেখিয়েছে। কিন্তু তারা ধৈর্যের পর্বতরূপে সাব্যস্ত হয়েছেন। তাদের দৃঢ় বিশ্বাসের মধ্যে কোন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়নি। বরং তাদের আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তারা আল্লাহ তা'আলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতঃ তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময়। (আরবী)-এ কালেমাটি পাঠ করেছিলেন এবং - হযরত মুহাম্মাদ মোস্তফা (সঃ) এ কালেমাটি ঐ সময় পাঠ করেছিলেন যখন মানুষ তাঁকে কাফিরদের ভীরু ও কাপুরুষ সৈন্যদের হতে ভয় দেখাতে চেয়েছিল। বড়ই বিস্ময়কর কথা এই যে, ইমাম হাকিম (রঃ) এ বর্ণনাটি আনয়নের পর বলেন, “এ বর্ণনাটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে নেই।
সহীহ বুখারী শরীফের একটি বর্ণনায় এও রয়েছে যে, আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার সময় হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর মুখ দিয়ে যে শেষ কালেমাটি বের হয়েছিল তা ছিল এ কালেমাটিই। হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, উহুদের যুদ্ধের সময় যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে কাফিরদের সৈন্যদের সংবাদ দেয়া হয় তখন তিনি এ কালেমাটি পাঠ করেছিলেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত আলী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি ছোট সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং পথে খুযাআ গোত্রের একজন লোক এ সংবাদ পরিবেশন করে তখন তিনি এ কালেমাটি পাঠ করেছিলেন। ইবনে মিরদুওয়াই (রঃ)-এর হাদীস গ্রন্থে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমাদের উপর কোন কাজ এসে পড়ে তখন তোমরা (আরবী) শেষ পর্যন্ত পাঠ করে নাও।' মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু' ব্যক্তির মধ্যে ফায়সালা করেন। তখন যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফায়সালা হয় সে এ কালেমাটিই পাঠ করে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে ডাকিয়ে নিয়ে বলেনঃ “অপারগতা ও অলসতার উপর আল্লাহ তা'আলার তিরস্কার প্রযোজ্য হয়ে থাকে। বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দান কর। যখন কোন কঠিন কাজে পড়ে যাও তখন এটা পড়ে নাও।' মুসনাদ-ই-আহমাদের অন্য হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “কিরূপে আমি নিশ্চিন্ত ও শান্তিতে থাকতে পারি? অথচ শিঙ্গাধারণকারী মুখে শিঙ্গা ধরে রয়েছেন এবং কপাল নীচু করে আল্লাহর নির্দেশের জন্যে অপেক্ষমান রয়েছেন যে, কখন আল্লাহর নির্দেশ হবে ও শিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। সাহাবীগণ তখন বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি পড়বো?' তিনি বলেনঃ “তোমরা (আরবী) পাঠ করবে। উম্মুল মুমিনীন হযরত যয়নাব (রাঃ) এবং উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত যয়নাব (রাঃ) গর্ব করে বলেন, আমার বিয়ে স্বয়ং আল্লাহ পাক দিয়েছেন এবং তোমার বিয়ে দিয়েছেন তোমার অভিভাবক ও উত্তরাধিকারীগণ।' হযরত আয়েশা (রাঃ) তখন বলেন, আল্লাহ তা'আলা আমার দোষহীনতা ও পবিত্রতার আয়াতগুলো আকাশ হতে স্বীয় পাক কালামে অবতীর্ণ করেন।' হযরত যয়নাব (রাঃ) ওটা স্বীকার করে নেন এবং জিজ্ঞেস করেন, “আচ্ছা বলতো, তুমি হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তালের সোয়ারীর উপর আরোহণের সময় কি পড়েছিলে? হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, (আরবী) পড়েছিলাম। একথা শুনে হযরত যয়নাব (রাঃ) বলেন, তুমি ঈমানদারদের কালেমাই পড়েছিলে। এরূপে এ আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-“ঐ নির্ভরশীলদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্ম বিধায়ক। যারা অন্যায়ের ইচ্ছে পোষণ করতো তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা লাঞ্ছনা ও অপমানের সাথে ধ্বংস করেছেন। মুসলমানেরা আল্লাহ পাকের দয়া ও অনুগ্রহে কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই স্বীয় শহরের দিকে প্রত্যাবর্তন করে এবং কাফিরেরা স্বীয় ষড়যন্ত্রে অকতকার্য হয়। মুসলমানদের প্রতি আল্লাহ তা'আলা সন্তুষ্ট হয়েছেন। কেননা, তাঁরা সন্তুষ্টির কার্যই করেছে। আল্লাহ তাআলা বড়ই গৌরবময়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর মতে নিয়ামত ছিল এই যে, তারা নিরাপদে ছিল এবং ফযল ছিল যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বণিকদের এক যাত্রীদলের নিকট মাল ক্রয় করেন যাতে বহু লাভ হয় এবং ঐ লভ্যাংশ তিনি স্বীয় সঙ্গীদের মধ্যে বন্টন করে দেন। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আবু সুফইয়ান রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলেছিলেন, 'এখন অঙ্গীকারের স্থান হচ্ছে বদর। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন, “সম্ভবতঃ তাই। অতএব রাসূলুল্লাহ (সঃ) তথায় পৌছেন। এ কাপুরুষের তথায় আগমন ঘটেনি। তথায় তখন বাজারের দিন ছিল। তিনি মাল ক্রয় করেন এবং লাভে বিক্রি করেন। ওরই নাম হচ্ছে বদর-ই-সুগরার যুদ্ধ। অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন, সে ছিল শয়তান যে তার বন্ধুদের মাধ্যমে তোমাদেরকে হুমকি দিয়েছিল, তাদেরকে ভয় না করাই তোমাদের কর্তব্য। বরং একমাত্র আমার ভয়ই অন্তরে জাগিয়ে রাখ। কেননা, ঈমানদারীর শর্ত এই যে, যখন কেউ ভয় প্রদর্শন করবে বা ধমক দেবে এবং ধর্মীয় কার্যে তোমাদেরকে বাধা প্রদান করবে তখন মুসলমান আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভর করবে, তারই দিকে প্রত্যাবর্তন করবে এবং দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, তিনিই যথেষ্ট এবং তিনিই সাহায্যকারী। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে (আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ কি তাঁর বান্দাদের জন্যে যথেষ্ট নন? এবং তারা তোমাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের হতে ভয় দেখাচ্ছে'। (৩৯:৩৬) শেষে বলেন- (আরবী) অর্থাৎ ‘তুমি বল- আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তার উপরই নির্ভরকারীগণ নির্ভর করে থাকে।' (৩৯:৩৮) অন্যস্থান রয়েছে- অর্থাৎ ‘তোমরা শয়তানের বন্ধুদের সাথে যুদ্ধ কর নিশ্চয়ই শয়তানের ষড়যন্ত্র দুর্বল।' (৪:৭৬) আর এক জায়গায় আল্লাহপাক বলেন- (আরবী) অর্থাৎ তারা শয়তানের সৈন্য, জেনে রেখো যে, শয়তানের সৈন্যরাই ক্ষতিগ্রস্ত'। (৫৮:১৯) অন্য জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা লিখে দিয়েছেন। অবশ্যই আমি ও আমার রাসূলগণই বিজয় লাভ করবো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা শক্তিশালী, মহাপ্রতাপান্বিত।' (৫৮:২১) অন্য স্থানে রয়েছে- (আরবী) অর্থাৎ যে আল্লাহকে সাহায্য করবে তিনি অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন। (২২:৪০) আর এক স্থানে বলেন- (আরবী) অর্থাৎ হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর তবে তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন।' (৪৭:৭) আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন- (আরবী) অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি রাসূলগণকে ও মুমিগণকে ইহজগতেও সাহায্য করবো এবং সেদিনও সাহায্য করবে যেদিন সাক্ষীগণ দণ্ডায়মান হবে। যেদিন অত্যাচারীদের ওযর কোন উপকার দেবে না, তাদের জন্য অভিশাপ এবং তাদের জন্যে রয়েছে জঘন্য ঘর। (৪০:৫১-৫২)
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings