Surah Al Baqarah Tafseer
Tafseer of Al-Baqarah : 3
Saheeh International
Who believe in the unseen, establish prayer, and spend out of what We have provided for them,
Tafsir Fathul Mazid
Tafseer 'Tafsir Fathul Mazid' (BN)
৩-৫ নং আয়াতের তাফসীর:
আলোচ্য আয়াত তিনটিতে আল্লাহ তা‘আলা মুত্তাকীন বা মু’মিনদের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন। (المتقين) মুত্তাকীন শব্দটি (المتقي) মুত্তাকী-এর বহুবচন। অর্থ- যারা পরহেয করে চলেন। একজন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বাচার জন্য তার ও আল্লাহ তা‘আলার ক্রোধ ও শাস্তির মাঝে যে প্রতিবন্ধক নির্ধারণ করে নেয় তাই হল তাকওয়া। সে প্রতিবন্ধক হল- আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যমূলক কাজ করা এবং তাঁর অবাধ্য কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে। উমর বিন আবদুল আযীয (রহঃ) বলেন: দিনের বেলা সিয়াম পালন, রাতের বেলা কিয়াম করার নাম তাকওয়া নয়। বরং তাকওয়া হল আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা বর্জন করা এবং যা ফরয করেছেন তা আদায় করা। এরপরেও যাকে ভাল কাজ করার তাওফীক দান করা হয়েছে তা ভালোর ওপর ভাল।
সুতরাং মুত্তাকী হলেন তারা, যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করতঃ জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁদের আদেশ পালন ও নিষেধ থেকে বিরত থাকেন।
মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
প্রথম বৈশিষ্ট্য গায়েবের প্রতি ঈমান রাখা: গায়েব হল যা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত ওয়াহী ব্যতীত পঞ্চন্দ্রীয় ও জ্ঞান দ্বারা জানা যায় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা, ফেরেশতা, জান্নাত ও জাহান্নাম ইত্যাদি।
আবুল আলিয়া (রহঃ) বলেন: গায়েবের প্রতি ঈমান আনা হল- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি, রাসূলদের প্রতি, আখিরাতের প্রতি, জান্নাত ও জাহান্নাম, আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত লাভের প্রতি এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবন ও পুনরুত্থানের প্রতি ঈমান আনা। কাতাদাহও (রহঃ) এ মত পোষণ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইবনু মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবীদের থেকে বর্ণনা করে বলেন: গায়েব হল- যা বান্দাদের থেকে অনুপস্থিত থাকে। যেমন জান্নাত, জাহান্নাম এবং কুরআনে যা উল্লেখ করা হয়েছে।
গায়েবের প্রতি ঈমান আনার অন্যতম একটি দিক হল- এ গায়েব আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি জানে না। কোন ওলী-আউলিয়া, বিদ্বান, মুর্শিদ এমনকি নাবী-রাসূলগণও না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(قُلْ لَّا یَعْلَمُ مَنْ فِی السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضِ الْغَیْبَ اِلَّا اللہُ)
“বল ‘আল্লাহ ব্যতীত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান রাখে না।”(সূরা নামল ২৭:৬৫)
এরূপ ৫৪টিরও বেশি আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র গায়েবের খবর রাখেন অন্য কেউ নয়। এমন কি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও গায়েব জানেন না, আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্য বলেন:
(قُلْ لَّآ اَمْلِکُ لِنَفْسِیْ نَفْعًا وَّلَا ضَرًّا اِلَّا مَا شَا۬ئَ اللہُﺚ وَلَوْ کُنْتُ اَعْلَمُ الْغَیْبَ لَاسْتَکْثَرْتُ مِنَ الْخَیْرِﹱ وَمَا مَسَّنِیَ السُّوْ۬ئُﹱ اِنْ اَنَا اِلَّا نَذِیْرٌ وَّبَشِیْرٌ لِّقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَﰋﺟ)
“বল: ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভাল-মন্দের ওপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি গায়েব জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মু’মিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা ছাড়া আর কিছুই নই।’(সূরা আ‘রাফ ৭:১৮৮)
তবে আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রাসূলদের মাঝে যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ওয়াহীর মাধ্যমে যতটুুকু গায়েবের তথ্য জানিয়েছেন ততটুকুই তিনি জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(عٰلِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلٰي غَيْبِه۪ٓ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضٰي مِنْ رَّسُوْلٍ فَإِنَّه۫ يَسْلُكُ مِنْم بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِه۪ رَصَدًا)
“তিনি গায়েবের অধিকারী, তিনি তাঁর গায়েবের জ্ঞান কারো নিকট প্রকাশ করেন না, তাঁর মনোনীত রাসূল ব্যতীত। নিশ্চয়ই তিনি তার সামনে এবং পিছনে প্রহরী নিয়োজিত করেন।”(সূরা জিন ৭২:২৬-২৭)
এ গায়েবের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী, কোন প্রকার কাশফ বা ইলহামের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(ذٰلِكَ مِنْ أَنْۭـبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ إِلَيْكَ ط وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يُلْقُوْنَ أَقْلَامَهُمْ أَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ ص وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ إِذْ يَخْتَصِمُوْنَ)
“এসব গায়েবের সংবাদ ওয়াহীর মাধ্যমে আমি তোমাকে জানাই। তুমি তো সে সময় তাদের কাছে ছিলে না যখন মারইয়ামের অভিভাবক কে হবে এজন্য তারা লটারী করেছিল এবং তুমি তো তখনও তাদের কাছে ছিলে না যখন তারা তর্ক-বিতর্ক করছিল।”(সূরা আলি ইমরান ৩:৪৪)
এরূপ সূরা হূদের ৪৯ নং ও সূরা ইউসুফের ১০২ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম হল ওয়াহী অর্থাৎ কুরআন ও হাদীস। আর আমরা জানি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কেউ গায়েব জানে এ দাবি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ গায়েব জানে ও তার কাছে ওয়াহী আসে বলে দাবি করে সে নিশ্চয়ই শয়তানের বন্ধু ও তার অনুসারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِنَّ الشَّيٰطِيْنَ لَيُوْحُوْنَ إِلٰٓي أَوْلِيَا۬ئِهِمْ لِيُجَادِلُوْكُمْ)
“নিশ্চয়ই শয়তানেরা তাদের বন্ধুদের কাছে ওয়াহী করে তোমাদের সাথে বিবাদ করার জন্য।”(সূরা আন‘আম ৬:১২১)
সুতরাং আমরা বিশ্বাস করব- গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা জানেন, এটা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন ওলী-আউলিয়া, ফকীর, গাউস-কুতুব ও পীর-দরবেশ এ জ্ঞান রাখে না। যদি কেউ গায়েব জানার দাবি করে তাহলে নিশ্চয়ই সে শয়তানের বন্ধু ও অনুসারী।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য- সালাত কায়িম করা:
মুত্তাকীন বা মু’মিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে যত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে সালাতের কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে শতাধিক বার সালাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো সালাতের প্রতি নির্দেশ, কখনো উৎসাহ প্রদান, কখনো ভীতি প্রদর্শন, কখনো সফলকামের কথা উল্লেখ করেছেন।
রাসূলুল্লাহও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসে সালাতের অনেক গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই আর মুহাম্মাদ আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল এ সাক্ষ্য দেয়া, সালাত কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, রমাযান মাসে সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লায় হাজ্জ পালন করা। (সহীহ বুখারী হা: ৮)
তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:
إِنَّ بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلَاةِ
নিশ্চয়ই মু’মিন এবং মুশরিক ও কাফিরের মাঝে পার্থক্য হল সালাত বর্জন করা। (সহীহ মুসলিম হা: ৮২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যাদের থেকে বাইয়াত বা প্রতিশ্র“তি গ্রহণ করতেন তাদের জন্য সালাত কায়িম করা শর্ত করে দিতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৫৭)
ইকামাতুস সালাত:
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে সালাত পড়ার কথা বলেননি বরং বলেছেন সালাত কায়িম করার কথা। ইকামাতুস সালাত অর্থ বাহ্যিকভাবে সালাতের রুকন, ওয়াজিব ও শর্তসহ যথাসময়ে আদায় করা এবং অভ্যন্তরীণভাবে বিনয়-নম্রতা ও অন্তরের উপস্থিতিসহ যা পাঠ করা হয় তা অনুধাবন করে আদায় করা। (তাফসীর সা‘দী: ১৭)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল তার ফরযসহ আদায় করা। তিনি আরো বলেন, ইকামাতুস সালাত হল- রুকু, সিজদাহ, তেলাওয়াত পরিপূর্ণ করতঃ বিনয়-নম্রতার সাথে অন্তরের উপস্থিতিসহ আদায় করা।
ইবনু জারির আত-তাবারী (রহঃ) বলেন: ইকামাতুস সালাত হল সালাতের যে সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান আছে তা যথাযথভাবে আদায় করা। (তাফসীর আত-তাবারী: ১/১৬৮) আর তা অবশ্যই হতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়। কেননা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
وَصَلُّوْا كَمَا رَأَيْتُمُونِيْ أُصَلِّيْ
তোমরা যেভাবে আমাকে সালাত আদায় করতে দেখেছো সেভাবেই আদায় কর। (সহীহ বুখারী হা: ৬৩১)
সালাত আদায় করতে হবে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তরীকায়, অন্য কোন মত ও কারো দেখনো পদ্ধতিতে নয়। কারণ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কারো তৈরি করা পদ্ধতিতে ইবাদত সস্পাদন করলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কবূল হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের নির্দেশ বহির্ভূত তা প্রত্যাখ্যাত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৭১৮)
সুতরাং ইকামাতুস সালাত হল নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতির আলোকে সালাতের সকল ফরয, ওয়াজিব ও বিধি-বিধান যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে আদায় করা।
অতএব যারা সালাত কায়িম দ্বারা সমাজের সকল ব্যক্তিকে নিয়ে সালাত আদায় করাকে বুঝান, যদিও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঠিক পদ্ধতি অনুসারে না হয়। তাদের এ বুঝ কুরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী। কেননা সালাত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদ্ধতি অনুযায়ী না হলে তা আল্লাহ তা‘আলার কাছে গ্রহণযোগ্যই হবে না।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য-
আল্লাহর দেয়া রিযিক হতে আল্লাহর পথে ব্যয় করা: আল্লামা আবদুর রহমান আস সা‘দী (রহঃ) তার স্বীয় তাফসীর গ্রন্থে বলেন- এখানে ফরয যাকাত, ফরয ব্যয় যেমন পরিবার, নিকট আত্মীয় ও দাস-দাসীদের জন্য ব্যয় এবং সকল কল্যাণকর কাজে মুস্তাহাব দান-খয়রাতও অন্তর্ভুক্ত। (তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১৭)
একজন মু’মিন-মুত্তাকী ব্যক্তি যতই সম্পদের মালিক হোক না কেন সে সর্বদাই বিশ্বাস করে যে, এসব সম্পদ প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ তা‘আলারই। তাই সে সর্বদাই আল্লাহ তা‘আলার পথে সম্পদ ব্যয় করে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এরূপ ব্যয়কারীদের জন্য ফেরেশতা দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি ব্যয়কারীর স¤পদ আরো বৃদ্ধি করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০)। অপরপক্ষে যার ঈমান দুুর্বল আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা তার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টকর। সে আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা থেকে বিরত থাকে। তার জন্য ফেরেশতা বদ্দু‘আ করে বলে: হে আল্লাহ! তুমি কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ ধ্বংস করে দাও। (সহীহ মুসলিম হা: ১০১০) তবে ফরয যাকাত আদায়ের পর সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلٰي عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ)
“তুমি তোমার হাতকে তোমার গলায় গুটিয়ে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কর না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৯)
অর্থাৎ অতি কাপর্ণ্য কর না এবং অপব্যয়ও কর না। বরং মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন:
(وَالَّذِيْنَ إِذَا أَنْفَقُوْا لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يَقْتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا)
“এবং যখন তারা ব্যয় করে তখন অপব্যয় করে না, কার্পণ্যও করে না, বরং তারা এতদুভয়ের মাঝে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬৭) সুতরাং মু’মিন-মুত্তাকীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁর পথে সাধ্যানুসারে সম্পদ ব্যয় করে।
চতুর্থ ও পঞ্চম বৈশিষ্ট্য- কুরআনসহ পূর্ববর্তী সকল আসমানী কিতাবের প্রতি ঈমান রাখা ও পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হওয়া : আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَالَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَآ اُنْزِلَ اِلَیْکَ وَمَآ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِکَﺆ وَبِالْاٰخِرَةِ ھُمْ یُوْقِنُوْنَ)
“এবং যারা তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে ও তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তাতে ঈমান আনে এবং পরকালের প্রতি যারা দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, এর ভাবার্থ হচ্ছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে যা কিছু নিয়ে এসেছেন এবং তাঁর পূর্ববর্তী নাবীগণ যা কিছু নিয়ে এসেছিলেন তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। উভয়ের প্রতি ঈমান আনতে কোন পার্থক্য করে না, কোন কিছু অস্বীকারও করে না এবং পরকালের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসী। অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মিযান ইত্যাদি সমস্ত পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে।
চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হতে প্রমাণিত হয় যে,
তাওরাত ও ইঞ্জিলে ঈমান আনয়নকারী ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান কুরআনের প্রতি ঈমান না আনা পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না বরং তারা জাহান্নামী হবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لاَ يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِيٌّ وَلاَ نَصْرَانِيٌ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
এ উম্মাতের কোন ইয়াহূদী বা খ্রিস্টান আমি যে রিসালাত দিয়ে প্রেরিত হয়েছি সে কথা শোনার পর তার প্রতি ঈমান না আনলে জাহান্নামের অধিবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা: ১৫৩, নাসায়ী হা: ১২৪১ সিলসিলা সহীহাহ হা: ৩০৯৩)
অপরপক্ষে তাওরাত বা ইঞ্জিলের প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তি নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও কুরআনের প্রতি ঈমান আনলে তাদের দ্বিগুণ প্রতিদান রয়েছে। যেমন সাহাবী আবূ মূসা আল-আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তিন ব্যক্তিকে তার কাজের বিনিমেয় দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবে- ১. ঐ আহলে কিতাব যে তার নাবীর ওপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রতিও ঈমান এনেছে ২. সেই কৃতদাস যে আল্লাহ তা‘আলার হক আদায় করে এবং সেই সঙ্গে তার মুনিবের হক আদায় করে এবং ৩. ঐ ব্যক্তি যার নিকট কৃতদাসী রয়েছে সে তাকে ব্যবহার করে, এরপর সে তাকে উত্তম শিক্ষা দেয় এবং আযাদ দিয়ের তাকে বিয়ে করে, তার জন্য দ্বিগুণ প্রতিদান। (সহীহ বুখারী হা: ৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ১৫৪)
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন: সূরা বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মু’মিনের বৈশিষ্ট্য, পরের দু’টি আয়াতে কাফিরদের আলোচনা এবং পরের ১৩টি আয়াতে মুনাফিকদের আলোচনা রয়েছে।
অতএব এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মু’মিন মুত্তাকীর জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবি হোক বা অনারবী হোক, মানব হোক বা দানব হোক।
কেননা এগুলো এমন গুণ যা একটি অন্যটির সম্পূরক। তাই কেউ গায়েবের প্রতি ঈমান আনল, সালাত কায়িম করল, যাকাত দিল, কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছেন তাতে ঈমান আনল না, সে মূলত পূর্ববর্তী রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতি ঈমান আনল না এবং আখিরতের প্রতিও বিশ্বাস করল না, তার সালাত, যাকাত কোন কাজে আসবে না। পূর্ববর্তী নাবী-রাসূল ও আসমানী কিতাবকে সাধারণভাবে বিশ্বাস করতে হবে, আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল কুরআন ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে সূরা নিসার ৪৬ ও ১৩৭ নং আয়াতে, সূরা আনকাবুতের ৪৬ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা নিয়ে এসেছে তার প্রতি ঈমান ও পূর্ববর্তী নাবীগণ যা নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সূরা বাকারার ২৮৫ নং আয়াতে, সূরা যুমারের ১৫২ নং আয়াতে সকল নাবী-রাসূলের প্রতি কোন পার্থক্য ছাড়াই ঈমান আনার নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
অতএব সকলকে ঈমানের প্রত্যেক রুকনের প্রতি সমানভাবে ঈমান আনতে হবে। তাহলেই প্রকৃত মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের আয়াতসমূহে যে বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, যারা ঐ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবে তাদেরকে ৫ নং আয়াতে তার সুসংবাদ প্রদান করেছেন। তারা হিদায়াতের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম। অর্থাৎ তারা জান্নাতে চিরস্থায়ী থাকবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে। তাকওয়া অবলম্বনের আরো ফলাফল হল- দুনিয়া ও আখেরাতে সফল ও সার্থক হওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مَخْرَجًا)
“যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ বের করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:২) যে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে আল্লাহ তা‘আলা তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ يَّتَّقِ اللّٰهَ يَجْعَلْ لَّه۫ مِنْ أَمْرِه۪ يُسْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে আল্লাহ তার কাজ-কর্ম সহজ করে দেন।”(সূরা তালাক ৬৫:৪) তাকওয়া অবলম্বন করলে পাপরাশি মোচন করে দেয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ یَّتَّقِ اللہَ یُکَفِّرْ عَنْھُ سَیِّاٰتِھ۪ وَیُعْظِمْ لَھ۫ٓ اَجْرًا)
“আল্লাহকে যে ভয় করে তিনি তার পাপরাশি মোচন করবেন এবং তাকে দেবেন মহাপুরস্কার।”(সূরা তালাক ৬৫:৫)
পরকালের সফলতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(مَثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِيْ وُعِدَ الْمُتَّقُوْنَ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهٰرُ أُكُلُهَا دَآئِمٌ وَّظِلُّهَا تِلْكَ عُقْبَي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَّعُقْبَي الْكٰفِرِيْنَ النَّارُ)
“মুত্তাকীদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে, তার উপমা এরূপ যে, তার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, তার ফলসমূহ ও ছায়া চিরস্থায়ী। যারা মুত্তাকী এটা তাদের কর্মফল এবং কাফিরদের কর্মফল জাহান্নাম।”(সূরা রা‘দ ১৩:৩৫)
(وَأُزْلِفَتِ الْجَنَّةُ لِلْمُتَّقِيْنَ غَيْرَ بَعِيْدٍ)
“আর জান্নাতকে নিকটস্থ করা হবে মুত্তাকীদের, কোন দূরুত্ব থাকবে না।”(সূরা কাফ ৫০:৩১) সুতরাং শুধু মৌখিক দাবির মাধ্যমে মু’মিন-মুত্তাকী হওয়া যায় না, এ জন্য আকীদাহ, আমল ও আখলাকে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা একান্ত প্রয়োজন।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. মু’মিন-মুত্তাকী তারাই যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তাদের আদেশ ও নিষেধাবলী জীবনের সর্বক্ষেত্রে পালন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
২. মু’মিন-মুত্তাকীদের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বৈশিষ্ট্য- গায়েবের প্রতি ঈমান আনা, সালাত কায়িম করা, আল্লাহ তা‘আলার পথে ব্যয় করা, আল্লাহ তা‘আলার নাযিলকৃত বিষয়ের প্রতি এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান আনা।
৩. গায়েবের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা। তিনি ছাড়া কোন নাবী-রাসূল, ওলী-আউলিয়া, গাউস-কুতুব, পীর-দরবেশ ইত্যাদি ব্যক্তিরা গায়েব জানে না। তবে আল্লাহ তা‘আলা ওয়াহীর মাধ্যমে নাবী-রাসূলদের যতটুকু জানান তা ব্যতীত।
৪. মু’মিনরা সালাতের ব্যাপারে খুব সচেতন। তারা যথাসময়ে জামাআতের সাথে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সহীহ পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে থাকে। এটাই হল ইকামাতুস সালাত।
৫. গায়েব জানার একমাত্র মাধ্যম ওয়াহী। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইনতেকালের পর ওয়াহী আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং কারো গায়েব জানার সুযোগ নেই। ইলহাম ও কাশফের মাধ্যমে গায়েব জানা যায় না।
৬. ঈমানের রুকন ছয়টি- আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বিশ্বাস, ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস, আসমানী কিতাবের প্রতি বিশ্বাস, রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস এবং তাকদীরের ভাল-মন্দের প্রতি বিশ্বাস। এসবগুলোর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস করতে হবে। কোন একটি রুকনকে অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না।
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings