Surah Al Baqarah Tafseer
Tafseer of Al-Baqarah : 102
Saheeh International
And they followed [instead] what the devils had recited during the reign of Solomon. It was not Solomon who disbelieved, but the devils disbelieved, teaching people magic and that which was revealed to the two angels at Babylon, Harut and Marut. But the two angels do not teach anyone unless they say, "We are a trial, so do not disbelieve [by practicing magic]." And [yet] they learn from them that by which they cause separation between a man and his wife. But they do not harm anyone through it except by permission of Allah . And the people learn what harms them and does not benefit them. But the Children of Israel certainly knew that whoever purchased the magic would not have in the Hereafter any share. And wretched is that for which they sold themselves, if they only knew.
Ibn Kathir Partial
Tafseer 'Ibn Kathir Partial' (BN)
মহানবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রিসালাত প্রাপ্তির প্রমাণ
ইবনে জারীর (রহঃ) বলেন “আমি তোমার নিকট সুস্পষ্ট আয়াত নাযিল করেছি” অর্থাৎ ‘হে মুহাম্মাদ! আমি এমন নিদর্শনবালী তোমার নিকট অবতীর্ণ করেছি যা তোমার নবুওয়াতের জন্য প্রকাশ্য দালীল। ইয়াহুদীদের বিশেষ জ্ঞান ভাণ্ডার তাওরাতের গোপনীয় কথা, তাদের পরিবর্তনকৃত আহ্কাম ইত্যাদি সব কিছুই আমি এই অলৌকিক কিতাব কুর’আন মাজীদে বর্ণনা করেছি। এটা শুনে প্রত্যেক জীবিত অন্তর তোমার নবুওয়াতের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তবে ইয়াহূদীরা যে হিংসা-বিদ্বেষবশত মানছে না সেটা অন্য কথা। নতুবা প্রত্যেক লোকই এটা বুঝতে পারে যে, একজন নিরক্ষর লোক কখনো এরকম পবিত্র অলংকার ও নিপুণতাপূর্ণ কথা বানাতে পারে না।’
ইবনে ‘আব্বাস (রহঃ) বলেন যে, ইবনু সুরিয়া কাতভীনী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলেছিলোঃ আপনি এমন কোন সৌন্দর্য ও দর্শনপূর্ণ বাণী আনতে পারেননি, যা দ্বারা আপনার নবুওয়াতের পরিচয় পেতে পারি বা কোন জ্বলন্ত প্রমাণ ও আপনার নিকট নেই। তখনই এই পবিত্র আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
ইয়াহুদীদের নিকট শেষ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে স্বীকার করার ওপর অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিলো তা তারা অস্বীকার করেছিলো বলে মহান আল্লাহ বলেন যে, অঙ্গীকার করে তা ভঙ্গ করা, এটা তো ইয়াহুদীদের চিরাচরিত অভ্যাস, বরং তাদের অধিকাংশের অন্তরই তো ঈমান শূন্য।
ইয়াহুদীরা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিলো
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ যখন ইয়াহুদীদেরকে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন তখন এই আয়াতের উত্তরে ইয়াহুদী পণ্ডিত ও নেতা মালিক ইবনে আস-সাঈফ বলে, মহান আল্লাহ্র শপথ! মুহাম্মাদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ্র সাথে আমাদের কোন প্রতিশ্রুতি ছিলো না এবং তিনি আমাদের কাছ থেকে কোন ওয়া‘দাও গ্রহণ করেন নি। তার এই বক্তব্যের জবাবে মহান আল্লাহ এ আয়াতে বলেন, ‘যখনই তারা কোন অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয় তখনই তাদের একদল তা ভঙ্গ করে।’ (তাফসীর তাবারী ২/৪০০)
نَبَذَ এর অর্থ হচ্ছে ‘ফেলে দেয়া।’ ইয়াহুদীরা মহান আল্লাহ্র কিতাবকে এবং তাঁর অঙ্গীকারকে এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছিলো যে, যেন তারা তা ফেলেই দিয়েছিলো। এ জন্যই তাদের নিন্দার ব্যাপারে এ শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন যে, যখন তাদের একটি দল কিতাবের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে একে এমনভাবে ছেড়ে দেয় যে, সে যেন জানেই না। তাওরাতের মাধ্যমে তারা তাঁর মুকাবিলা করতে সক্ষম হয়নি। কেননা এটা তো তাঁর সত্যতা প্রমাণকারী। সুতরাং এটাকে তারা পরিত্যাগ করে অন্য কিতাব গ্রহণ করে তার পিছনে লেগে যায়। মহান আল্লাহ্র কিতাবকে তারা এমনভাবে ছেড়ে দেয়, যেন তারা এর সম্বন্ধে কিছুই জানতো না। (তাফসীর তাবারী ২/২০৪) প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে তারা মহান আল্লাহ্র কিতাবকে তাদের পৃষ্ঠের পিছনে নিক্ষেপ করে।
যেমন মহান আল্লাহ্র বাণীঃ
﴿وَاتَّبَعُوْا مَا تَتْلُوا الشَّیٰطِیْنُ عَلٰى مُلْكِ سُلَیْمٰنَ١ۚ وَمَا كَفَرَ سُلَیْمٰنُ وَلٰكِنَّ الشَّیٰطِیْنَ كَفَرُوْا﴾
‘আর সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানেরা যা পাঠ করতো, তারা তা অনুসরণ করতো। মূলত সুলায়মান কুফরী করেনি বরং শায়তানেরাই কুফরী করেছিলো’ এর ব্যাখ্যায় আল আওফী (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন যখন সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব হাত ছাড়া হয়ে যায় তখন জ্বিন ও মানুষদের মধ্যে হতে একটি অংশ তারা মুরতাদ হয়ে প্রবৃত্তির অনুস্মরণ করতে থাকে। অতঃপর মহান আল্লাহ যখন সুলায়মান (আঃ)-এর হাতে পুনরায় রাজত্ব ফিরিয়ে দিলেন তখন মানুষেরা আবার পূর্বের দ্বীনে তথা সুলায়মান (আঃ)-এর দ্বীনেই ফিরে আসে। সুলায়মান (আঃ) তাদের যাদুর কিতাব গুলোর ওপর হস্তক্ষেপ করে সবগুলো কিতাব তাঁর সিংহাসনের নিচে পুতে রাখেন। এরপর সুলায়মান (আঃ) মৃত্যুবরণ করেন। এরপর মানুষ ও জ্বিন জাতি সিংহাসনের নিচে পুতে রাখা কিতাবগুলো উদ্ধার করে জনগণের উদ্দেশ্যে বলে যে, এটাই হলো মহান আল্লাহ কর্তৃক অবতারিত কিতাব যা মহান আল্লাহ তাঁর ওপর অবতীর্ণ করেছিলেন কিন্তু তিনি তা আমাদেরকে না জানিয়ে গোপন রেখেছিলেন। ফলে জনগণ সেটাকেই ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করলো। তখন মহান আল্লাহ এই আয়াতটি অবতীর্ণ করেনঃ
﴿وَ لَمَّا جَآءَهُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ نَبَذَ فَرِیْقٌ مِّنَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ١ۙۗ كِتٰبَ اللّٰهِ وَرَآءَ ظُهُوْرِهِمْ كَاَنَّهُمْ لَا یَعْلَمُوْنَ﴾
‘আর যখন তাদের কাছে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে রাসূল আসলো যে এদের নিকট যে কিতাব রয়েছে, সেই কিতাবের সমর্থক। তখন যাদের কিতাব দেয়া হয়েছিলো তাদের একদল মহান আল্লাহ্র কিতাবকে পিঠের পিছনে ফেলে দিলো, যেন তারা কিছুই জানে না।’ আর তারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করে অর্থাৎ শায়তান তাদের নিকট যা আবৃত্তি করে তারই অনুসরণ করতে থাকলো। ‘শয়তান যা আবৃত্তি করে’ অর্থাৎ গান-বাজনা, খেল-তামাশা এবং মহান আল্লাহ্র স্বরণ হতে বিরত রাখে এমন প্রত্যেক জিনিসই ما تتلو الشياطين এর অন্তর্ভুক্ত।
সুলাইমান (আঃ) এর ঘটনা এবং যাদুর মূল তত্ত্বের উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে সুলাইমান (আঃ)-এর নিকট একটি আংটি ছিলো। পায়খানায় গেলে তিনি সেটা তার স্ত্রী জারাদার নিকট রেখে যেতেন। সুলাইমান (আঃ)-এর পরীক্ষার সময় এলে একটি শয়তান জ্বিন তাঁর রূপ ধারণ করে স্ত্রী জারাদার নিকট আসে এবং আংটিটি চায়। স্ত্রী তাকে স্বামী ভেবেই আংটিটি তাকে দিয়ে দেয়। আর সে তা পরে সুলাইমান (আঃ)-এর সিংহাসনে বসে যায়। সমস্ত জ্বিন, মানব ও শয়তান তার খিদমতে হাজির হয়। সে শাসন কার্য চালাতে থাকে। এদিকে সুলাইমান (আঃ) ফিরে এসে তার স্ত্রীর নিকট আংটি চান। তার স্ত্রী বলেন, তুমি মিথ্যাবাদী। তুমি সুলাইমান (আঃ) নও। সুলাইমান (আঃ) তো আংটি নিয়ে গেছেন।
সুলাইমান (আঃ) বুঝে নেন যে এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তার ওপর পরীক্ষা। এ সময়ে শায়তানরা যাদু বিদ্যা, জ্যোতিষ বিদ্যা এবং ভবিষ্যতে সত্য- মিথ্যা খবরের কতক গুলো কিতাব লিখে। আর সেগুলো সুলাইমান (আঃ) এর সিংহাসনের নীচে পুতে রাখে। সুলাইমান (আঃ)-এর পরীক্ষার যুগ শেষ হলে পুনরায় তিনি সিংহাসন ও রাজপাটের মালিক হয়ে যায়। স্বাভাবিক বয়সে পৌঁছে যখন তিনি রাজত্ব হতে অবসর গ্রহণ করেন, তখন শয়তানরা জনগণকে বলতে শুরু করে যে, সুলাইমান (আঃ) ধনাগার এবং ঐ পুস্তক যার বলে তিনি বাতাস ও জ্বিনদের ওপর শাসন কার্য চালাতেন তা তাঁর সিংহাসনের নিচে পোতা রয়েছে। জিনেরা ঐ সিংহাসনের নিকট যেতে পারতো না বলে মানুষেরা ওটা খুঁড়ে ঐ সব পুস্তক বের করে। সুতরাং বাইরে এর আলোচনা হতে থাকে। আর প্রত্যেকই এ কথা বলে যে সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্বের রহস্য এটাই ছিলো। এমনকি জনগণ সুলাইমান (আঃ)-এর নবুওয়াতকেও অস্বীকার করে বসে এবং তাঁকে যাদুকর বলতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সত্যতা অস্বীকার করেন এবং মহান আল্লাহ্র ফরমান জারি হয় যে, যাদু বিদ্যার এ কুফরী শায়তানরা ছড়িয়ে ছিলো। সুলাইমান (আঃ) এটা হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন।
ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট একটি লোক আগমন করলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় থেকে আসছো ? সে বলেঃ ‘ইরাক হতে। তিনি বলেনঃ ‘ইরাকের কোন শহর হতে? সে বলেঃ কূফা থেকে। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ তথাকার সংবাদ কি? সে বলেঃ তথায় আলোচনা হচ্ছে যে, ‘আলী (রাঃ) মারা যায়নি, বরং তিনি জীবিত আছেন এবং সত্বরই আসবেন। একথা শুনে ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) কেঁপে উঠেন এবং বলেন, এটা সত্য হলে আমরা তার মীরাস বন্টন করতাম না। আর তার স্ত্রীগণকে বিয়ে করতাম না। শোন শয়তানরা আকাশ বানী চুরি করে শুনে নিতো এবং তার সাথে আরো কিছু তাদের নিজস্ব কথা মিলিয়ে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতো। সুলাইমান (আঃ) ঐ সব পুস্তক জমা করে তার সিংহাসনের নিচে পুঁতে দেন। তার মৃত্যুর পর জ্বিনেরা তা বের করে নেয়। ঐ গ্রন্থগুলো ‘ইরাকের মধ্যেও ছড়িয়ে রয়েছে এবং ঐ পুস্তক গুলোর কথাই তারা বর্ণনা করছে এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ আয়াতে তারই বর্ণনা রয়েছে।
সেই যুগে এটা প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলো যে, শয়তানরা ভবিষ্যত জানে। সুলাইমান (রহঃ) এই গ্রন্থগুলো বাক্সে ভরে পুতে ফেলার পর এই নির্দেশ জারী করেন যে একথা বলবে তার মাথা কেটে নেয়া হবে।
কোন কোন বর্ণনায় আছে যে সুলাইমান (আঃ)-এর ইনতিকালের পর জ্বিনেরা ঐ পুস্তক গুলো তার সিংহাসনের নিচে পুঁতে রাখে এবং ওর প্রথম পৃষ্ঠায় লিখে রাখে, এ জ্ঞানভাণ্ডার আসিফ বিন রারখিয়া কর্তৃক সংগ্রহ করা হয়েছে। যিনি সুলাইমান ইবনে দাউদ (আঃ)-এর প্রধানমন্ত্রী, বিশিষ্ট পরামর্শ দাতা এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। ইয়াহুদীদের মধ্যে এটা ছড়িয়ে পড়েছিলো যে সুলাইমান (আঃ) নবী ছিলেন না, বরং যাদুকর ছিলেন। এই কারণেই উপরোক্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ্র সত্য নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্য এক সত্য নবী সুলায়মান (আঃ) কে কালিমা মুক্ত করেন এবং ইয়াহুদীদের বদ ‘আক্বীদার অসারতা ঘোষণা করেন। তারা সুলায়মান (আঃ)-এর নাম নবীদের নামের তালিকাভুক্ত শুনে ক্রোধে জ্বলে উঠতো। এজন্যই এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এটাও একটা কারণ যে সুলাইমান (আঃ) কষ্টদায়ক প্রাণী হতে কষ্ট না দেয়ায় অঙ্গীকার নিয়েছেন। তাদেরকে ঐ অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেই তারা কষ্ট দেয়া হতে বিরত থাকতো। অতঃপর জনগণ নিজেরাই কথা বানিয়ে নিয়ে যাদু মন্ত্র ইত্যাদি সম্বন্ধ সুলাইমান (আঃ) এর সাথে লাগিয়ে দেন। এরই অসারতা এই পবিত্র আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
এখানে على শব্দটি فى এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে কিংবা تتلوا শব্দটি تكذب এর অন্তর্ভুক্ত। আর এটাই উত্তম। মহান আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন।
সুলাইমান (আঃ)-এর সময়েও যাদু ছিলো
সুদ্দী (রহঃ) বলেন ‘সুলাইমান (আঃ)-এর রাজত্বকালে শয়তানরা যা আবৃত্তি করতো, তারা তারই অনুসরণ করছে’ এর বর্ণনায় জানা যায়ঃ সুলাইমান (আঃ) এর রাজত্বকালের পূর্বে শয়তানরা আকাশে উঠে যেতো এবং পৃথিবীতে কার কখন মৃত্যু হবে, কোন ঘটনা সংঘটিত হবে ইত্যাদি অজানা গোপনীয় ব্যাপারে যখন ফিরিশতা আলাপ করতো শয়তান তা তাদের কাছ থেকে চুরি করে শুনে নিতো। পরে শয়তান ঐ বিষয় গণকদের কাছে বলে দিতো এবং গণকরা আবার লোকদের কাছে বলে বেড়াতো। লোকেরাও গণকদের কথা সত্য বলে মেনে নিতো ও বিশ্বাস করতো। গণকরা যখন শয়তানদের বিশ্বাস করতো তখন শয়তানরা সত্য ঘটনার সাথে আরো নানা মিথ্যা কথা যোগ করে গণকদের কাছে বলতো, এমন কি একটি সত্যের সাথে সত্তরটি মিথ্যা যোগ করতো। লোকেরা এসব কথা তাদের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করতে থাকে। পরবর্তীতে বানী ইসরাঈলরা বলতে শুরু করে যে, জ্বিনেরা গাইবের খবর জানে। সুলাইমান (আঃ) নবুওয়াত প্রাপ্ত হওয়ার পর ঐ সমস্ত গ্রন্থ সংগ্রহ করে একটি বাক্সে ভর্তি করে তাঁর সিংহাসনের নিচে মাটিতে পুঁতে রাখেন। যদি কোন শয়তান ঐ বাক্সের কাছে যেতে চেষ্টা করতো তাহলে সে পুড়ে মৃত্যু বরণ করতো। সুলাইমান (আঃ) বলতেনঃ আমি যেন কারো কাছ থেকে না শুনি যে, জ্বিন বা শয়তানরা গাইবের খবর জানে; যে বলবে তার শিরচ্ছেদ করা হবে। সুলাইমান (আঃ) এর মৃত্যুর পর এবং যে জ্ঞানী ব্যক্তিগণ সুলাইমান (আঃ) এর সঠিক বাণী জানতো তাদেরও মৃত্যুর পর নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব হয়। জ্বিন শয়তান মানুষের বেশ ধারণ করে বানী ইসরাইলের কাছে এসে বললোঃ আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ধন-ভাণ্ডারের কথা জানাবো না যা প্রাপ্ত হয়ে কাজে লাগালে কখনো নিঃশেষ হবে না? তারা বললোঃ অবশ্যই বলবে! জ্বিন শয়তান বললোঃ সুলাইমান (আঃ) এর সিংহাসনের নীচের দিকটি খনন করো। সে তাদেরকে সুলাইমান (আঃ)-এর সিংহাসনের জায়গাটি দেখিয়ে দিলো। তারা বললোঃ তুমিও আমাদের সাথে চলো। সে বললোঃ না, বরং তোমাদের জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করবো খনন করে তোমরা যদি ধন-ভাণ্ডার না পাও তখন আমাকে হত্যা করো। তারা মাটি খনন করে পুঁতে রাখা গ্রন্থগুলো খুঁজে পেলো। শয়তান তাদেরকে বললোঃ এই গ্রন্থগুলোতে যা লিখা আছে তা দিয়ে সুলাইমান (আঃ) মানুষ, জ্বিন ও পাখিদের নিয়ন্ত্রন করতেন। এরপর লোকদের মাঝে এ কথা প্রচার লাভ করে যে, সুলাইমান (আঃ) যাদু জানতেন। বানী ইসরাঈলরা ঐ গ্রন্থগুলো অনুসরণ করতে শুরু করলো। নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আগমনের পর ইয়াহুদীরা ঐ গ্রন্থগুলোর ওপর ভিত্তি করে তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। তাই মহান আল্লাহ বলেনঃ
وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَكِنَّ الشَّيْاطِيْنَ كَفَرُوْا
‘মূলত সুলায়মান কুফরী করেনি বরং শায়তানেরাই কুফরী করেছিলো।’ (তাফসীর তাবারী ২/৪০৫)
হাসান বসরী (রহঃ) এর উক্তি আছে যে, যাদু সুলায়মান (আঃ) এর পূর্বেও ছিলো। এটা সম্পূর্ণ সত্য কথা। সুলায়মান (আঃ)-এর যুগে যাদুকরদের বিদ্যমানতা কুর’আন মাজীদ দ্বারাই সাব্যস্ত হয়েছে এবং সুলায়মান (আঃ)-এর আগমন মূসা (আঃ)এর পরে হওয়াও কুর’আনুল কারীম দ্বারাই প্রকাশ পেয়েছে। দাউদ (আঃ) ও জালুতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে من بعد موسى অর্থাৎ মূসা (আঃ) এর পরে। এমনকি ইবরাহীম (আঃ) এরও পূর্বে সালিহ (আঃ)-কে তাঁর কাওম বলেছিলোঃ إنما أنت من المسحرين ‘তুমি যাদুকৃত লোকদের অন্তর্ভুক্ত।’ (২৬ঃ ১৮৫)
হারূত-মারূতের ঘটনা
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
﴿وَ مَاۤ اُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَیْنِ بِبَابِلَ هَارُوْتَ وَ مَارُوْتَ١ؕ وَ مَا یُعَلِّمٰنِ مِنْ اَحَدٍ حَتّٰى یَقُوْلَاۤ اِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ١ؕ فَیَتَعَلَّمُوْنَ مِنْهُمَا مَا یُفَرِّقُوْنَ بِهٖ بَیْنَ الْمَرْءِ وَ زَوْجِهٖ﴾
‘তারা লোকদেরকে যাদু বিদ্যা এবং যা বাবেল শহরে হারুত-মারুত ফেরেশতাদ্বয়ের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিলো তা শিক্ষা দিতো এবং তারা উভয়ে কাউকেও ওটা এ কথা না বলে শিক্ষা দিতো না যে, ‘আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছুই নই, অতএব তোমরা কুফরী করো না।’ অনন্তর তারা যাতে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয় তা তাদের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো।’
অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্নজন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন কেউ বলেছেন, وما انزل এর মধ্যস্থিত ما না বোধক। ইমাম কুরতুবী বলেন ما না বোধক এবং তা وما كفر سليمان এর معطوف । ভাবার্থ দ্বারাই এই যে, সুলায়মান (আঃ) কুফরী করেন নি আর দুই’ফেরেশতার ওপরও যাদু অবতীর্ণ করা হয় নি। এরপর তিনি দালীল স্বরূপ অত্র আয়াতাংশটি তুলে ধরেন যাতে মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
﴿وَ لٰكِنَّ الشَّیٰطِیْنَ كَفَرُوْا یُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ السِّحْرَ١ۗ وَ مَاۤ اُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَیْنِ﴾
‘কিন্তু শয়তানরা অবিশ্বাস করেছিলো, তারা লোকদেরকে যাদু শিক্ষা দিতো এবং বেবিলনে হারূত-মারুত এই দুই ফেরেশতার ওপর তা (যাদু) অবতীর্ণ হয় নি।’
ফেরেশতা দ্বয় যাদু দিয়ে পাঠানো হয়নি বলে ইয়াহুদীদের মিথ্যা দাবীকে খণ্ডন করা হয়েছে। কেননা ইয়াহূদীরা দাবী করতো যে, জিবরাঈল (আঃ) ও মিকাইল (আঃ) ফেরেশতা দ্বয়ই যাদু নিয়ে এসেছিলেন। অতএব তাদের দাবীকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করেন। আর হারূত ও মারূত এ দু’টি নামকে الشياطين থেকে বদল হিসেবে উল্লেখ করেন। আর এটাই সঠিকতার অধিক নিকটবর্তী। কেননা দুই বচনও বহুবচনের অন্তর্ভুক্ত। যেমন মহান আল্লাহ বলেন فان كان له اخوة ‘কিন্তু যদি তার ভাই-বোন থাকে’। (৪নং সূরা আন নিসা, আয়াত ১১) এখানে اخوة বহুবচন আনা হলেও সর্বনিম্ন দুইই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। অথবা এই দু’জনের আরো অনুসারী থাকার কারণেই الشياطين এর বদল মানা হয়েছে। আবার এ কারণেও তাদের দু’জনকে উল্লেখ করা হতে পারে যে, তারা দু’জন অন্যান্য শায়তানের চেয়ে বেশি বিদ্রোহী ছিলো। অতএব ইমাম কুরতুবী (রহঃ) এর মতে কুর’আনের উহ্য রূপ ছিলোঃ يعلمون الناس السحر( ببابل هاروت وماروت) অর্থাৎ বাবিল নগরীতে হারূত ও মারূত শায়তান দ্বয়ই মানুষকে যাদু শিক্ষা দিতো। অতঃপর ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, এটাই সর্বাধিক সঠিক এবং উত্তম। এ ছাড়া অন্য দিকে দৃষ্টিপাতের কোন সুযোগ নেয়। (তাফসীরে কুরতুবী ২/৫০)
ইমাম ইবনে জারীর (রহঃ) আল- ‘আওফি (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এ আয়াতের ভাবার্থে ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ মহান আল্লাহ যাদু অবতীর্ণ করে পাঠান নি। (তাফসীর তাবারী ২/৪১৯)
ইমাম ইবনে জারীর (রহঃ) বলেন, রাবী ‘ইবনে আনাস (রাঃ) বলেছেন যে, মহান আল্লাহ দুই ফিরিশতাকে যাদুসহ প্রেরণ করেন নি। ইবনে জারীর (রহঃ) বলেন যে, وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ এর এটাই সঠিক ব্যাখ্যা।
ইমাম ইবনে জারীর (রহঃ) আরো বলেন যে, وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَى مُلْكِ سُلَيْمَانَ এ আয়াতের ব্যাখ্যা হবেঃ সুলাইমান (আঃ) অবিশ্বাসী ছিলেন না এবং মহান আল্লাহও যাদুসহ হারূত ও মারূত নামের দুই ফিরিশতাকেও সুলাইমান (আঃ)-এর কাছে প্রেরণ করেন নি। বরং কাফির শায়তান বেবীলনের হারূত ও মারূতকে যাদু শিক্ষা দিতো এবং বলতো যে, জিবরাঈল (আঃ) ও মিকাইল (আঃ) এটা শিক্ষা দিয়েছেন। অভিশপ্ত ইয়াহুদী যাদুকররাও এই দাবী করতো যে, দাঊদ (আঃ) এর পুত্র সুলাইমান (আঃ)-কে জিবরাঈল (আঃ) এবং মিকাইল (আঃ) এর মাধ্যমে মহান আল্লাহ যাদু শিক্ষা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাদের এই মিথ্যা দাবী খণ্ডন করে তাঁর নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দিলেন যে, যাদুসহ জিবরাঈল (আঃ) ও মিকাইল (আঃ) ফেরেশতা দ্বয়কে প্রেরণ করা হয়নি।
মহান আল্লাহ সুলাইমান (আঃ)-কেও যাদু চর্চার অপবাদ থেকে মুক্ত করেন যে অপবাদে বলা হয়ে থাকে যে, ‘মহান আল্লাহ সুলাইমান (আঃ) কে ফেরেশতার মাধ্যমে যে যাদু শিক্ষা দিয়েছেন এ যাদুই অভিশপ্ত শায়তান বেবীলনের দুই লোকের মাধ্যমে শিক্ষা দিতো, যাদের নাম ছিলো হারূত ও মারূত। অতএব জানা গেলো যে, ‘যাদু শিক্ষা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ দু’জন ফেরেশতা পাঠিয়েছেন’ বলে যা বলা হয়ে থাকে তাও সত্য নয়। যে যাদু দুই লোকের দ্বারা বেবিলনের লোকদেরকে শয়তান শিক্ষা দিতো ঐ লোক দু’টির নাম ছিলো হারূত ও মারূত। অতএব বুঝা গেলো যে, হারূত ও মারূত ছিলো দু’জন সাধারণ লোক; তারা জিবরাঈল (আঃ), মিকাইল (আঃ) কিংবা অন্য কোন ফেরেশতা ছিলেন না। (তাফসীর তাবারী ২/৪১৯)
আব্দুর রহমান ইবনে আবুযা (রহঃ) ملكين এর পর দাউদ ও সুলায়মান (আঃ) কে বদল মানতেন। কিন্তু আবুল ‘আলিয়া বলেছেন যে, এভাবে কির’আত পড়া হলেও ما কে না বোধকই মানতে হবে। কেননা তারা দু’জনই ঈমান ও কুফরী কে স্পষ্ট ভাবে জানতেন। তারা এটাও জানতেন যে, যাদু বিদ্যা কুফরী। তাই তারা তার থেকে অন্যদের চেয়েও বেশি বিরত থাকবেন এমনটিই সঠিক।
আর ইমাম ইবনে জারীর (রহঃ) বলেন যে, এখানে ما শব্দটি الذى অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর হারুত ও মারুত দু’জন ফিরিশতা। তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন স্বীয় বান্দদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। তাদেরকে যাদু বিদ্যা শিক্ষা দিতে ঐ দু ফেরেশতাকে অনুমতি দিয়েছেন। তাই তারা মহান আল্লাহ্র সে আদেশ পালন করেছিলেন। একটি দুর্বল মত এটাও আছে যে এটা জ্বিনদের দু’টি গোত্র ملكين দু’ বাদশাহর কিরা’আতে انزل এর অর্থ হবে সৃষ্টি করা। যেমন আল্লাহ পাক বলেছেনঃ وانزل لكم من الانعام ثمانية ازواجِِ তিনি তাদের জন্য আট প্রকারের জন্তু সৃষ্টি করেছেন। (৩৯ঃ ৬) আরও বলেন وانزلنا الحديد অর্থাৎ আমি লোহা সৃষ্টি করেছি। (৫৭ঃ ২৫) হাদীসের মধ্যে ও انزال শব্দটি সৃষ্টি করার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমনঃ ما نزل الله داء الخ অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যত রোগ সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোর ঔষধও সৃষ্টি করেছেন। উপরোক্ত সব স্থানেই انزال শব্দটি সৃষ্টি করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, আনা বা অবতীর্ণ করা অর্থে নয়। তদ্রুপও আয়াতেও।
সালফে সালেহীনদের অনেকে বলেন যে, হারূত ও মারূত উভয়ে ফিরিশতা ছিলেন এবং তারা পৃথিবীতে অবতরণ করার পর আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী তাদের যা করার তা করেন। ফেরেশতা যে ভুল ভ্রান্তি থেকে মুক্ত এই মতামতের পিছনে তাদের যুক্তি দেয়া যেতে পারে এই যে, মহান আল্লাহও জানতেন যে, এই দুই ফেরেশতা কি করবেন যেমন তিনি জানতেন অন্যান্য ফেরেশতা আদম (আঃ) কে সিজদা করার সময় ইবলীসের আচরণ কিরূপ হবে। মহান আল্লাহ ইবলীসকে ফেরেশতার অন্তর্ভুক্ত করে আয়াত নাযিল করেনঃ ﴿وَ اِذْ قُلْنَا لِلْمَلٰٓىِٕكَةِ اسْجُدُوْا لِاٰدَمَ فَسَجَدُوْۤا اِلَّاۤ اِبْلِیْسَ١ؕ اَبٰى﴾
‘স্মরণ করো, যখন আমি ফেরেশতাকে বললামঃ আদম (আঃ)-এর প্রতি সিজদা করো, তখন ইবলীস ছাড়া সবাই সিজদা করলো; সে অমান্য করলো।’ (২০ নং সূরা ত্বা-হা, আয়াত নং ১১৬)
অতএব এ প্রশ্ন করার আর সুযোগ থাকলো না যে, সিজদাগণ তো নিস্পাপ। তাদের দ্বারা তো পাপ কার্য হতেই পারে না। আর জনগণকে যাদু শিক্ষা দেয়া তো একটি কুফরী কাজ। কেননা এ দু’জন ফেরেশতা সাধারণ ফেরেশতা হতে পৃথক হয়ে যাবে। যেমন ইবলীস পৃথক হয়েছে। ‘আলী (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ), ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ), ইবনে ‘উমার (রাঃ), কা‘বুল আহবার (রাঃ) সাদ্দি (রহঃ) এবং কালবী (রহঃ) ও এটাই বলেন।
‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছেনঃ যখন আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ) কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন এবং তার সন্তানেরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর তারা মহান আল্লাহ্র নাফরমানী করতে থাকে। তখন ফেরেশতাগণ পরস্পর বলাবলি করে দেখো এরা কত দুষ্টু প্রকৃতির লোক এবং এরা কতোই না অবাধ্য জাতি। আমরা এদের স্থলে থাকলে কখনো মহান আল্লাহ্র অবাধ্য হতাম না। তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে বলেন। তোমরা তোমাদের মধ্য হতে দু’জন ফেরেশতাকে নিয়ে এসো। আমি তাদের মধ্যে মানবীয় প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তার পরে দেখা যাক তারা কি করে। তারা তখন হারুত ও মারুত কে হাযির করেন। মহান আল্লাহ তাদের মধ্যে মানবীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে তাদেরকে বলেন, দেখো বানী আদমের নিকট তো নবীদের মাধ্যমে আমরা আহকাম পৌঁছিয়ে থাকি। কিন্তু তোমাদেরকে মাধ্যম ছাড়াই স্বয়ং আমি বলে দিচ্ছি, যে তোমরা আমার সাথে কাউকে ও অংশীদার স্থাপন করবে না, ব্যভিচার করবে না এবং মদ্যপানও করবে না।
তখন তারা দু’জন পৃথিবীতে অবতরণ করে। তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মহান আল্লাহ জোহরাকে একটি সুন্দরী নারীর আকারে তাদের নিকট পাঠিয়ে দেন। তারা তাকে দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ে এবং তার সাথে ব্যভিচার করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সে বলে তোমরা শিরক করলে আমি সম্মত আছি। তারা উত্তর দেয় দেয় যে, এটা আমাদের দ্বারা হবে না। আবার সে এসে বলে, তোমরা যদি এই শিশুটিকে হত্যা করো, তবে আমি তোমাদের মনোবাসনা পূর্ণ করতে সম্মত হবো। তারা এটাও প্রত্যাখ্যান করে। সে আবার আসে এবং বলে আচ্ছা এই মদ পান করে নাও। তারা এটাকে ছোট পাপ মনে করে। তাতে সম্মত হয়ে যায়। এখন তারা নেশায় উন্মত্ত হয়ে ব্যভিচার করে বসে। তাদের চৈতন্য ফিরে আসলে ঐ স্ত্রী লোকটি তাদেরকে বলে যে, যে কাজ করতে তোমরা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলে তার সবই করে ফেলেছো। তারা তখন লজ্জিত হয়ে যায়। তাদেরকে দুনিয়ার শাস্তি অথবা আখিরাতের শাস্তির যে কোন একটি গ্রহণ করার অধিকার দেয়া হয়। তারা দুনিয়ার শাস্তি পছন্দ করেন। সহীহ ইবনে হিব্বান মুসনাদ আহমাদ তাফসীর ইবনে মিরদুওয়াই এবং তাফসীর ইবনে জারীরের মধ্যে এ হাদীসটি বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত আছে। মুসনাদ আহমাদের এ বর্ণনাটি গরীব। এর মধ্যে একজন বর্ণনাকারী মূসা ইবনে যুবাইর আনসারী রয়েছেন, ইবনে আবি হাতিম (রহঃ) এর মতে সে নির্ভরযোগ্য নয়।
তাফসীর ইবনে মিরদুওয়াই এর মধ্যে একটি বর্ণনায় এটাও রয়েছে যে, একবার রাতে ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রাঃ) নাফি‘ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, যুহরা তারকাটি বের হয়েছে কি? তিনি বলেন না, দু’ তিনবার প্রশ্নের পর বলেন, এখন উদিত হয়েছে। ‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রাঃ) তখন বলেন সে যেন খুশিও না হয় এবং আনন্দিতও যেন না হয়। নাফি‘ (রাঃ) তখন তাকে বললেন, জনাব একটি তারকা যা মহান আল্লাহ্র নির্দেশক্রমে উদিত ও অস্তমিত হয়, তাকে আপনি মন্দ বলেন? তিনি তখন বলেন তবে শোন, আমি ঔ কথায় বলছি যা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট হতে শুনেছি। তারপর উল্লিখিত হাদীসটি শব্দের বিভিন্নতার সাথে বর্ণনা করেন। কিন্তু এটাও গরীব ও দুর্বল। কা‘ব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটি মারফূ‘ হওয়া অপেক্ষা মাওকূফ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সম্ভবত এটা ইসরাইলি বর্ণনাই হবে। মহান আল্লাহই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন। সাহাবী এবং তাবি‘ঈন থেকে এ ধরনের বহু বর্ণনা করা হয়েছে।
কেউ কেউ বলেন যে, জোহরা একজন স্ত্রী লোক ছিল। সে ফেরেশতাদের সাথে শর্ত করে বলেছিলো, তোমরা আমাকে ঐ দু‘আটি শিখিয়ে দাও, যা পড়ে তোমরা আকাশে উঠে থাকো। তারা তাকে তা শিখিয়ে দেয়। সে এটা পড়ে আকাশে উঠে যায় এবং তথায় তাকে তারকায় রূপান্তরিত করা হয়। কতোগুলো মারফূ‘ বর্ণনায়ও এরূপ আছে, কিন্তু তা মুনকাতা‘ বা সনদের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন ও বেঠিক।
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, এ ঘটনার পূর্বে তো ফেরেশতাগণ শুধুমাত্র মু’মিনদের জন্যই ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। কিন্তু এরপর তারা সারা দুনিয়াবাসীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে আরম্ভ করেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, যখন এই ফেরেশতা দ্বয় হতেও অবাধ্যতা প্রকাশ পায় তখন অন্যান্য ফেরেশতাগণ স্বীকার করেন যে, বানী আদম মহান আল্লাহ্র দরবার হতে দূরে রয়েছে এবং তাকে না দেখেই ঈমান এনেছে। সুতরাং তাদের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ঐ ফেরেশতা দ্বয়কে বলা হয়, তোমরা দুনিয়ার শাস্তি গ্রহণ করে নাও অথবা পরকালের শাস্তির জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। তারা দু’জন পরামর্শ করে দুনিয়ার শাস্তি গ্রহণ করে। কেননা এটা অস্থায়ী এবং পরকালের শাস্তি চিরস্থায়ী। সুতরাং বাবেলে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে।
একটি বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে যে নির্দেশাবলী দিয়েছিলেন তাতে হত্যা ও অবৈধ মালের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিলো এবং এহুকুমও ছিলো যে, তারা যেন ন্যায়ের সাথে বিচার করে। এটাও এসেছে যে, তারা তিনজন ফেরেশতা ছিলো। কিন্তু একজন পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার জানিয়ে ফিরে যায়। অতঃপর দু’জনের পরীক্ষা নেয়া হয়। ইবনে ‘আব্বাস (রহঃ) বলেন যে, এটা সুলাইমান (আঃ) এর যুগের ঘটনা। এখানে বাবেল দ্বারা দুনিয়ায় অন্দের বাবেলকে বুঝানো হয়েছে। স্ত্রী লোকটির নাম ‘আরবী ভাষায় ‘যুহরা’ বানতী ভাষায় ‘বেদ খত’ এবং ফারসী ভাষায় ‘আনাহীদ’ ছিলো। এ স্ত্রী লোকটি তার স্বামীর বিরুদ্ধে একটি মোকাদ্দামা এনেছিলো। যখন তারা তার সাথে অসৎ কাজের ইচ্ছা করে তখন সে বলেঃ
যদি আগে আমাকে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে ফায়সালা দাও, তবে আমি সম্মত আছি। তারা তাই করে। পুনরায় সে বলে, তোমরা যা পড়ে আকাশে উঠে থাকো ও যা পড়ে নিচে নেমে আসো সেটাও আমাকে শিখিয়ে দাও। তারা সেটাও তাকে শিখিয়ে দেয়। সে সেটা পাঠ করে আকাশে উঠে যায়। কিন্তু নিচে নেমে আসার দু‘আ ভুলে যায়। সেখানেই তার দেহকে তারকায় রূপান্তরিত করা হয়।
‘আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার (রাঃ) কখনো যুহরা তারকা দেখলে তাকে অভিশাপ দিতেন। যখন এই ফেরেশতারা আকাশে উড়তে চাইলো কিন্তু উঠতে পারলো না, তখন তারা বুঝে নিলো যে, এখন তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন যে প্রথম দিকে কিছুদিন এই ফেরেশতারা স্থিরই ছিলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ন্যায়ের সাথে বিচার করতো এবং সন্ধ্যার পর আকাশে উঠে যেতো। অতঃপর যুহরাকে দেখে নিজেদের নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যুহরা তারকাকে একটি সুন্দরী স্ত্রী আকৃতিকে তাদের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। মোট কথা হারুত ও মারুতের এ ঘটনা তাবি‘ঈগণের মধ্য থেকেও বহু লোক বর্ণনা করেছেন। যেমন মুজাহিদ (রহঃ), সুদ্দী (রহঃ), হাসান বাসরী (রহঃ), মুকাতিল ইবনে হিব্বান (রহঃ) সহ প্রভৃতি। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মুফাসসিরুন ও নিজ নিজ তাফসীরের কিতাবসমূহে এটা এনেছেন। কিন্তু এর অধিকাংশই বানী ইসরাইলের কিতাবসমূহের উপর নির্ভরশীল। এ সব বিষয়ে কোন সহীহ মারফূ‘ মুক্তাসিল হাদীস রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে প্রমাণিত নেই। আবার কুর‘আন হাদীসের মধ্যেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যাও নেই। সুতরাং আমাদের ঈমান তার ওপরেই রয়েছে। যেটুকু কুর’আন মাজীদে আছে সেটাই সঠিক। আর প্রকৃত অবস্থা একমাত্র মহান আল্লাহই জানেন।
তাফসীর ইবনে জারীরের মধ্যে একটি দুর্বল হাদীসে বিশেষ একটি বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এর প্রতি সতর্ক করা উত্তম মনে করেই ঘটনাটি এখানে আলোকপাত করলাম। উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ্ সিদ্দীকা (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তেকাল করার অল্প কিছুদিন পরেই ‘দাওলাতুল জান্দাল’ হতে একজন মহিলা লোক আগমন করে তাঁর খোঁজ করে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর সংবাদ মহিলাকে দেয়া হলে সে উদ্বিগ্ন হয়ে কাঁদতে থাকে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি? সে বললোঃ আমার মধ্যে ও আমার স্বামীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ প্রায় লেগেই থাকতো। একবার সে আমাকে ছেড়ে কোনো অজানা জায়গায় চলে যায়। একটি বৃদ্ধের নিকট আমি এসব কিছু বর্ণনা করলাম। সে আমাকে বললো, তোমাকে যা বলি তাই করো, সে আপনা আপনিই চলে আসবে। আমি প্রস্তুত হয়ে গেলাম। রাতে সে দু’টি কুকুর নিয়ে আমার নিকট আগমন করলো। যার একটির ওপর সে আরোহণ করলো এবং অপরটির ওপর আমি আরোহণ করলাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা দু’জন বাবেলে চলে যাই। তথায় গিয়ে দেখি যে দুটি লোক জিঞ্জিরা বদ্ধ অবস্থায় লটকানো রয়েছে। ঐ বৃদ্ধ আমাকে বললো তাদের নিকটে যাও এবং বলো আমি যাদু শিখতে এসেছি। আমি গিয়ে তাদেরকে একথা বললাম। তারা বললো জেনে রাখো, আমরা তো পরীক্ষার মধ্যে রয়েছি। তুমি যাদু শিক্ষা করো না যাদু শিক্ষা করা কুফরী। আমি বললাম, তবুও আমি শিখবো। তারা বলে আচ্ছা তাহলে যাও ঐ চুল্লির মধ্যে প্রস্রাব করে চলে আসো। আমি গিয়ে প্রস্রাবের ইচ্ছা করি কিন্তু আমার অন্তরে কিছুটা ভয়ের সঞ্চার হয়। সুতরাং আমি ফিরে এসে বললাম, আমি কাজ সেরে এসেছি। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি দেখলে? আমি বললাম, কিছুই তো দেখলাম না। তারা বললো তুমি ভুল বলেছো। এখন পর্যন্ত তুমি বিপথে পরিচালিত হওনি। তোমার ঈমান ঠিক আছে, তুমি এখনো ফিরে যাও এবং কুফরী করো না। সুতরাং আমি ফিরে আসি। আবার এভাবেই প্রশ্ন ও উত্তর হয়। পুনরায় আমি চুল্লির নিকট যাই এবং মনকে শক্ত করে প্রস্রাব করতে বসে পরি। আমি দেখি যে, একজন ঘোড়া সাওয়ারী মুখের ওপর পর্দা ফেলে আকাশের ওপরে উঠে গেলো, আমি তখন ফিরে এসে তাদের নিকট এ ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তারা বললো, হ্যাঁ। এবার তুমি সত্য বলেছো, সেটা তোমার ঈমান ছিলো, যা তোমার মধ্য হতে বেরিয়ে গেলো। এখন চলে যাও। আমি এসে ঐ বৃদ্ধকে বললাম, তারা তো আমাকে কিছুই শিক্ষা দিলো না। সে বললো, যথেষ্ট হয়েছে। তোমার নিকট সবই চলে এসেছে। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি পরীক্ষামূলকভাবে একটি গমের দানা নিয়ে মাটিতে ফেলে দেই। অতঃপর বলি গাছ হও। সাথে সাথে সেটা গাছ হয়ে যায়। আমি বললাম, তোমার ডাল পাতা গজিয়ে যাক। তাই হয়ে গেলো। তার পর বললাম, শুকিয়ে যাও। আর তৎক্ষণাৎ ডাল পাতা শুকিয়ে গেলো। অতঃপর বললাম, পৃথকভাবে দানা হয়ে যাও। সেটা তাই হয়ে গেলো। তারপরে আমি বললাম, শুকিয়ে যাও। সেটা শুকিয়ে গেলো, অতঃপর বলি আটা হয়ে যাও। সাথে সাথে তা আটা হয়ে গেলো। আমি বললাম, রুটি হয়ে যাও। তৎক্ষণাৎ রুটি হয়ে গেলো। এটা দেখেই আমি লজ্জিত হয়ে যাই এবং ঈমান হারা হয়ে যাওয়ার কারণে আমার খুবই দুঃখ হয়। হে উম্মুল মু’মিনন! মহান আল্লাহ্র শপথ আমি যাদু দ্বারা কোন কাজও নেইনি এবং কারো ওপর এটা প্রয়োগও করিনি।
এভাবে কাঁদতে কাঁদতে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খিদমতে হাজির হওয়ার উদ্দেশ্যে এসেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত: তাকে পেলাম না। এখন আমি কি করবো? একথা বলেই সে পুনরায় কাঁদতে আরম্ভ করে এবং এতো কাঁদে যে সবারই মনে তার প্রতি দয়ার সঞ্চার হয়। তাকে যাতে ফাতাওয়া দেয়া যেতে পারে এ ব্যাপারে সাহাবীগণও খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। অবশেষে তারা বললেন, এখন এ ছাড়া আর কি হবে যে, তুমি এ কাজ করবে না। তাওবাহ করবে এবং মহান আল্লাহ্র নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। আর পিতামাতার খিদমত করবে। এই ইসনাদ সম্পূর্ণ সঠিক।
যাদুর প্রভাব
কেউ কেউ বলেন যে যাদুর বলে প্রকৃত জিনিসই পরিবর্তিত হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন যে, যাদুর বাস্তব কোন প্রভাব নেই, তবে দর্শকের শুধু এর ধারণা হয়ে থাকে মাত্র, প্রকৃত জিনিস যা ছিলো তাই থাকে। যেমন পবিত্র কুর’আনে রয়েছেঃ سحروا اعين الناس অথাৎ তারা মানুষের চোখে যাদু করে দিয়েছেন। (৭ নং সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত ১১৬) অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেনঃ
يُخَيَّلُ إِلَيْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ أَنَّهَا تَسْعَى অর্থাৎ মূসা (আঃ)-এর মনে এ ধারণা দেয়া হয়েছে যে, যেন ঐ সাপগুলো তাদের যাদুর বলে চলাফিরা করছে। (২০ নং সূরা ত্বা-হা, আয়াত ৬৬) এঘটনা আমরা জানতে পারলাম যে, অত্র আয়াতে বাবেল শব্দ দ্বারা ‘ইরাকের বাবেলকে বুঝানো হয়েছে। দুনিয়া অন্দের বাবেল নয়।
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমের একটি বর্ণনায় আছে যে, ‘আলী ইবনে আবূ তালিব (রাঃ) বাবেলের পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ‘আসরের সালাতের সময় হলে তিনি তথায় সালাত আদায় করলেন না। বরং বাবেলের সীমান্ত পার হয়ে সালাত পড়লেন। অতঃপর বললেন: আমার প্রিয় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে কবরস্থানে সালাত পড়তে নিষেধ করেছেন এবং বাবেলের ভূমিতেও সালাত পড়তে নিষেধ করেছেন। এটা অভিশপ্ত ভূমি। (সুনান আবূ দাউদ-১/৪৯০, সুনান বায়হাক্বী আল কুবরা ২/৪৫১, তামহীদ ৫/২১২,২১৩, ফাতহুল বারী প্রথম খণ্ড, ৬৩১ পৃষ্ঠা)
সুনান আবূ দাউদের মধ্যে এ হাদীসটি বর্ণিত আছে। ইমাম আবূ দাঊদ (রহঃ) এ হাদীসের ওপর কোন সমালোচনা করেননি। আর যে হাদীসটিকে ইমাম আবূ দাউদ (রহঃ) স্বীয় কিতাবে নিয়ে আসেন এবং তার সনদের ওপর নীরবতা অবলম্বন করেন ঐ হাদীসটি ইমাম সাহেবের মতে হাসান হয়ে থাকে। এর দ্বারা জানা গেলো যে, বাবেলের ভূমিতে সালাত পড়া মাকরুহ। (হাদীস সহীহ। সহীহুল বুখারী-১/৬৩১, তামহীদ-৫/২২৪) যেমন সামুদ সম্প্রদায়ের ভূমি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ لا تدخلوا على هؤلاء المعذبين إلا أن تكونوا باكين
‘এই সব শাস্তি প্রাপ্তদের বাস ভূমিতে যেয়ো না। যদি ঘটনা ক্রমে যেতেই হয়, তবে আল্লাহ্র ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে যাও। (সহীহুল বুখারী- ১/৪৩৩, উক্ত হাদীসে বলা হয়েছে যে,
فإن لم تكونوا باكين فلا تدخلوا عليهم لا يصيبكم ما أصابهم
যদি ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রবেশ না করো তাহলে আশংকা হয় যে, তোমাদেরকেও সেই বিপদ পেয়ে বসবে যা তাদের প্রতি পৌঁছে ছিলো)
আল্লাহ তা‘আলা হারুতও মারুতের মধ্যে ভালো মন্দ, কুফর ও ঈমানের জ্ঞান দিয়ে রেখেছিলেন বলে তারা কুফরীর দিকে গমনকারীদের উপদেশ দিতো। আর তাদেরকে সেটা হতে বিরত রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করতো। কিন্তু যখন কোনক্রমেই মানতো না তখন তাদেরকে যাদু বিদ্যা শিখিয়ে দিতো। ফলে তাদের ঈমানের আলো বিদায় নিতো এবং যাদু চলে আসতো। শয়তান তাদের বন্ধু হয়ে যেতো। ঈমান বিদায় নেয়ার পর মহান আল্লাহ্র অভিশাপ তাদের ওপর নেমে আসতো।
অতঃপর বলা হয়েছে, হারূত ও মারূত বলতেনঃ ‘আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছু নই, অতএব তোমরা কুফরী করো না।’ যা হোক, হারূত ও মারূত যে অপরাধ করেছেন বলে বলা হয় তা ছিলো অভিশপ্ত শয়তানের তুলনায় খুবই ছোট। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন, ‘আলী (রাঃ), ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ), ইবনে ‘উমার (রাঃ), কাব আল আহবার (রহঃ), সুদ্দী (রহঃ) এবং আল কালবী (রহঃ) অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসীর কুরতুবী ২/৫১)
যাদু শিক্ষা করা কুফরী কাজ
মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿ وَ مَا یُعَلِّمٰنِ مِنْ اَحَدٍ حَتّٰى یَقُوْلَاۤ اِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ ﴾
কিন্তু তারা উভয়ে এ কথা না বলে শিক্ষা দিতো না, ‘আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছু নই, অতএব তোমরা কুফরী করো না।
আবূ জা‘ফর আর-রাযী (রহঃ) রাবী‘ ইবনে আনাস (রাঃ) থেকে, তিনি কায়িস ইবনে ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে, তিনি ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যখন কোন লোক ঐ ফেরেশতাদ্বয়ের কাছে যাদু শেখার জন্য যেতো তখন তারা তাকে নিরুৎসাহিত করতো এবং বলতোঃ আমরাতো পরীক্ষাধীন আছি, অতএব তোমরা কুফরীতে পতিত হয়ো না। তারা জানতো যে, কোন কাজটি ভালো এবং কোন কাজটি মন্দ এবং কি কাজ করলে ঈমানদার হওয়া যায় ও কোন কাজ করলে মানুষ কুফুরীতে পতিত হয়। এরপরও যখন কোন মানুষ যাদু শেখার জন্য তাদের কাছে যেতো তখন তারা বলতো, তোমরা অমুক অমুক জায়গায় যাও। সেখানে যাওয়ার পর শয়তান তার সাথে দেখা করতো এবং যাদু শিক্ষা দিতো। যখন কোন ব্যক্তি যাদু শিক্ষা করতো তখন তার ঈমানের নূর অপসারিত হতো এবং তা আকাশে ভেসে বেড়াতে দেখতে পেতো। তখন সে বলতোঃ হায় আমার কপাল! আমিতো অভিশপ্ত হয়ে গেলাম! এখন আমার কি হবে? (তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/৩১২) এ আয়াতের তাফসীরে হাসান বাসরী (রহঃ) বলেন যে, মহান আল্লাহ ঐ মালাকদ্বয়কে যাদুসহ দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন পরীক্ষা হিসেবে যে, কে তাতে উত্তীর্ণ হয়। মহান আল্লাহ তাদের কাছ থেকে এ ওয়া‘দা নিয়েছিলেন যে, যাদু শিক্ষা দেয়ার পূর্বে তারা প্রথমেই বলে নিবে ‘আমরা তোমাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। অতএব তোমরা কুফরীতে পতিত হয়ো না।’ (তাফসীর ইবনে আবি হাতিম ১/৩১০) কাতাদাহ (রহঃ) বলেনঃ মহান আল্লাহ তাদের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, লোকদের কাছে এ কথা না বলে তারা যাদু শিক্ষা দিবেনাঃ আমরা পরীক্ষাধীন স্বরূপ, অতএব কুফরী করো না। (তাফসীর তাবারী ২/৪৪৩)
এ ছাড়া সুদ্দী (রহঃ) বলেনঃ যখন কোন ব্যক্তি ঐ ফেরেশতাদের কাছে যেতো তখন তারা উপদেশ দিতোঃ তোমরা কুফরী করো না, আমরা তো পরীক্ষাধীন। যদি ঐ লোক তাদের উপদেশ মানতে রাযী না হতো তাহলে তাকে বলা হতোঃ ঐ ছাইয়ের স্তুপের কাছে যাও এবং তাতে প্রস্রাব করো। তার ওপর প্রস্রাব করা হলে তার আলো অর্থাৎ ঐ লোকটির ঈমান চলে যেতো এবং ঈমানের জ্যোতি বিচ্ছুরিত হতে হতে আকাশে মিলিয়ে যেতো। অতঃপর কালো ধোঁয়া জাতীয় জিনিস পৃথিবীতে নেমে এসে তার কানের ভিতর এবং শরীরের অন্যান্য অংশে প্রবেশ করতো। ঐ কালো ধোঁয়ার মত জিনিস হলো মহান আল্লাহ্র ক্রোধ। এ সমস্ত ঘটনা ফেরেশতাদ্বয়কে জানানোর পর তারা যাদু শিক্ষা দিতো। তাই মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা উভয়ে কাউকেও সেটা শিক্ষা দিতো না এটা না বলে যে, আমরা পরীক্ষাধীন ছাড়া কিছু নই, অতএব তোমরা কুফরী করো না।’ (তাফসীর তাবারী ২/৪৪৩)
ইবনে জুরাইজ (রহঃ) এই আয়াতের বিশ্লেষণে বলেনঃ বেঈমান ছাড়া কেউ যাদু শিক্ষা করে না। ‘ফিতনা’ হলো পরীক্ষা এবং পছন্দ করার স্বাধীনতা। (তাফসীর তাবারী ২/৪৪৩) যেমন মহান আল্লাহ মূসা (আঃ) সম্পর্কে সংবাদ দিয়ে বলেনঃ ﴿اِنْ هِیَ اِلَّا فِتْنَتُكَ تُضِلُّ بِهَا مَنْ تَشَآءُ وَ تَهْدِیْ مَنْ تَشَآءُ﴾
‘এটা তো কেবল তোমার পরীক্ষা, যাকে চাও তা দ্বারা পথভ্রষ্ট করো, আর যাকে চাও সত্য পথে পরিচালিত করো।’ যাদু শিক্ষা করাকে যারা কুফরী করা বলে থাকেন তারা এ আয়াতের আলোকেই বলেন। তারা ঐ হাদীসেরও উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন যা আবু বাকর আল বাযযার (রহঃ) ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
من أتى كاهنًا أو ساحرًا فصدقه بما يقول، فقد كفر بما أنزل على محمد صلى الله عليه وسلم.
‘যে ব্যক্তি কোন ভবিষ্যত বক্তা কিংবা যাদুকরের কাছে গেলো এবং সে যা বললো তা বিশ্বাস করলো, সে যেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করলো। (হাদীসটি সহীহ। সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী-৮/১৩৬, আল মাজমা ‘উয যাওয়ায়েদ -৫/১১৮, কাশফ আল-আশতার ২/৪৪৩)
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো হয় যাদুর মাধ্যমে
অতঃপর মহান আল্লাহ্র বাণীঃ ﴿فَیَتَعَلَّمُوْنَ مِنْهُمَا مَایُفَرِّقُوْنَ بِه بَیْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِه﴾
‘এতদসত্ত্বেও তারা উভয়ের নিকট থেকে এমন জিনিস শিক্ষা করতো, যা দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করতো।’ অর্থাৎ মানুষেরা হারূত ও মারূতের কাছে গিয়ে যাদু বিদ্যা শিক্ষা করতো। ফলে তারা খারাপ কাজ করতো এবং স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যেতো। সহীহ মুসলিমে আছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
"إن الشيطان ليضع عرشه على الماء، ثم يبعث سراياه في الناس، فأقربهم عنده منزلة أعظمهم عنده فتنة، يجيء أحدهم فيقول: ما زلت بفلان حتى تركته وهو يقول كذا وكذا. فيقول إبليس: لا والله ما صنعت شيئًا. ويجيء أحدهم فيقول: ما تركته حتى فرقت بينه وبين أهله قال: فيقربه ويدنيه ويلتزمه، ويقول: نِعْم أنت
‘শয়তান তার সিংহাসনটি পানির ওপর রাখে। অতঃপর মানুষকে বিপথে চালানোর জন্য সে তার সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়। সে ব্যক্তিই তার নিকট সবচেয়ে সম্মানিত যে হাঙ্গামা সৃষ্টির কাজে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যায়। এরা ফিরে এসে নিজেদের জঘন্যতম কার্যাবলীর বর্ণনা দেয়। কেউ বলেঃ ‘আমি অমুককে এভাবে পথভ্রষ্ট করেছি।’ কেউ বলেঃ ‘আমি অমুক ব্যক্তিকে এ পাপকাজ করিয়েছি।’ শয়তান তাদেরকে বলেঃ ‘তোমরা কিছুই করোনি। এতো সাধারণ কাজ।’ অবশেষে একজন এসে বলেঃ ‘আমি একটি লোক ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছি, এমনকি তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে।’ শয়তান তখন তার কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে বলেঃ ‘হ্যাঁ, তুমি উত্তম কাজ করেছো।’ (হাদীসটি সহীহ। সহীহ মুসলিম ৪/২১৬৭, মুসনাদে আহমাদ-৩/৩১৪, ৩১৫)
যাদুকরও তার যাদুর দ্বারা ঐ কাজই করে থাকে, যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদের সৃষ্টি হয়। যেমন তার কাছে স্ত্রীর আকৃতি খারাপ মনে হবে কিংবা তার স্বভাব চরিত্রকে সে ঘৃণা করবে অথবা অন্তরে শত্রুতার ভাব জেগে যাবে ইত্যাদি। আস্তে আস্তে এসব বৃদ্ধি পাবে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে।
মহান আল্লাহ্র নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটবেই অথবা ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা একমাত্র মহান আল্লাহ্র তিনি ব্যতীত অন্য কারো এমন ক্ষমতা নেই
অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ ﴿وَمَا هُمْ بِضَآرِّیْنَ بِهٖ مِنْ اَحَدٍ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ ﴾
‘মূলত তারা তাদের এ কাজ দ্বারা মহান আল্লাহ্ বিনা হুকুমে কারো ক্ষতি করতে পারতো না।’ অর্থাৎ ক্ষতি সাধন করা তাদের ক্ষমতার মধ্যেই নেই। মহান আল্লাহ্র ভাগ্য লিখন অনুযায়ী তার ক্ষতিও হতে পারে, আবার তাঁর ইচ্ছা হলে যাদু নিষ্ক্রিয়ও হতে পারে। ভাবার্থ এও হতে পারে যে, যাদু শুধুমাত্র ঐ ব্যক্তিরই ক্ষতি করে থাকে, যে তা শিক্ষা লাভ করে তার মধ্যে প্রবেশ করে।
এরপর মহান আল্লাহ বলেন, وَ یَتَعَلَّمُوْنَ مَا یَضُرُّهُمْ وَ لَا یَنْفَعُهُمْ ‘তারা এমন জিনিস শিক্ষা করে যা তাদের জন্য শুধুই ক্ষতিকারক, যার মধ্যে মোটেই উপকার নেই।’ আর ঐ ইয়াহুদীরা জানে যে, وَ لَقَدْ عَلِمُوْا لَمَنِ اشْتَرٰىهُ مَا لَهٗ فِی الْاٰخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ ‘যারা মহান আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর আনুগত্য ছেড়ে যাদুর পিছনে লেগে থাকে তাদের জন্য আখিরাতের কোনই অংশ নেই। তাদের না আছে মহান আল্লাহ্র কাছে কোন সম্মান, আর না তাদেরকে ধর্মভীরু মনে করা হয়।’ অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهۤ اَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوْا یَعْلَمُوْنَ. وَ لَوْ اَنَّهُمْ اٰمَنُوْا وَ اتَّقَوْا لَمَثُوْبَةٌ مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِ خَیْرٌ لَوْ كَانُوْا یَعْلَمُوْنَ﴾
‘আর যার পরিবর্তে তারা স্বীয় আত্মাগুলোকে বিক্রয় করেছে, তা কতোই না জঘন্য, যদি তারা জানতো!’ আর যদি তারা ঈমান আনতো এবং মুত্তাক্বী হতো তবে মহান আল্লাহ্ নিকট শ্রেষ্ঠতর সুফল ছিলো, যদি তারা জানতো!’ অর্থাৎ তারা যদি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনতো এবং মহান আল্লাহ্র নিষিদ্ধ কার্যাবলী থেকে বিরত থাকতো তাহলে তা নিঃসন্দেহে তাদের জন্য কল্যাণজনক ছিলো। যা তারা নিজের জন্য নির্বাচন করে এবং যার প্রতি তারা সন্তুষ্ট থাকে এমন সব বিষয়ের মধ্যে এটাই ছিলো তাদের জন্য অধিক সাওয়াবের কাজ। যেমন অন্য জায়াগয় মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿وَ قَالَ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ وَیْلَكُمْ ثَوَابُ اللّٰهِ خَیْرٌ لِّمَنْ اٰمَنَ وَ عَمِلَ صَالِحًا١ۚ وَ لَا یُلَقّٰىهَاۤ اِلَّا الصّٰبِرُوْنَ﴾
‘যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিলো তারা বললোঃ ধিক্ তোমাদেরকে! ‘যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে তাদের জন্য মহান আল্লাহ্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ এবং ধৈর্যশীল ব্যতীত এটা কেউ পাবে না। (২৮ নং সূরা কাসাস, আয়াত নং ৮০)
যাদুকারীর হুকুম
وَلَوْ اَنَّهُمْ اٰمَنُوْا وَاتَّقَوْا ‘আর যদি তারা ঈমান আনতো এবং মুত্তাক্বী হতো’ অত্র আয়াতাংশের ভিত্তিতে যাদুকারীকে ও যাদু বিদ্যা শিক্ষার্থীকে কাফির বলা হয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ (রহঃ) ও পূর্ব যুগীয় মনীষীদের একটি দল এরূপই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আবার কেউ কেউ কাফির বলেন নি কিন্তু তার হদ হিসেবে হত্যা করার হুকম দিয়েছেন। যেমনটি ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) এবং আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহঃ) একটি সূত্রে বাজালাহ ইবনে ‘উবাইদ (রহঃ) বলেনঃ আমিরুল মু’মিনীন ‘উমার (রাঃ) তাঁর এক নির্দেশ নামায় লিখেছেনঃ ‘যাদুকর পুরুষ বা স্ত্রীকে তোমরা হত্যা করো।’ এ নির্দেশ অনুযায়ী আমরা তিনজন যাদুকরের গর্দান উড়িয়েছি।’ (হাদীসটি সহীহ। সহীহুল বুখারী ৩১৫৬, সুনান আবূ দাউদ ৩/৩০৪৩, মুসনাদ আহমাদ ১/১৯০, ফাতহুল বারী ৬/৩০১) ইমাম বুখারী (রহঃ)-ও স্বীয় সহীহুল বুখারীতে এমনটি উল্লেখ করেছেন। উম্মুল মু’মিনীন হাফসা (রাঃ) এর ওপর তাঁর দাসী যাদু করেছিলো বলে তাকে হত্যা করা হয়। (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ২/১৪/৮৭১, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ৮/১৩৬)
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহঃ) বলেন যে, তিনজন সাহাবী থেকে যাদুকরকে হত্যা করার ফাতাওয়া রয়েছে। জামি‘উত তিরমিযীর মধ্যে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ حد الساحر ضربة بالسيف
‘যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তরবারি দ্বারা হত্যা করা।’ (হাদীসটি য ‘ঈফ। জামি ‘তিরমিযী ৪/১৪৬০, মুসতাদরাক হাকিম ৪/৩৬০, সুনান দারাকুতনী ৩/১১৪, সিলসিলাতুয য ‘ইফা ১৪৪৬, ‘আল্লামা নাসিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেছেন যে, মাওকূফ হিসেবে সহীহ) এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী ইসমা ‘ঈল ইবনে মুসলিম দুর্বল। সঠিক কথা এটাই মনে হচ্ছে যে এ হাদীসটি মাওকূফ। কিন্তু তাবারানীর হাদীসের মধ্যে অন্য সনদেও এ হাদীসটি মারফূ ‘সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। মহান আল্লাহ্র সবচেয়ে বেশি জানেন।
ওয়ালীদ ইবনে ‘উকবার নিকট একজন যাদুকর ছিলো সে তার যাদু কার্য বাদশাহকে দেখাতো। সে প্রকাশ্যভাবে একটি লোকের মাথা কেটে নিতো। অতঃপর একটা শব্দ করতো, আর তখনই মাথা জোড়া লেগে যেতো। মুহাজির সাহাবীগণের মধ্যে একজন মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবী তা দেখতে পেয়ে পরের দিন তিনি তরবারী নিয়ে আসেন। যাদুকর খেলা আরম্ভ করার সাথে সাথেই তিনি স্বয়ং যাদুকরেরই মাথা কেটে ফেলেন এবং বলেন তুমি সত্যবাদী হলে নিজেই জীবিত হয়ে যাও। অতঃপর তিনি কুর’আন মাজীদের নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেনঃ أَفَتَأْتُونَ السِّحْرَ وَأَنْتُمْ تُبْصِرُونَ ‘তোমরা যাদুর নিকট যাচ্ছো ও তা দেখছো?’ (২১ নং সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৩) ঐ সাহাবী ওয়ালীদের নিকট থেকে তাকে হত্যা করার অনুমতি নেননি বলে বাদশাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হোন এবং শেষে তাকে ছেড়ে দেন। (সনদ সহীহ। মাওকূফ। মুসতাদরাক হাকিম-৪/৩৬১, সুনান দারাকুতনী-৩/১১৪, সুনান বায়হাক্বী-৮/১৩৬,আল ইসাবাহ-১/২৬১, তারিখুল বুখারী ১/২/২২২)
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) ‘উমার (রাঃ)-এর নির্দেশ ও হাফসার (রহঃ) ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন যে, ঐ হুকুম তখন কার্যকরী হবে যখন যাদুকরের মধ্যে শিরক যুক্ত শব্দ থাকবে। মহান আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন।
পরিচ্ছেদঃ মু‘তাযিলা সম্প্রদায় যাদুর অস্তিত্বই মানে না। তারা বলে যে যারা যাদুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, তারা কাফের । কিন্তু আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত যাদুর অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তারা স্বীকার করে যে যাদুকর তার যাদুর বলে বাতাসে উড়তে পারে, মানুষকে বাহ্যত মানুষ করে ফেলতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট কথাগুলো মন্ত্রতন্ত্র পড়ার সময় ঐ গুলো সৃষ্টিকারী হচ্ছেন মহান আল্লাহ। দার্শনিক, জোতির্বিদ এবং দ্বীনহীনরা তারকা ও আকাশকেই ফলাফল সৃষ্টিকারী মেনে থাকে। পক্ষান্তরে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত আকাশকে ও তারকাকে ফলাফল সৃষ্টিকারী মানে না।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের পক্ষে প্রথম দালীল হচ্ছে নিম্নের আয়াতটিঃ
وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ.
‘তারা কোন ক্ষতি করতে পারে না মহান আল্লাহ্র ইচ্ছা ব্যতীত।’ (২ নং সূরা আল বাকারাহ, আয়াত-১০৩) দ্বিতীয় দালীল হচ্ছে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর যাদু করা হয়েছিলো। তৃতীয় দালীল হচ্ছে ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বর্ণিত ঐ স্ত্রী লোকটির ঘটনা, যে বাবিল নগরীতে এসে যাদু শিক্ষাগ্রহণ করেছিলো। আর এ ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে।
যাদুর হুকম প্রসঙ্গে পঞ্চমতম মাস’আলা বা ইমাম রাযী (রহঃ)-এর দৃষ্টিভঙ্গি
ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন যে, ‘যাদু বিদ্যা লাভ করা দুষণীয় নয় এবং তা বর্জণীয়ও নয়।’ মাস’আলা বিশ্লেষণকারীগণের এটাই অভিমত। কেননা এটাও একটি বিদ্যা। আর মহান আল্লাহ বলেছেনঃ
قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
‘বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (৩৯ নং সূরা আয যুমার, আয়াত ৯) আর এ জন্যও যাদু বিদ্যা শিক্ষা দুষণীয় নয় যে, তার দ্বারা মু’জিযাহ ও যাদুর মধ্যে পূর্ণাঙ্গভাবে পার্থক্য করা যায় এবং মু‘জিযার জ্ঞান ওয়াজিব আর তা নির্ভর করে যাদু বিদ্যার ওপর যার দ্বারা পার্থক্য বুঝা যায়। তা কিভাবে হারাম ও দুষণীয় হতে পারে? সুতরাং যাদু বিদ্যা শিক্ষা করাও ওয়াজিব হয়ে গেলো।
ইমাম রাযী (রহঃ)-এর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর পর্যালোচনা
ইমাম রাযী (রহঃ) এর একথা বিভিন্ন কারণে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত পুরোটাই ভুল প্রমাণিত। আর এর প্রথম কারণ হলো, তাঁর উক্তি ‘যাদু বিদ্যা লাভ করা দুষণীয় নয়।’ বিবেক হিসেবে যদি এটাকে খারাপ না বলেন তবে ম‘তাযিলা সম্প্রদায়ে বিদ্যমান রয়েছে যারা এটাকে বিবেক হিসেবেও খারাপ বলে থাকে। দ্বিতীয়ত যদি শারী‘আতের দিক দিয়ে খারাপ না বলেন, তবে কুর’আন মাজীদের অত্র আয়াতটিই তাকে খারাপ বলার জন্য যথেষ্ট। সহীহ হাদীসে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
"من أتى عرافًا أو كاهنًا، فقد كفر بما أنزل على محمد".
‘যে ব্যক্তি কোন যাদুকর বা গণকের নিকট গমন করে সে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর নাযিলকৃত কুর’আনের সাথে কুফরী করলো।’ (হাদীসটি সহীহ। সহীহ মুসলিম-৪/১২৫/১৭৫১, মুসনাদে আহমাদ-২/৪২৯, সুনান বায়হাক্বী-৮/১৩৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৮, সহীহুল জামি ‘৫৯৩৯। সহীহ মুসলিমের বর্ণনাটি নিম্নরূপ من أتى عرافا فسأله عن شيئ لم تقبل له صلاة أربعين ليلة যে গণকের কাছে এসে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার চল্লিশ দিনের সালাত কবূল হবে না) আর সুনানের কিতাবে রয়েছে যেঃ "من عقد عقدة ونفث فيها فقد سحر"
‘যে একটি বন্ধন দিলো এবং তাতে ফুৎকার দিলো, সে যাদু করলো।’ (হাদীসটি য ‘ঈফ। সুনান নাসাঈ-৮/৪০৯০, আল কামিল-৪/২৪২, আত-তারগীব ওয়াত তারহীব-৪/৩২, য ‘ঈফুল জামি ৫৭১৪)
সুতরাং ইমাম রাযী (রহঃ) এর উক্তি সম্পূর্ণ ভুল। তাছাড়া তিনি যে বলেছেন, ‘যাদু বিদ্যা লাভ করা বর্জণীয়ও নয়। আর মুহাকিকগণের অভিমতও এটাই।’ তাঁর এ উক্তিটাও ঠিক নয়। মুহাকিকগণের এরূপ কথা কোথায় আছেঃ ইসলামের ইমামগণের মধ্যে কে এ কথা বলেছেন? অতঃপর মহান আল্লাহ্র বাণীঃ قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ
‘বলো, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান?’ (৩৯ নং সূরা আয যুমার, আয়াত ৯) এ আয়াতটিকে দালীল হিসেবে পেশ করা হঠকারিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা এ আয়াতের ‘ইলম এর ভাবার্থ হচ্ছে ধর্মীয় ‘ইলম। অত্র আয়াতে শরী‘আতের ‘আলিমগণের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। অতঃপর তার এ কথা বলা যে ‘এর দ্বারা মু‘জিযার ‘ইলম লাভ হয়।’ এটা একেবারে বাজে কথা। কেননা আমাদের রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সবচেয়ে বড় মু‘জিযা হচ্ছে পবিত্র কুর’আন, যা বাতিল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। মহান আল্লাহ বলেনঃ
لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ
‘মিথ্যা এর কাছে না এর সামনে দিয়ে আসতে পারে, না এর পিছন দিয়ে। এটা অবতীর্ণ হয়েছে মহাজ্ঞানী, সকল প্রশংসার যোগ্য মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে।’ (৪১ নং সূরা হা-মীম সাজদাহ, আয়াত-৪২)
অতএব তার মু‘জিযাহ জানা যাদু জানার ওপর নির্ভরলশীল নয়। ঐ সব লোক যাদের যাদুর সাথে দূরতম সম্পর্কেও নেই তারাও এটাকে মু‘জিযাহ বলে স্বীকার করেছেন। সাহাবীগণ, তাবি‘ঈগণ, ইমামগণ এমনকি সাধারণ মুসলমানগণ এমনটিই বিশ্বাস করে থাকেন। অথচ তাদের মধ্যে কেউ কখনোও যাদু জানা দূরের কথা এর কাছেই যান নি। তারা যাদু না নিজে শিখেছেন আর না অন্যকে এর শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁরা যাদু করেন নি বরং এসব কাজকে তারা কুফরী বলে ঘৃণা করেছেন।
যাদুর প্রকারভেদ প্রসঙ্গে বিবরণ
যাদু বিভিন্ন প্রকারের রয়েছে যা আবূ ‘আবদুল্লাহ ইমাম রাযী বর্ণনা করেছেন।
(১) প্রথম যাদু হচ্ছে তারকা পূজকদের পক্ষ থেকেঃ তারা সাতটি গতিশীল তারকার ওপর বিশ্বাস রাখে যে ভালো মন্দ ওদের কারণেই হয়ে থাকে। এ জন্য তারা কতগুলো নির্দিষ্ট শব্দ পাঠ করে তাদের পূজা করে থাকে। এ সম্প্রদায়ের মধ্যেই ইবরাহীম (আঃ) আগমন করেন এবং হিদায়াত করেন। ইমাম রাযী (রহঃ) এবিষয়ের ওপর একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং এর নাম كتاب السر المكتوم في مخاطبة الشمس والنجوم রেখেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, পরে তিনি এটা হতে তাওবাহ করেছেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে তিনি শুধু জানাবার জন্য এবং তার এই বিদ্যা প্রকাশ করার জন্যই এ গ্রন্থ লিখেছেন, এর প্রতি তার বিশ্বাস নেই কেননা এরা সরাসরি কুফরী।
(২) দ্বিতীয় যাদু হচ্ছে ধারণা শক্তির ওপর বিশ্বাসী লোকদের যাদুঃ ধারণা ও খেয়ালের বড় রকমের প্রভাব রয়েছে। যেমন একটি সংকীর্ণ সাঁকো মাটির উপর রেখে দিলে মানুষ অনায়াসেই তার ওপর দিয়ে চলতে পারে না। কেননা ধারণা হয় যে, এখনই তা পরে যাবে। ধারণার এই দুর্বলতার কারণেই যেটুকু জায়গায় ওপর দিয়ে চলতে পারছিলো ঐ জায়গার ওপর দিয়েই এরকম ভয়ের সময় চলতে পারে না। এ জন্যই বিজ্ঞ হেকিম ও ডাক্তারগণ ভীত লোককে লাল জিনিস দেখা হতে বিরত রাখেন এবং মৃগী রোগে আক্রান্ত লোককে খুব বেশি আলোকময় ও দ্রুত গতিসম্পন্ন জিনিস দেখতে নিষেধ করে থাকেন। এর দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, প্রকৃতির ওপর ধারণার একটা বিশেষ প্রভাব পড়ে থাকে। জ্ঞানীগণ এ বিষয়ে একমত যে নযর লেগে থাকে। সহীহ হাদীসেও এসেছে যেঃ "العين حَقّ، ولو كان شيء سَابِقَ القدر لسبقته العين"
‘নযর লাগা সত্য। ভাগ্যের ওপর যদি কোন জিনিস প্রাধান্য লাভকারী হতো তবে তা নযরই হতো।’ (সহীহুল বুখারী-১০/৫৭৪০, সহীহ মুসলিম-৪/৪২/১৭১৯) এখন যদি নাফস শক্ত হয় তবে বাহ্যিক সাহায্য ও বাহ্যিক কার্যের কোন প্রয়োজন নেই। আর যদি নাফস ততো শক্ত না হয় তবে ঐ সব যন্ত্রেরও প্রয়োজন হয়। নফ্সের যে পরিমাণ শক্তি বেড়ে যাবে সেই পরিমাণ আধ্যাত্মিক শক্তি বেড়ে যাবে এবং প্রভাবও বৃদ্ধি পাবে। আর যে পরিমাণ এ শক্তি কম হবে সে পরিমাণ আধ্যাত্মিক শক্তিও কমে যাবে। এ শক্তি কখনো কখনো খাদ্যের স্বল্পতা এবং জনগণের মেলামেশা ত্যাগ করার মাধ্যমে লাভ হয়ে থাকে। কখনো তো মানুষ এ শক্তির দ্বারা শরী‘আত অনুযায়ী পুণ্যের কাজ করে থাকে। শরী‘আতের পরিভাষায় একে ‘কারামত’ বলে, যাদু বলে না।
আবার কখনো কখনো মানুষ এ শক্তি দ্বারা বাতিল ও শরী‘আত পরিপন্থী কাজ করে থাকে এবং দ্বীন হতে বহু দূরে সরে পড়ে। এরকম লোকের ঐ অলৌকিক কার্যাবলী দেখে প্রতারিত হয়ে তাকে ওলী বলা কারো উচিত নয়। কেননা, যারা শারী‘আতের উল্টো কাজ করে তারা কখনো মহান আল্লাহ্র ওলী হতে পারে না। তা নাহলে সহীহ হাদীসসমূহে দাজ্জালদেরকে অভিশপ্ত ও দুষ্টু বলা হতো না। অথচ তারা বহু অলৌকিক কাজ করে দেখাবে।
(৩) তৃতীয় যাদু হচ্ছে জ্বিন প্রভৃতি পার্থিব আত্মাসমূহের দ্বারা সাহায্য প্রার্থনা করা। দার্শনিক ও মু ‘তাযিলীরা এটা স্বীকার করে না। কতোগুলো লোক এসব পার্থিব আত্মার মাধ্যমে কতোগুলো শব্দ ও কার্যের দ্বারা সম্পর্ক সৃষ্টি করে থাকে। একে মোহমন্ত্র ও প্রেতাত্মার যাদু বলা হয়।
(৪) চতুর্থ প্রকারের যাদু হচ্ছে ধারণা বদলিয়ে দেয়া, নযরবন্দ করা এবং প্রতারিত করা। যার ফলে প্রকৃত নিয়মের উল্টো কিছু দেখা যায়। কলাকৌশলের মাধ্যমে কার্য প্রদর্শনকারীকে দেখা যায় যে, সে প্রথমে একটা কাজ শুরু করে, যখন মানুষ একাগ্র চিত্তে তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং তার প্রতি সম্পুর্ণ নিমগ্ন হয়ে যায়, তখন তড়িৎ করে সে আর একটি কাজ আরম্ভ করে দেয়। যা মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থেকে যায়। তা দেখে তারা তখন হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। ফিরা ‘আউনের যাদুকরদের যাদু এ প্রকারেরই ছিলো। এ জন্যই পবিত্র কুর’আনে রয়েছেঃ
فَلَمَّا أَلْقَوْا سَحَرُوا أَعْيُنَ النَّاسِ وَاسْتَرْهَبُوهُمْ وَجَاءُوا بِسِحْرٍ عَظِيمٍ
‘যখন তারা বান ছুঁড়লো তখন লোকজনের চোখ যাদুগ্রস্থ হয়ে গেলো, তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। তারা বড়ই সাংঘাতিক এক যাদু দেখালো।’ (৭ নং সূরা আল আ ‘রাফ, আয়াত ১১৬) অন্য স্থানে রয়েছেঃ ﴿یُخَیَّلُ اِلَیْهِ مِنْ سِحْرِهِمْ اَنَّهَا تَسْعٰى﴾
‘মূসা (আঃ) এর মনে এ ধারনা দেয়া হচ্ছে যে ঐ সব লাঠি ও দড়ি যেন সাপ হয়ে চলাফেরা করছে।’ (২০ নং সূরা ত্বা-হা, আয়াত ৬৬) অথচ এরূপ ছিলো না। মহান আল্লাহই সবচেয়ে বেশি জানেন।
(৫) পঞ্চম প্রকারের যাদু হচ্ছে কয়েকটি জিনিসের সংমিশ্রণে একটি জিনিস তৈরি করা এবং এর দ্বারা আশ্চর্যজনক কাজ নেয়া। যেমন, ঘোড়ার আকৃতি তৈরি করে দিলো। অতঃপর এর ওপর একজন কৃত্রিম আরোহী বসিয়ে দিলো যার হাতে বাদ্য যন্ত্র রয়েছে। এক ঘন্টা অতিবাহিত হতেই তার মধ্যে হতে শব্দ বের হতে লাগলো। অথচ কেউই তাকে বাজাচ্ছে না। এরূপভাবেই এমন নিপুণতার সাথে মানুষের ছবি বানালো যে, মনে হচ্ছে যেন প্রকৃত মানুষই হাসছে বা কাঁদছে। ফিরা‘আউনের যাদুকরদের যাদু এই প্রকারেরই ছিলো। তাদের কৃত্রিম সাপগুলো পারদ জাতীয় দ্রব্য দিয়ে তৈরি ছিলো বলে মনে হতো যেন জীবিত সাপ নড়াচড়া করছে। ঘড়ি, ঘন্টা এবং ছোট ছোট জিনিস, যা থেকে বড় বড় জিনিস বেরিয়ে আসে, এসবগুলোই এই প্রকারের যাদুরই অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে একে যাদু বলা উচিত নয়। কেননা, এটা তো এক প্রকার নির্মাণ ও কারিগরি, যার কারণগুলো সম্পূর্ণ প্রকাশ্য। যে তা জানে সে এসব শব্দ দ্বারা একাজ করতে পারে। যে ফন্দি বায়তুল মোকাদ্দাসের খ্রিষ্টানরা করতো সেটাও এ শ্রেণীর যাদুরই অন্তর্ভুক্ত। ঐ ফন্দি এই যে, তারা গোপন গির্জার প্রদীপ গুলি জ্বালিয়ে দিতো। অতঃপর ওকে গির্জার মাহাত্ম্য বলে প্রচার করে জনগণকে তাদের ধর্মে টেনে আনতো। কতক কারামিয়াহ ও সুফিয়্যাহ সম্প্রদায়েরও ধারণা এই যে, জনগণকে মহান আল্লাহ্র ‘ইবাদতের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য আগ্রহ ও উৎসাহ প্রদর্শনের হাদীসগুলো বানিয়ে নিলেও কোন দোষ নেই। কিন্তু এটা চরম ভুল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
"من كذب عليّ متعمدًا فليتبوأ مقعده من النار"
‘যে ব্যক্তি জেনে শুনে আমার নামে মিথ্যা কথা বলে সে যেন জাহান্নামে তার স্থান ঠিক করে নেয়।’ (সহীহুল বুখারী হাদীস ১/১১০, সহীহ মুসলিম ১/৩/১০) তিনি আরো বলেনঃ
"حدثوا عني ولا تكذبوا عَلَيّ فإنه من يكذب عليّ يلج النار".
‘আমার হাদীস গুলো তোমরা বর্ণনা করতে থাকো, কিন্তু আমার নামে মিথ্যা কথা বলো না। যে ব্যক্তি আমার নামে মিথ্যা কথা বলে সে নিঃসন্দেহর জাহান্নামী।’ (সহীহুল বুখারী ১/১০৬, সহীহ মুসলিম- ১/১/৯ ও ৪/৭২/২২৯৮, ২২৯৯, মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৬)
একজন খ্রিষ্টান পাদরী একদা দেখে যে, পাখির একটি ছোট বাচ্চা যা উড়তে পারে না, একটি বাসায় বসে আছে। যখন সেটা দুর্বল ও ক্ষীণ স্বর বের করছে তখন অন্যান্য পাখিরা তার প্রতি দয়া পরবশ হয়ে যাইতুন ফল এনে তার বাসায় রেখে দিচ্ছে। ঐ পাদরী কোন জিনিস দিয়ে ঐ আকারেরই একটি পাখি তৈরি করে এবং তার নিচের দিকে ফাঁপা রাখে আর তার ঠোঁটের দিকে একটি ছিদ্র রাখে, যার মধ্য দিয়ে বাতাস ভিতরে প্রবেশ করে। অতঃপর যখন বাতাস বের হয় তখন ঐ পাখির মতোই শব্দ করে। এটা নিয়ে গিয়ে সে গির্জার মধ্যে বাতাস মুখো রেখে দেয়। ছাদে একটি ছোট ছিদ্র করে দেয় যেন বাতাস সেখান দিয়ে যাতায়াত করে। এখন যখনই বাতাস বইতে থাকে তখনই ঐ কৃত্রিম পাখিটি হতে শব্দ বের হতে থাকে। আর এ শব্দ শুনে ঐ প্রকারের পাখি তথায় একত্রিত হয় এবং যাইতুন ফল এনে এনে রেখে যায়। ঐ পাদরী তখন প্রচার করতে শুরু করে যে, গির্জার মধ্যে এটা এক অলৌকিক ব্যাপার। এখানে একজন মনীষীর সমাধি রয়েছে এবং এটা তারই ‘কারামত’। এ দিকে জনগণ স্বচক্ষে এ দৃশ্য দেখে বিশ্বাস করে নেয়। তারপর তারা ঐ কবরের ওপর নযর-নিয়ায আনতে থাকে এবং এই ‘কারামত’ বহু দূর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অথচ এটা না ছিলো ‘কারামত’ আর না ছিলো মু‘জিযাহ। বরং শুধু মাত্র এটা ছিলো একটি গোপনীয় বিষয় যা সেই পাদরী একমাত্র তার পেট পূরনের জন্যই গোপনীয়ভাবে করে রেখেছিলো। আর ঐ অভিশপ্ত দল তাতেই লিপ্ত হয়ে পড়েছিলো।
(৬) যাদুর ষষ্ঠ প্রকার হচ্ছে কতগুলো ঔষধের গোপন কোন বৈশিষ্ট্য জেনে এটা কাজে লাগানো। আর এটা তো স্পষ্ট কথা যে এতে বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চুম্বকেই তো দেখা যায় যে সেটা কিভাবে লোহাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে থাকে। অধিকাংশ সূফী ও দরবেশই ঐ ফন্দি ফিকিরকেই জনগণের মধ্যে বিভিন্নরূপে প্রদর্শন করে তাদেরকে মুরীদ করতে থাকে।
(৭) সপ্তম প্রকারের যাদু হচ্ছে কারো মধ্যে একটা বিশেষ প্রভাব ফেলে যা চায় তাই তার দ্বারা করিয়ে নেয়া। যেমন তাকে বলে যে তার ইসমে ‘আযম মনে আছে কিংবা জ্বিনেরা তার অনুগত আছে। এখন যদি তার সামনে লোকটি দুর্বল ঈমানের লোক হয় এবং অশিক্ষিত হয় তবে তো সে তাকে বিশ্বাস করে নিবে এবং তার প্রতি তার একটা ভয় ও সম্ভ্রম থাকবে যা তাকে আরো দুর্বল করে দিবে। এখন সে যা চাইবে তাই সে করবে। আর এই প্রভাব সাধারণত স্বল্প জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তির ওপরই পড়ে থাকে। আর একেই মুতাবান্নাহ বলা হয়। আর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সে জ্ঞানী ও জ্ঞানহীনকে চিনতে পারে। কাজেই সে নিরেটের উপরই তার ক্রিয়া চাপিয়ে থাকে।
(৮) অষ্টম প্রকারের যাদু হচ্ছে চুগলী করা। সত্য মিথ্যা মিশিয়ে কারো অন্তরে নিজের কতৃত্ব স্থাপন করা এবং গোপনীয় চতুরতায় তাকে বশীভূত করা। এ চুগলী যদি মানুষের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টির জন্য হয় তবে এটা শারী‘আত অনুযায়ী হারাম হবে। আর যদি এটা সংশোধন করার উদ্দেশ্যে হয় এবং মুসলমানদের মধ্যে পারস্পারিক মিলনের জন্য হয় কিংবা এর ফলে যদি মুসলমানদেরকে তাদের প্রতি আগত বিপদ থেকে রক্ষা করা যায় এবং কাফেরদের শক্তি নষ্ট করে তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়, তবে এটা বৈধ হবে। যেমন হাদীসে আছে যেঃ "ليس بالكذاب من يَنمّ خيرًا" ‘ঐ ব্যক্তি মিথ্যা বাদী নয়, যে মঙ্গলের জন্য এদিক ওদিক কথা নিয়ে যায়।’ (সহীহুল বুখারী ৫/২৬৯২, সহীহ মুসলিম-৪/১০১/২০১১) হাদীসে আরও আছে যেঃ "الحرب خدعة" ‘যুদ্ধ হচ্ছে প্রতারণার নাম।’ (সহীহুল বুখারী ৬/৩০৩০, সহীহ মুসলিম ৩/১৭/১৩৬১) যেমন নু ‘আইম ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) খন্দকের যুদ্ধ ‘আরবের কাফির ও ইয়াহুদীদের মধ্যে এদিক ওদিকের কথার মাধ্যমে বিচ্ছেদ আনয়ন করেছিলেন এবং এরই ফলে মুসলমানদের নিকট তাদের পরাজয় ঘটেছিলো। এটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ব্যাক্তির কাজ।
জ্ঞাতব্যঃ এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে ইমাম রাযী (রহঃ) যে যাদুর এই আটটি প্রকার বর্ণনা করেছেন তা শুধু শব্দ হিসেবে। কেননা ‘আরবী ভাষায় سحر বা যাদু প্রত্যেক ঐ জিনিসকেই বলা হয়, যা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল হয় এবং যার কারণসমূহ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকে। এজন্যেই একটি হাদীসে আছে যেঃ إن من البيان لسحرًا ‘কোন কোন বর্ণনাও যাদু।’ (সহীহুল বুখারী ৯/৫১৪৬, সহীহ মুসলিম ২/৪৭/৫৯৪) আর এ কারণেই সকলেই প্রথম ভাগকে সিহূর, বলা হয়। কেননা এটা মানুষের চক্ষুর অন্তরালে থাকে। আর ঐ শিরাকের ‘সিহর’ বলে যা আহার্যের স্থানে থাকে। আবু জেহেলও বদরের যুদ্ধে উতবাকে লক্ষ্য করে বলেছিলো যে, ‘তোমার খাদ্যের শিরা ভয়ে ফুলে গেছে।’ আর ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেনঃ ‘আমার সিহরও নাহারের মাঝে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।’ (সহীহুল বুখারী ৩/১৩৮৯, সহীহ মুসলিম ৪/১৮৯৩/৮৪, মুসনাদে আহমাদ ৬/১২১/২০০)
অতএব সিহরের অর্থ হচ্ছে খাদ্যের শিরা এবং নাহারের অর্থ হচ্ছে বুক। কুর’আন মাজীদে আছেঃ سَحَرُوا أَعْيُنَ النَّاسِ ‘তারা (যাদুকরেরা) মানুষের চক্ষু থেকে তাদের কার্যাবলী গোপন রেখেছিলো।’ (৭ নং সূরা আল আ‘রাফ, আয়াত ১১৬) মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
আবূ ‘আবদুল্লাহ কুরতুবী (রহঃ) বলেনঃ আমরা বলি যে, যাদু আছে এবং এটাও বিশ্বাস করি যে মহান আল্লাহ্র কাছে মঞ্জর হলে তিনি যাদুর সময় যা চান তাই ঘটিয়ে থাকেন যদিও মু‘তাযিলা, আবূ ইসহাক ইসফিরা‘ঈনী এবং ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) এটা বিশ্বাস করেন না।
যাদুর বস্তুঃ যাদু কখনো হাতের চালাকি দ্বারাও হয়ে থাকে আবার কখনো ডোরা, সুতা ইত্যাদির মাধ্যমেও হয়ে থাকে। কখনো মহান আল্লাহ্র নাম পড়ে ফুঁ দিলেও একটা বিশেষ প্রভাব পড়ে থাকে। কখনো শয়তানদের নাম নিয়ে শয়তানী কার্যাবলী দ্বারাও লোক যাদু করে থাকে। কখনো ঔষধ ইত্যাদি দ্বারাও যাদু করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে বলেছেন, কতোগুলো বর্ণনাও যাদু, এর দু’টো ভাবার্থ হতে পারে। হয়তো তিনি এটা বর্ণনাকারীর প্রশংসার জন্য বলেছেন, কিংবা তার নিন্দে করেও বলে থাকতে পারে যে, সে তার মিথ্যা কথাকে এমন ভঙ্গিমায় বর্ণনা করেছেন যে, তা সত্য মনে হচ্ছে।
আবুল মুজাফফর ইয়াহইয়া ইবনে মুহাম্মাদ বিন হাবিব (রহঃ) স্বীয় গ্রন্থ ‘আল আশরাফু আ‘লা মাযাহিবিল আশরাফে’ এর মধ্যে যাদু অধ্যায়ে লিখেছেনঃ ‘এ বিষয়ে ইজমা‘ রয়েছে যে, যাদুর অস্তিত্ব আছে।’ কিন্তু ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এটা স্বীকার করেননি।
যাদু বিদ্যা শিক্ষা করার হুকুম
যারা যাদু শিক্ষা করে ও এটা ব্যবহার করে তাদেরকে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ), ইমাম মালিক (রহঃ) এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল (রহঃ) কাফের বলেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এর কয়েকজন শিষ্যের মতে যাদু যদি আত্মরক্ষার জন্য কেউ শিক্ষা করে তবে সে কাফির হবে না। তবে হ্যাঁ যারা এর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং একে উপকারী মনে করে সে কাফের। অনুরূপ ভাবে যারা ধারণা করে যে, শয়তানরা এ কাজ করে থাকে এবং তারা এরকম ক্ষমতা রাখে তারাও কাফের।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন, যে যাদুকরদেরকে জিজ্ঞেস করতে হবে, যদি তারা বাবেলবাসীদের মতো বিশ্বাস রাখে এবং সাতটি গতিশীল তারকার প্রভাব সৃষ্টিকারী রূপে বিশ্বাস করে তবে তারা কাফির। আর যদি এরূপ না হয়, কিন্তু যাদুকে বৈধ মনে করে তবে তারাও কাফির। ইমাম মালিক (রহঃ) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এর অভিমত এটাও আছে যে, যারা যাদু করে এবং একে ব্যবহারে লাগায় তাদেরকে হত্যা করে দেয়া হবে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এবং ইমাম শফি‘ঈ (রহঃ) বলেন যে, যে পর্যন্ত বারবার না করে কিংবা কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে নিজে স্বীকার না করে সেই পর্যন্ত হত্যা করা হবে না। তিনজন ইমামই বলেন যে, তার হত্যা হচ্ছে শাস্তির জন্য। কিন্তু ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন যে, এ হত্যা প্রতিশোধের জন্য। ইমাম মালিক (রহঃ), আবূ হানীফা (রহঃ) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) একটি প্রসিদ্ধ উক্তিতে এ নির্দেশ আছে যে, যাদুকরকে তাওবাহও করানো হবে না এবং তার তাওবা করার ফলে তার শাস্তি লোপ পাবে না।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) এর মতে তার তাওবাহ গৃহীত হবে। একটি বর্ণনায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) থেকেও এমন উক্তি আছে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মতে কিতাবীদের যাদুকরকে হত্যা করা হবে। কিন্তু অন্য তিনজন ইমামের অভিমত এর উল্টো। লাবীদ বিন আ‘সাম নামক ইয়াহুদী রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর যাদু করেছিলো, কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়নি। যদি কোন মুসলমান মহিলা যাদু করে তবে তার সম্বন্ধে ইমাম আবূ হানিফা (রহঃ) এর মত এই যে, তাকে বন্দী করা হবে আর অন্য তিনজন ইমামের মতে পুরুষের মতো তাকেও হত্যা করা হবে। আল্লাহ তা‘আলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জ্ঞান রাখেন।
ইমাম যুহরী (রহঃ)-এর মতে মুসলমান যাদুকরকে হত্যা করা হবে। কিন্তু মুশরিক যাদুকরকে হত্যা করা হবে না। ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন যে, যদি কোন যিম্মীর যাদুর ফলে কেউ মারা যায় তবে যিম্মীকেও মেরে ফেলা হবে। তিনি এটাও বর্ণনা করেন যে, তাকে প্রথমে তাওবাহ করতে বলা হবে। যদি সে তাওবাহ করে ইসলাম গ্রহণ করে তবে তা ভালোই, নচেৎ তাকে হত্যা করা হবে। আবার তাঁর থেকে এটাও বর্ণিত আছে যে, ইসলাম গ্রহণ করলেও তাকে হত্যা করা হবে। যে যাদুকরের যাদুতে শিরকী শব্দ আছে, চারজন ইমামই তাকে কাফের বলেছেন। ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন যে যাদুকরের ওপর প্রভুত্ব লাভ করার পর যদি সে তাওবা করে তবে তার তাওবাহ গৃহীত হবে না। যেমন যিন্দিক সম্প্রদায়। তবে যদি তার ওপর প্রভুত্ব লাভের পূর্বেই তারা তাওবাহ করে তাহলে তা গৃহীত হবে। আর যদি তার যাদুতে কেউ মারা যায় তবে তাকে হত্যা করতেই হবে।
ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেন যে, যদি সে বলে যে, আমি মেরে ফেলার জন্য যাদু করি নি তাহলে ভুল করে হত্যার অপরাধে তার নিকট হতে জরিমানা আদায় করা হবে। সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব (রহঃ) যাদুকরের দ্বারা যাদু উঠিয়ে নিতে অনুমতি দিয়েছেন, যেমন সহীহ বুখারীর মধ্যেও রয়েছে। ‘আমির শা‘বীও এটাকে কোন দোষ মনে করেন না। কিন্তু খাজা হাসান বাসরী (রহঃ) এটাকে মাকরুহ বলেছেন।
‘আয়িশাহ্ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর খিদমতে আরয করেনঃ আপনি যাদু তুলে নেন না কেন? তিনি বলেনঃ মহান আল্লাহ তো আমাকে আরোগ্য দান করেছেন। আমি লোকের ওপর মন্দ খুলিয়ে নিতে ভয় করি।
যাদুর চিকিৎসা
ওয়াহাব (রহঃ) বলেন যে, কুলের সাতটি পাতা পাটায় বেটে পানিতে মিশাতে হবে। অতঃপর আয়াতুল কুরসি পড়ে তার ওপর ফুঁ দিতে হবে এবং যাদুকৃত ব্যক্তিকে তিন ঢোক পানি পান করাতে হবে এবং অবশিষ্ট পানি দিয়ে গোসল করাতে হবে। ইনশা’আল্লাহ যাদুর ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যাবে। এ ‘আমল বিশেষ ভাবে ঐ ব্যক্তির জন্য খুবই মঙ্গলজনক যাকে তার স্ত্রী থেকে বিরত রাখা হয়েছে। যাদু ক্রিয়া নষ্ট করার সবচেয়ে বড় চিকিৎসা হচ্ছে قل اعوذ برب الفلق ও قل اعوذ برب الناس এ সুরাগুলো। হাদীসে আছে যে, এই সূরাগুলোর চেয়ে বড় রক্ষাকবয আর কিছু নেই। এরকমই আয়াতুল কুরসিও শায়তানকে দূর করার জন্য বড়ই ফলদায়ক।
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings