Surah An Nur Tafseer
Tafseer of An-Nur : 11
Saheeh International
Indeed, those who came with falsehood are a group among you. Do not think it bad for you; rather it is good for you. For every person among them is what [punishment] he has earned from the sin, and he who took upon himself the greater portion thereof - for him is a great punishment.
Ibn Kathir Full
Tafseer 'Ibn Kathir Full' (BN)
এই আয়াত থেকে নিয়ে পরবর্তী দশটি আয়াত হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়, যখন মুনাফিকরা তাঁর বিরুদ্ধে অপবাদ রচনা করেছিল। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কারাবতদারীর কারণে আল্লাহ তা'আলা এটাকে মর্যাদাহানিকর মনে করে আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন, যাতে তাঁর নবী (সঃ)-এর মর্যাদার উপর কোন দাগ পড়ে। এই অপবাদ রচনাকারীদের একটি দল ছিল যাদের অগ্রনায়ক ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সাল। সে ছিল মুনাফিকদের নেতা। ঐ বেঈমানই কথাটিকে বানিয়ে সানিয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে কানে কানে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। এমন কি শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের মুখও খুলতে শুরু হয়েছিল। এই কুৎসা রটনা প্রায় এক মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। অবশেষে কুরআন কারীমের এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। এই ঘটনার পূর্ণ বর্ণনা সহীহ হাদীসসমূহে বিদ্যমান রয়েছে। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অভ্যাস ছিল এই যে, সফরে যাওয়ার সময় তিনি তাঁর স্ত্রীদের নামে লটারী ফেলতেন। লটারীতে যার নাম উঠতো তাকে তিনি সাথে নিয়ে যেতেন। ঘটনাক্রমে তার এক যুদ্ধে গমনের সময় লটারীতে আমার নাম উঠে। আমি তাঁর সাথে গমন করি। এটা পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পরের ঘটনা। আমি আমার হাওদাজ বা শিবিকায় বসে থাকতাম। যখন যাত্রীদল কোন জায়গায় অবতরণ করতো তখন আমার হাওদাজ নামিয়ে নেয়া হতো। আমি হাওদাজের মধ্যেই বসে থাকতাম। আবার যখন কাফেলা চলতে শুরু করতো তখন আমার শিবিকাটি উষ্ট্রের উপর উঠিয়ে দেয়া হতো। এভাবে আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাই। যুদ্ধ শেষে আমরা মদীনার পথে ফিরতে শুরু করি। আমরা মদীনার নিকটবর্জ হলে রাত্রে গমনের ঘোষণা দেয়া হয়। আমি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ি এবং সেনাবাহিনীর তাবু থেকে বহু দূরে চলে যাই। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করে আমি ফিরতে শুরু করি। সেনাবাহিনীর তাঁবুর নিকটবর্তী হয়ে আমি গলায় হাত দিয়ে দেখি যে, গলায় হার নেই। আমি তখন হার খুঁজবার জন্যে আবার ফিরে যাই এবং হার খুঁজতে থাকি। এদিকে তো এই হলো। আর ওদিকে সেনাবাহিনী যাত্রা শুরু করে দিলো। যে লোকগুলো আমার শিবিকা উঠিয়ে দিতো তারা মনে করলো যে, আমি শিবিকার মধ্যেই রয়েছি, তাই তারা আমার শিবিকাটি উটের পিঠে উঠিয়ে দিলো এবং চলতে শুরু করলো। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, ঐ সময় পর্যন্ত স্ত্রীলোকেরা খুব বেশী পানাহারও করতো না, ফলে তাদের দেহ বেশী ভারীও হতো না। তাই আমাকে বহনকারীরা হাওদাজের মধ্যে আমার থাকা না থাকার কোন টেরই পেলো না। তাছাড়া আমি ছিলাম ঐ সময় খুবই অল্প বয়সের মেয়ে। মোটকথা দীর্ঘক্ষণ পর আমি আমার হারানো হারটি খুঁজে পেলাম। সেনাবাহিনীর বিশ্রামস্থলে পৌছে আমি কোন মানুষের নাম নিশানাও পেলাম না। আমার চিহ্ন অনুযায়ী আমি ঐ জায়গায় পৌঁছলাম যেখানে আমার উটটি বসা ছিল। সেখানে আমি এ অপেক্ষায় বসে পড়লাম যে, সেনাবাহিনী সামনে অগ্রসর হয়ে যখন আমার না থাকার খবর পাবে তখন অবশ্যই এখানে লোক পাঠাবে। বসে বসে আমার ঘুম এসে যায়। ঘটনাক্রমে হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল সালমী যাকওয়ানী (রাঃ) যিনি সেনাবাহিনীর পিছনে ছিলেন এবং শেষ রাত্রে চলতে শুরু করেছিলেন, সকালে এখানে পৌছে যান। একজন ঘুমন্ত মানুষকে দেখে তিনি গভীর দৃষ্টিতে তাকাতে থাকলেন। পর্দার হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন বলে দেখা মাত্রই চিনে ফেলেন এবং উচ্চ স্বরে তার মুখ দিয়ে (আরবি) বেরিয়ে পড়ে। তার এ শব্দ শোনা মাত্রই আমার চক্ষু খুলে যায় এবং আমি চাদর দিয়ে আমার মুখটা ঢেকে ফেলে নিজেকে সামলিয়ে নিই। তৎক্ষণাৎ তিনি তার উটটি বসিয়ে দেন এবং ওর হাতের উপর নিজের পাটা রাখেন। আমি উঠে উটের উপর সওয়ার হয়ে যাই। তিনি উটকে উঠিয়ে চালাতে শুরু করেন। আল্লাহর শপথ! তিনি আমার সাথে কোন কথা বলেননি এবং আমিও তার সাথে কোন কথা বলিনি। (আরবি) ছাড়া আমি তাঁর মুখে অন্য কোন কথা শুনিনি। প্রায় দুপুর বেলায় আমরা আমাদের যাত্রীদলের সাথে মিলিত হই। এটুকু ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ধ্বংসপ্রাপ্তরা তিলকে তাল করে প্রচার শুরু করে দেয়। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা রচনাকারী ছিল আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সাল। মদীনায় এসেই আমি রুগ্না হয়ে পড়ি এবং এক মাস পর্যন্ত রোগে ভুগতে থাকি ও বাড়ীতেই অবস্থান করি। আমি নিজেও কিছু শুনিনি এবং কেউ আমাকে কোন বলেওনি। আলোচনা সমালোচনা যা কিছু হচ্ছিল তা লোকদের মধ্যেই হচ্ছিল। আমি ছিলাম এ থেকে সম্পূর্ণরূপে বে-খবর। তবে মাঝে মাঝে এরূপ ধারণা আমার মনে জেগে উঠতো যে, আমার প্রতি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যে প্রেম ও ভালবাসা ছিল তা কমে যাওয়ার কারণ কি! অন্যান্য সময় আমি রোগাক্রান্তা হলে তিনি আমার প্রতি যে ভালবাসা দেখাতেন, এই রোগের অবস্থায় আমি তা পেতাম না। এজন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিতা হতাম, কিন্তু এর কোন কারণ খুঁজে পেতাম না। তিনি আমার কাছে আসতেন, সালাম দিতেন এবং অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন। এছাড়া তিনি আর কিছু বলতেন না। এতে আমি অত্যন্ত দুঃখ পেতাম। কিন্তু অপবাদদাতাদের অপবাদ সম্পর্কে আমি ছিলাম সম্পূর্ণরূপে উদাসীনা।
ঐ সময় পর্যন্ত আমাদের বাড়ীতে পায়খানা নির্মিত হয়নি এবং আরবদের প্রাচীন অভ্যাসমত আমরা আমাদের প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার জন্যে মাঠে গমন করতাম। স্ত্রীলোকেরা সাধারণতঃ রাত্রেই যেতো। বাড়ীতে পায়খানা তৈরী করতে মানুষ সাধারণভাবে ঘৃণাবোধ করতো। অভ্যাসমত আমি উম্মে মিসতাহ বিনতে আবি রহম ইবনে আবদিল মুত্তালিব ইবনে আবদিল মানাফের সাথে প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করার জন্যে গমন করি। ঐ সময় আমি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এই উম্মে মিস্তাহ আমার আব্বার খালা ছিলেন। তার মাতা ছিল সাখর ইবনে আম্মাহর কন্যা। তার পুত্রের নাম ছিল মিসতাহ ইবনে আসাসাহ ইবনে ইবাদ ইবনে আবদিল মুত্তালিব। আমরা যখন বাড়ী ফিরতেছিলাম তখন হযরত উম্মে মিসতাহর পা তার চাদরের আঁচলে জড়িয়ে পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে যে, মিসতাহ্ ধ্বংস হোক। এটা আমার কাছে খুবই খারাপবোধ হয়। আমি তাকে বলিঃ তুমি খুব খারাপ কথা উচ্চারণ করেছে, সুতরাং তাওবা কর। তুমি এমন লোককে গালি দিলে যে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তখন উম্মে মিসতাহ বলেঃ “হে সরলমনা মেয়ে! আপনি কি কিছুই খবর রাখেন না?” আমি বলিঃ ব্যাপার কি? সে উত্তরে বলেঃ “যারা আপনার উপর অপবাদ আরোপ করেছে তাদের মধ্যে সেও একজন। তার একথায় আমি খুবই বিস্ময়বোধ করি এবং তাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটি খুলে বলতে অনুরোধ করি। সে তখন অপবাদদাতাদের সমস্ত কার্যকলাপ আমার কাছে খুলে বলে। এতে আমি অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার উপর দুঃখ ও চিন্তার পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। এই চিন্তার ফলে আমার রোগ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। কোন রকমে আমি বাড়ী পৌঁছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম যে, পিতার বাড়ী গিয়ে খবরটা ভালভাবে জানবো। সত্যিই কি আমার বিরুদ্ধে এসব গুজব রটে গেছে! কি কি খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা আমি সঠিকভাবে জানতে চাই। ইতিমধ্যেই রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আগমন করেন এবং সালাম দিয়ে আমার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। আমি তাকে বললামঃ আমাকে আপনি আমার পিতার বাড়ী যাওয়ার অনুমতি দিন! তিনি অনুমতি দিলেন এবং আমি পিতার বাড়ী চলে গেলাম। আম্মাকে জিজ্ঞেস করলামঃ আম্মাজান! লোকদের মধ্যে আমার সম্পর্কে কি কথা ছড়িয়ে পড়েছে? উত্তরে তিনি বলেনঃ “হে আমার কলিজার টুকরো! এটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার। এতে তোমার মন খারাপ করার কোনই কারণ নেই। যে স্বামীর কাছে তার কয়েকজন স্ত্রীর মধ্যে কোন একজন স্ত্রী খুবই প্রিয় হয় সেখানে এরূপ ঘটনা ঘটে যাওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়।” আমি বললামঃ সুবহানাল্লাহ! তাহলে সত্যিই তো লোকেরা আমার সম্পর্কে এরূপ গুজব রটিয়ে বেড়াচ্ছে? তখন আমি শশাকে ও দুঃখে এতো মুষড়ে পড়ি যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তখন থেকে যে আমার কান্না শুরু হয়, তা ক্ষণেকের জন্যেও বন্ধ হয়নি। আমি মাথা নীচু করে শুধু কাঁদতেই থাকি। পানাহার, শোয়া, বসা, কথা বলা সবকিছুই বাদ দিয়ে আমার একমাত্র কাজ হয় চিন্তা করা ও কাদা। সারারাত এভাবেই কেটে যায়। এক মুহূর্তের জন্যেও আমার অশ্রু বন্ধ হয়নি। দিনেও ঐ একই অবস্থা। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে অহী আসতে বিলম্ব হয়। তাই তিনি হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে পৃথক করে দিবেন কি না এ বিষয়ে এ দু’জনের সাথে পরামর্শ করেন। হযরত উসামা (রাঃ) তো স্পষ্টভাবে বলে দেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার এ স্ত্রীর কোন মন্দগুণ আমার জানা নেই। আমাদের হৃদয় তঁার মহব্বত, মর্যাদা ও তার সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে সদাবিদ্যমান রয়েছে। তবে হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে আপনার উপর কোন সংকীর্ণতা নেই। তিনি ছাড়া আরও বহু স্ত্রীলোক রয়েছে। আপনার বাড়ীর চাকরানীকে জিজ্ঞেস করলে তার সম্পর্কে আপনি সঠিক তথ্য জানতে পারবেন।" রাসূলুল্লাহ (সঃ) তৎক্ষণাৎ বাড়ীর চাকরানী হযরত বুরাইরা (রাঃ)-কে ডেকে পাঠান। তাকে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার সামনে আয়েশা (রাঃ)-এর এমন কোন কাজ কি প্রকাশ পেয়েছে যা তোমাকে সন্দেহের মধ্যে ফেলেছে?” উত্তরে হযরত বুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর শপথ! তার এ ধরনের কোন কাজ আমি কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, তবে এটুকু শুধু দেখেছি যে, তাঁর বয়স অল্প হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে ঠাসা আটা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন এবং এই সুযোগে বকরী এসে ঐ আটা খেয়ে নেয়। এছাড়া তাঁর অন্য কোন ত্রুটি আমার চোখে ধরা পড়েনি। এ ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না বলে ঐ দিনই রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরে উঠে জনগণকে সম্বোধন করে বলেনঃ “কে এমন আছে। যে আমাকে ঐ ব্যক্তির অনিষ্ট ও কষ্ট থেকে বাঁচাতে পারে যে আমাকে কষ্ট দিতে দিতে ঐ কষ্ট আমার পরিবার পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিতে শুরু করেছে? আল্লাহর শপথ! আমার জানামতে আমার এ পত্নীর মধ্যে ভাল গুণ ছাড়া মন্দ গুণ কিছুই নেই। তার সাথে যে ব্যক্তিকে তারা এ কাজে জড়িয়ে ফেলেছে তার মধ্যেও সততা ছাড়া আমি কিছুই দেখিনি। সে আমার সাথেই আমার বাড়ীতে প্রবেশ করতো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর একথা শুনে হযরত সা'দ ইবনে মুআয আনসারী (রাঃ) দাঁড়িয়ে যান এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি প্রস্তুত রয়েছি। সে যদি আউস গোত্রের লোক হয় তবে এখনই আমি তার মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছি। আর যদি সে আমাদের খাযরাজী ভাইদের মধ্যকার লোক হয় তবে আপনি নির্দেশ দিন, আমরা আপনার নির্দেশ পালনে মোটেই ত্রুটি করবো না।” তার একথা শুনে হযরত সা’দ ইবনে উবাদা (রাঃ) দাড়িয়ে যান। তিনি খাযরাজ গোত্রের নেতা ছিলেন। তিনি খুবই সৎ লোক ছিলেন। কিন্তু হযরত সা'দ (রাঃ)-এর ঐ সময়ের ঐ উক্তির কারণে তার গোত্রীয় মর্যাদায় আঘাত লাগে। তাই তিনি ওর পক্ষপাতিত্ব করতে গিয়ে হযরত সা’দ ইবনে মুআয (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ “তুমি মিথ্যা বললে। না তুমি তাকে হত্যা করবে, না তুমি তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবে। সে যদি তোমার গোত্রের লোক হতো তবে তুমি তার নিহত হওয়া কখনো পছন্দ করতে না।” তাঁর একথা শুনে হযরত উসায়েদ ইবনে হুযায়ের (রাঃ) দাড়িয়ে যান। তিনি ছিলেন হযরত সা'দ ইবনে মুআয (রাঃ)-এর ভাতুস্পুত্র। তিনি বলতে শুরু করেনঃ “হে সা’দ ইবনে উবাদা (রাঃ)। আপনি মিথ্যা বললেন। আমরা অবশ্যই তাকে হত্যা করবো। আপনি মুনাফিক বলেই মুনাফিকদের পক্ষপাতিত্ব করছেন। এখন এঁদের পক্ষ থেকে এঁদের গোত্র এবং তাদের পক্ষ থেকে তাদের গোত্র একে অপরের বিরুদ্ধে মুকাবিলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার উপক্রম হয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিম্বরের উপর থেকেই তাদেরকে থামাতে থাকেন। অবশেষে উভয় দল নীরব হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেও নীরবতা অবলম্বন করেন। এতো ছিল সেখানকার ঘটনা। আর আমার অবস্থা এই ছিল যে, সারা দিন আমার কান্নাতেই কেটে যায়। আমার পিতা-মাতা ধারণা করলেন যে, এ কান্না আমার কলেজা ফেড়েই ফেলবে। বিষন্ন মনে আমার পিতা-মাতা আমার নিকট বসেছিলেন এবং আমি কাঁদছিলাম। এমন সময় আনসারের একজন স্ত্রীলোক আমাদের নিকট আগমন করে এবং সেও আমার সাথে কাঁদতে শুরু করে। আমরা সবাই এভাবেই বসেছিলাম এমতাবস্থায় আকস্মিভাবে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সেখানে আগমন ঘটে। তিনি সালাম দিয়ে আমার পাশে বসে পড়েন। আল্লাহর কসম! যখন থেকে এই অপবাদ ছড়িয়ে পড়ে তখন থেকে নিয়ে ঐ দিনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি আমার পাশে বসেননি। এক মাস অতিক্রান্ত হয়েছিল। এর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর অবস্থা ঐরূপই ছিল। এ সময়ের মধ্যে তার উপর কোন অহী অবতীর্ণ হয়নি। কাজেই কোন সিদ্ধান্তেই তিনি পৌঁছতে পারেননি। বসেই তিনি তাশাহহুদ পাঠ করেন। অতঃপর বলেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে এ খবর পৌঁছেছে। যদি তুমি সত্যিই সতী-সাধ্বী থেকে থাকো তবে আল্লাহ তা'আলা তোমার পবিত্রতা ও সতীত্বের কথা প্রকাশ করে দিবেন। আর যদি প্রকৃতই তুমি কোন পাপে জড়িয়ে পড়ে থাকো তবে আল্লাহ পাকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তাওবা কর। কারণ বান্দা যখন কোন পাপ কার্যে লিপ্ত হবার পর তা স্বীকার করে নিয়ে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে ও তাঁর কাছে ক্ষমা চায় তখন তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) এটুকু বলার পর নীরব হয়ে যান। তাঁর একথা শুনেই আমার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। অশ্রু শুকিয়ে যায়। এমন কি এক ফোঁটা অশ্রুও চোখে ছিল না। প্রথমে আমি আমার পিতাকে বললাম যে, তিনি যেন আমার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জবাব দেন। কিন্তু তিনি বলেনঃ “আমি তাঁকে কি জবাব দেবো তা বুঝতে পারছি না।” তখন আমি আমার মাতাকে লক্ষ্য করে বলিঃ আপনি আমার পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে উত্তর দিন। কিন্তু তিনিও বলেনঃ “আমি তাঁকে কি উত্তর দেবো। তা খুঁজে পাচ্ছি না। তখন আমি নিজেই জবাব দিতে শুরু করলাম। আমার বয়সতো তেমন বেশী ছিল না এবং কুরআনও আমার বেশী মুখস্তু ছিল না। আমি বললামঃ আপনারা সবাই একটা কথা শুনেছেন এবং মনে স্থান দিয়েছেন। আর হয়তো ওটা সত্য বলেই মনে করেছেন। এখন আমি যদি বলি যে, আমি এই বেহায়াপনা কাজ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং আল্লাহ তা'আলা খুব ভাল জানেন যে, আমি আসলেও এ পাপ থেকে সম্পূর্ণরূপেই মুক্ত, কিন্তু আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। হ্যা, তবে আমি এটা স্বীকার করে নিই, অথচ আল্লাহ তা'আলা খুব ভাল জানেন যে, আমি সম্পূর্ণরূপে নিস্পাপ, তাহলে আপনারা আমার কথা মেনে নিবেন। এখন আমার ও আপনাদের দৃষ্টান্ত তো সম্পূর্ণরূপে আবু ইউসুফের (হযরত ইউসুফের আঃ পিতা হযরত ইয়াকূবের আঃ) নিম্নের উক্তিটিঃ (আরবি)
অর্থাৎ ‘সুতরাং পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়, তোমরা যা বলছে সে বিষয়ে একমাত্র আল্লাহই আমার সাহায্যস্থল।" (১২:১৮) এটুকু বলেই আমি পার্শ্ব পরিবর্তন করি এবং আমার বিছানায় শুয়ে পড়ি। আল্লাহর কসম! আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যেহেতু আমি পবিত্র ও দোষমুক্ত, সেহেতু আল্লাহ তা'আলা আমার দোষমুক্ত থাকার কথা স্বীয় রাসূল (সঃ)-কে অবহিত করবেন। কিন্তু আমি এটা কল্পনাও করিনি যে, আমার ব্যাপারে কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হবে। আমি নিজেকে অতি নগণ্য মনে করতাম যে, আমার ব্যাপারে মহান আল্লাহর কালাম অবতীর্ণ হতে পারে। হাঁ, তবে বড় জোর আমার ধারণা এরূপ হতো যে, আল্লাহ স্বীয় নবী (সঃ)-কে হয়তো স্বপ্নযোগে আমার দোষমুক্ত হওয়ার কথা জানিয়ে দিবেন। আল্লাহর শপথ! তখনও রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের জায়গা থেকে সরেননি এবং বাড়ীর কোন লোকও বাড়ী হতে বের হননি এমতাবস্থায় তার উপর অহী অবতীর্ণ হতে শুরু হয়ে যায়। তাঁর মুখমণ্ডলে ঐসব নিদর্শন প্রকাশ পায় যা অহীর সময় প্রকাশিত হয়ে থাকে। তার ললাট হতে ঘর্মের পবিত্র ফোটা পতিত হতে থাকে। কঠিন শীতের সময়ও অহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় ঐ অবস্থাই প্রকাশ পেতো। অহী অবতীর্ণ হওয়া শেষ হলে আমরা দেখতে পাই যে, তার চেহারা মুবারক খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সর্বপ্রথম তিনি আমার দিকে চেয়ে বলেনঃ “হে আয়েশা (রাঃ)! তুমি খুশী হয়ে যাও। কারণ মহান আল্লাহ তোমার দোষমুক্ত হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।” তৎক্ষণাৎ আমার মা আমাকে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় কন্যা! আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর সামনে দাড়িয়ে যাও।” আমি উত্তরে বললামঃ আল্লাহর শপথ! আমি তাঁর সামনে দাঁড়াবো না এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করবো না। তিনিই আমার দোষমুক্তি ও পবিত্রতার আয়াত অবতীর্ণ করেছেন। ঐ সময় অবতারিত আয়াতগুলো হলোঃ (আরবি) হতে দশটি আয়াত। এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পর যখন আমার পবিত্রতা প্রমাণিত হয়ে যায় তখন আমার অপবাদ রচনাকারীদের মধ্যে মিসতাহ ইবনে আসাসাও (রাঃ) ছিল বলে আমার পিতা তার দারিদ্র্য ও তার সাথে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে বরাবরই তাকে যে সাহায্য করে আসছিলেন এবং তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে আসছিলেন তা বন্ধ করে দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। তখন মহান আল্লাহ নিম্নের আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ (আরবি) পর্যন্ত।
অর্থাৎ “তোমাদের মধ্যে যারা ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ গ্রহণ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন ও অভাবগ্রস্তদেরকে এবং আল্লাহর পথে যারা গৃহত্যাগ করেছে তাদেরকে কিছুই দিবে না; তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে এবং তাদের দোষত্রুটি উপেক্ষা করে; তোমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করেন? এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলে উঠেনঃ “আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দেন এটা আমি ভালবাসি।” অতঃপর তিনি ইতিপূর্বে মিসতাহ (রাঃ)-এর উপর যে খরচ করতেন তা তিনি পুনরায় চালু করে দেন এবং বলেনঃ “আল্লাহর কসম! কখনো আমি তার থেকে এটা বন্ধ করবো না।”
আমার এই ঘটনা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর স্ত্রী হযরত যয়নব (রাঃ)-কেও জিজ্ঞেস করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সমস্ত স্ত্রীর মধ্যে হযরত যয়নব (রাঃ) আমার প্রতিদ্বন্দ্বিনী ছিলেন। কিন্তু তার আল্লাহর ভীতির কারণে তিনি আমার প্রতি কলংক আরোপ করা হতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কারভাবে বলেছিলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি আমার কর্ণ ও চক্ষুকে রক্ষিত রাখছি, আল্লাহর কসম! আমি তার সম্পর্কে ভাল ছাড়া আর কিছুই জানি না।” অথচ তার ভগ্নী হিমনাহ বিনতে জহশ আমার সম্পর্কে বহুকিছু বলেছিল এবং আমার বিরুদ্ধে বোনকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিল। তথাপি হযরত যয়নব বিনতে জহশ (রাঃ) আমার সম্পর্কে একটিও মন্দ কথা উচ্চারণ করেননি। তবে তার ভগ্নী আমার অপবাদ রচনায় বড় রকমের ভূমিকা পালন করেছিল এবং সে ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এ রিওয়াইয়াতটি সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি বহু হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে)
একটি সনদে এটাও বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর ঐ ভাষণে একথাও বলেছিলেনঃ “হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে যে ব্যক্তিকে সম্পর্কিত করা হচ্ছে সে আমার সফরে ও বাড়ীতে অবস্থানকালে আমার সাথে থেকেছে। আমার অনুপস্থিতিতে কখনো সে অমার বাড়ীতে আসেনি।” তাতে রয়েছে যে, হযরত সা'দ ইবনে মুআয (রাঃ)-এর মুকাবিলায় যে লোকটি দাঁড়িয়েছিলেন, উম্মে হাসসান তাঁর গোত্রেরই মহিলা ছিলেন। ঐ রিওয়াইয়াতে এও আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “যেদিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ ভাষণ দান করেন সেদিনের পর রাত্রে আমি উম্মে মিসতাহর সাথে বের হয়েছিলাম।” তাতে এটাও আছে যে, হযরত আয়েশা বলেনঃ “একবার উম্মে মিসতাহর পদস্খলন হলে সে তার ছেলে মিসতাহকে অভিশাপ দেয়। আমি তাকে নিষেধ করি। সে আবার পিছলে পড়লে আবার সে অভিশাপ দেয়। এবারেও আমি তাকে বাধা প্রদান করি। পুনরায় সে চাদরে জড়িয়ে পড়লে আবারও সে তার পুত্র মিসতাহকে অভিশাপ দেয়। আমি তখন তাকে ধমকাতে শুরু করি।” তাতে রয়েছে যে, তিনি বলেনঃ “ঐ সময় থেকেই আমার রোগ বৃদ্ধি পায়।” তাতে আরো আছে যে, তিনি বলেন, আমার মায়ের বাড়ী পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার সাথে একজন গোলামকে পাঠিয়ে দেন। আমি যখন মায়ের বাড়ী পৌঁছি তখন আমার পিতা উপরের ঘরে বসে কুরআন পাঠ করছিলেন। আমার মাতা ছিলেন নীচের ঘরে। আমাকে দেখা মাত্রই তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “আজ তুমি কেমন করে আসলে?” আমি তখন তাঁকে সবকিছু শুনিয়ে দিলাম। কিন্তু আমি দেখলাম যে, এটা তার কাছে না কোন অস্বাভাবিক কথা বলে মনে হলো এবং না তিনি তেমন দুঃখিতা ও চিন্তিতা হলেন, যেমনটি আমি আশা করেছিলাম।” ঐ রিওয়াইয়াতে আছে যে, তিনি (আয়েশা রাঃ) বলেনঃ “আমি আমার মাতাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার পিতার কানেও কি এ খবর পৌঁছেছে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হ্যা।” আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহও (সঃ) কি এ খবর পেয়েছেন? তিনি জবাবে বলেনঃ “হ্যা।" এ কথা শুনে তো আমার কান্না এসে গেল। আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম। এমন কি আমার কান্নার শব্দ আমার পিতার কানেও পৌঁছে গেল। তাড়াতাড়ি তিনি নীচে নেমে আসলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “ব্যাপার কি?” উত্তরে আমার মাতা বললেনঃ “তার উপর যে অপবাদ আরোপ করা হয়েছে তা সে জেনে ফেলেছে। একথা শুনে এবং আমার অবস্থা দেখে আমার পিতার চক্ষদ্বয়ও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। তিনি আমাকে বললেনঃ “হে আমার প্রিয় কন্যা। আমি তোমাকে কসম দিয়ে বলছি যে, তুমি এখনই বাড়ী ফিরে যাও।” আমি তখন বাড়ী ফিরে আসলাম। এখানে আমার অসাক্ষাতে বাড়ীর চাকরানীকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোকদের সামনে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। সে উত্তরে বলেঃ “আমি আয়েশা (রাঃ)-এর মধ্যে মন্দ কিছুই দেখিনি, শুধু এটুকুই দেখেছি যে, ঠাসা আটা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দিয়ে তিনি বে-খেয়ালে ঘুমিয়ে পড়েন, আর ওদিকে মাঝে মাঝে বকরী এসে ঐ আটা খেয়ে ফেলে।” এমন কি কোন কোন লোক তাকে ধমকের সুরে বলেঃ “দেখো, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে সত্য কথা বল।” এভাবে তারা তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করে। কিন্তু তখনো সে বলেঃ “খাটি সোনাকে আগুনে পোড়ালেও যেমন ওর কোন খুঁত বের করা যায় না, অনুরূপভাবে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মধ্যেও কোন দোষ পাওয়া যাবে না।”
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে জড়িয়ে ফেলে যে লোকটির বদনাম করা হয়েছিল তিনি যখন এ খবর পান তখন তিনি বলে ওঠেনঃ “আল্লাহর শপথ! আজ পর্যন্ত আমি তো কোন স্ত্রীলোকের হাতটাও খুলে দেখিনি।” অবশেষ ঐ লোকটি আল্লাহর পথে শহীদ হয়ে যান। ঐ বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার নিকট আসরের নামাযের পরে আগমন করেছিলেন। ঐ সময় আমার পিতা ও মাতা আমার ডান পাশে ও বাম পাশে বসেছিলেন। আর ঐ আনসারিয়া মহিলাটি যে এসেছিল সে দরযার উপর বসেছিল।” তাতে রয়েছে যে, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন আমাকে উপদেশ দেন এবং আমাকে আমার অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করেন তখন আমি বলি, হায়! কি লজ্জার কথা! আপনি এই মহিলাটির কথাও খেয়াল করছেন না?” ঐ বর্ণনায় আছে যে, তিনি বলেনঃ “আমিও আল্লাহ তা'আলার হামদ ও সানার পর উত্তর দিয়েছিলাম।” ঐ সময় আমি হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর নাম স্মরণ করবার খুবই চেষ্টা করি, কিন্তু তাঁর নামটি এমনভাবে বিস্মৃত হই যে, কোনক্রমেই তা স্মরণ করতে পারিনি। তাই আবু ইউসুফ (ইউসুফের আঃ পিতা) বলে ফেলি।” তাতে আছেঃ “অহী অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন আমাকে শুভ সংবাদ প্রদান করেন, আল্লাহর শপথ! ঐ সময় আমার চিন্তাপূর্ণ ক্রোধ চরমে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি আমার পিতা-মাতাকে বলেছিলাম, এই ব্যাপারে আমি আপনাদের নিকটও কৃতজ্ঞ নই। আপনারা একটা কথা শুনেছেন, কিন্তু শুনে তা আপনারা অস্বীকারও করেননি এবং একটু লজ্জাবোধও করেননি।” ঐ বর্ণনায় আরো আছেঃ “যারা এই অপবাদ রচনা করেছিল তারা হলো-হিমনাহ, মিসতাহ্, হাসসান ইবনে সাবিত এবং মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। এই মুনাফিকই প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সবচেয়ে বেশী এ খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছিল।”
অন্য হাদীসে আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমার ওযরের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) দু’জন পুরুষ ও একজন স্ত্রীলোককে অপবাদের হদ লাগিয়েছিলেন। তারা হলোঃ হযরত ইবনে আসাসাহ (রাঃ) ও হিমনাহ্ বিনতে জহশ (রাঃ)।
অন্য একটি রিওয়ইয়াতে আছে যে, যখন হযরত আয়েশা (রাঃ) তাঁর অপবাদের খবর জানতে পারেন এবং এটাও জানতে পারেন যে, ঐ খবর তাঁর। পিতা-মাতা ও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কানেও পৌঁছে গেছে তখন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। কিছুটা জ্ঞান ফিরলে তার শরীর জ্বরে খুবই গরম হয়ে যায় এবং তিনি খুব কাঁপতে থাকেন। তাঁর মাতা তৎক্ষণাৎ তার গায়ে লেপ চাপিয়ে দেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তথায় আগমন করেন এবং তার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। উত্তরে বলা হয় যে, তাঁর খুবই জ্বর হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “সম্ভবতঃ এ খবর শুনেই তার অবস্থা এমন হয়েছে।” যখন তার ওযরের আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয় তখন তিনি আয়াতগুলো শুনে নবী (সঃ)-কে বলেনঃ “এটা আল্লাহ তা'আলারই অনুগ্রহ, আপনার নয়।” তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে এরূপ কথা বলছো?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “হ্যা।”
আয়াতগুলোর ভাবার্থ হলোঃ যারা এই অপবাদ রচনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল। তারা সংখ্যায় কয়েকজন। হে আবু বকর (রাঃ)-এর পরিবার। তোমরা এটাকে তোমাদের জন্যে অনিষ্টকর মনে করো না। বরং ফলাফলের দিক দিয়ে দ্বীন ও দুনিয়ায় এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। দুনিয়ায় তোমাদের সত্যবাদিতা প্রমাণিত হবে এবং আখিরাতে তোমরা উচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে নির্দোষ প্রমাণকারী আয়াতসমূহ কুরআন কারীমে অবতীর্ণ হবে, যার আশে পাশে মিথ্যা আসতেই পারে না। এ কারণেই যখন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশার মৃত্যুকাল ঘনিয়ে আসে তখন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তাঁর কাছে হাযির হয়ে বলেনঃ “আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন! আপনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পত্নী। তিনি আপনাকে খুবই মহব্বত করতেন এবং আপনি ছাড়া তিনি অন্য কোন কুমারী নারীকে বিয়ে করেননি। আপনার দোষমুক্তি সম্বলিত আয়াতসমূহ আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জহশ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত আয়েশা (রাঃ) ও হযরত যয়নব (রাঃ) নিজ নিজ প্রশংসনীয় গুণাবলীর বর্ণনা দিতে শুরু করেন। হযরত যয়নব (রাঃ) বলেনঃ “আমি ঐ মহিলা যার বিবাহ আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “আমার সততা ও পবিত্রতার সাক্ষ্য কুরআন কারীমে আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।” যখন হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল (রাঃ) আমাকে তার সওয়ারীর উপর বসিয়ে নিয়েছিলেন। হযরত যয়নব (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ “ ঐ সময় আপনি কি কালেমা পাঠ করেছিলেন?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “ঐ সময় আমি পাঠ করেছিলামঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আমার জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কার্য সম্পাদনকারী।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেছেন) একথা শুনে হযরত যয়নব (রাঃ) বলেনঃ “আপনি মুমিনদের কালেমা পাঠ করেছিলেন।”
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ যারা (হযরত আয়েশার রাঃ) প্রতি এই অপবাদ রচনা করেছে তাদের প্রত্যেকের জন্যে আছে পাপ কর্মের ফল। আর তাদের মধ্যে যে এই ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্যে আছে কঠিন শাস্তি। এর দ্বারা অভিশপ্ত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালকে বুঝানো হয়েছে। সঠিক উক্তি এটাই। তবে কেউ কেউ বলেছেন যে, এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ)-কে। কিন্তু এ উক্তিটি সঠিক নয়। এ উক্তিটিও আছে বলেই আমরা এটা বর্ণনা করলাম। কেননা, হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রাঃ) মর্যাদা সম্পন্ন সাহাবীদের একজন। তাঁর বহু ফযীলত ও বুযর্গীর কথা হাদীসসমূহে বিদ্যমান রয়েছে। ইনিই ছিলেন ঐ ব্যক্তি যিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পক্ষ থেকে কাফির কবিদের নিন্দাসূচক কবিতাগুলোর জবাব দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেছিলেনঃ “তুমি কাফিরদের নিকৃষ্টতা বর্ণনা কর, তোমার সাথে হযরত জিবরাঈল (আঃ) রয়েছেন।”
হযরত মাসরূক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “আমি হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট ছিলাম, এমন সময় হযরত হাসসান (রাঃ) সেখানে আগমন। রুন। হযরত আয়েশা (রাঃ) তাকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বসতে দেন এবং তাঁর জন্যে গদি বিছাবার নির্দেশ দেন। তিনি ফিরে গেলে আমি হযরত আয়েশা (ল-কে জিজ্ঞেস করলামঃ আপনি কেন তাকে আপনার কাছে আসতে দেন? তার আগমনে কি লাভ? আল্লাহ তাআলা তো বলেছেনঃ “অপবাদ রচনায় সে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্যে আছে কঠিন শাস্তি।” উত্তরে হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “অন্ধত্বের চেয়ে বড় ও কঠিন শাস্তি আর কি হতে পারে?” তার চক্ষু অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই তিনি বলেনঃ “সম্ভবতঃ আল্লাহ তা'আলা এটাকেই কঠিন শাস্তি বলেছেন।” অতঃপর তিনি বলেনঃ “তুমি কি খবর রাখো যে, এই লোকটিই তো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পক্ষ থেকে কাফিরদের নিন্দাসূচক কবিতার জবাব দেবার কাজে নিযুক্ত ছিল?”
হযরত আমের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “হাসসান (রাঃ)-এর কবিতা অপেক্ষা উত্তম কবিতা আমার চোখে পড়ে না। যখনই আমি তার ঐ কবিতাটি পাঠ করি তখনই আমার মনে খেয়াল জাগে যে, হাসসান জান্নাতী। কবিতাটি সে আবু সুফিয়ান ইবনে হারিস ইবনে আবদিল মুত্তালিবকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন।” (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেন) কবিতাটি হলোঃ (আরবি)
অর্থাৎ “তুমি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর দুর্নাম করেছো তাই আমি তার জবাব দিচ্ছি এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে আমি এর প্রতিদান লাভ করবো। আমার বাপ-দাদা এবং আমার ইযযত আবরূ সবই মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপর কুরবান হাৈক, আমি এ সবকিছু নিঃশেষ করে দিয়ে হলেও তোমার বদ যবানের মুকাবিলা করতে পিছ পা হবো না। তোমার মত একজন লোক যে আমার নবী (সঃ)-এর পায়ের তালুরও সমান হতে পারে না, তুমি আবার আমার নবী (সঃ)-এর দুর্নাম করছো? স্মরণ রেখো যে, তোমার মত একজন দুষ্ট লোক আমাদের নবী (সঃ)-এর মত একজন মহান ও সৎ লোকের উপর উৎসর্গীকৃত। তুমি যখন আমাদের নবী (সঃ)-এর দুর্নাম করছো তখন দোষমুক্ত তীক্ষ্ণ তরবারীর চাইতেও তীক্ষ্ণ আমার যবান থেকে তুমি রক্ষা পেতে পার না। জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে উম্মুল মুমিনীন (রাঃ)! এটা কি বাজে কথা নয়?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “কখনই নয়। বাজে কথা তো হচ্ছে কবিদের ঐ সব কথা যা নারীদের সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আবার প্রশ্ন করা হয়ঃ “কুরআন কারীমে কি আল্লাহ তা'আলা বলেননি যে, এই অপবাদ রচনার ব্যাপারে যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে তার জন্যে আছে কঠিন শাস্তি?” জবাবে তিনি বলেনঃ “হ্যাঁ, বলেছেন বটে। কিন্তু যে শাস্তি তাকে দেয়া হয়েছে তা কি কঠিন ও বড় শাস্তি নয়? তার চক্ষু নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। হযরত সাফওয়ান ইবনে মুআত্তাল (রাঃ) যখন শুনতে পান যে, হাসসান তাঁর দুর্নাম করেছে তখন তিনি তার উপর তরবারী উত্তোলন করেন এবং তাকে হত্যা করে দিতে উদ্যত হন। কিন্তু কি মনে করে হত্যা করা হতে বিরত থাকেন।
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings