Surah Al Fatihah Tafseer
Tafseer of Al-Fatihah : 2
Saheeh International
[All] praise is [due] to Allah, Lord of the worlds -
Ibn Kathir Partial
Tafseer 'Ibn Kathir Partial' (BN)
دال ও لام এর হরকত প্রসঙ্গ
সাতজন ক্বারীই (তারা হলেন ইবনু আমির, ইবনু কাসীর, ‘আসিম, আবূ ‘আমর, হামযাহ, নাফি‘, আল কাসায়ী) الحمد এর دال বর্ণে পেশ দিয়ে পড়ে থাকেন। আর এমতাবস্থায় তা তথা الحمد لله কে مبتداء وخبر বা উদ্দেশ্য ও বিধেয় বলে থাকেন।
আর সুফইয়ান ইবনু ‘উয়াইনাহ এবং রু’বাহ ইবনু আজ্জাজের মতে دال বর্ণে যবর হবে। তাদের মতে এখানে ক্রিয়া পদটি উহ্য আছে।
ইবনু আবি ‘আবলাহ الحمدُ এর دال এবং لله এর প্রথম لام বর্ণে পেশ দিয়ে ‘লাম’ কে প্রথমটির অনুগামী করে পড়তেন। এর স্বপক্ষে অনেক শাহিদ বা প্রমাণ থাকলেও এটা শায বা বিরল।
আর হাসান বাসরী ও যায়দ ইবনু ‘আলী (রাঃ) উক্ত দু’ অক্ষরের মধ্যে دال কে لام এর অনুগামী ধরে যের দিয়ে পড়ে থাকেন।
‘হামদ’ শব্দের অর্থ
ইমাম ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন যে, اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ-এর অর্থ এই যে, কৃতজ্ঞতা শুধু মহান আল্লাহর জন্য, তিনি ছাড়া আর কেউ এর যোগ্য নয়, তা সে সৃষ্ট জীবের মধ্যে যে কেউ হোক না কেন। কেননা সমুদয় দান যা আমরা গণনা করতে পারি না এবং তার মালিক ছাড়া কারো সেই সংখ্যা জানা নেই, সবই তাঁর কাছ থেকেই আগত। তিনিই তাঁর আনুগত্যের সমুদয় মালমসলা আমাদের দান করেছেন। আমরা যেন তাঁর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে পারি সেজন্য তিনি আমাদেরকে শারীরিক সমুদয় নি‘য়ামত দান করেছেন। তারপর ইহলৌকিক অসংখ্য নি‘য়ামত এবং জীবনের সমস্ত প্রয়োজন আমাদের অধিকার ছাড়াই তিনি আমাদের নিকট না চাইতেই পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সদা বিরাজমান অনুকম্পা এবং তাঁর প্রস্তুতকৃত পবিত্র সুখের স্থান, সেই অবিনশ্বর জান্নাত আমরা কিভাবে লাভ করতে পারি তাও তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন। সুতরাং আমরা এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, এসবের যিনি মালিক, প্রথম ও শেষ সমুদয় কৃতজ্ঞতা একমাত্র তাঁরই ন্যায্য প্রাপ্য। (তাফসীর তাবারী ১/১৩৫)
‘হাম্দ’ ও ‘শোক্র’ এর মধ্যে পার্থক্য
ইবনু জারীর (রহঃ) বলেন اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ একটি প্রশংসামূলক বাক্য। মহান আল্লাহ নিজের প্রশংসা নিজেই করেছেন এবং ঐ প্রসঙ্গেই তিনি যেন বলে দিলেনঃ তোমরা বলো اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ অর্থাৎ ‘সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহর জন্য।’
তিনি বলেন, কেউ কেউ এ কথাও বলেন যে, ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলে আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র নাম ও বড় বড় গুণাবলীর দ্বারা তাঁর প্রশংসা করা হয়। (তাফসীর তাবারী ১/১৩৭) আর اَلشُّكْرُ للهِ বলে তাঁর দান ও অনুগ্রহের ফলে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। তবে এ কথাটি সঠিক নয়। কেননা ‘আরবী ভাষায় যাঁরা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন তাঁরা এ বিষয়ে এক মত যে, شُكر-এর স্থলে حَمْد ও حَمْد-এর স্থলে شُكر ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জা‘ফর সাদিক ও ইবনু ‘আতা (রহঃ) প্রমুখ সূফীগণ এমনটি বলেছেন। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক কৃতজ্ঞের কৃতজ্ঞতা প্রকাশক কথা হলো اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ। কুরতুবী ইবনু জারীরের সমর্থনে দালীল এনে বলেন যে, কেউ যদি اَلْحَمْدُ للهِ شُكْرًا বলে তবে এটাও নির্ভুল হবে। ইবনু জারীর যে মত পোষণ করেন তা গবেষণার বিষয়। কেননা পরবর্তি অনেক ‘উলামাগণ কর্তৃক প্রসিদ্ধতা লাভ করেছে যে, প্রশংসিত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ গুণাবলীর জন্য বা পরোক্ষ গুণাবলীর জন্য মুখে তাঁর প্রশংসা করার নাম ‘হামদ’। আর শুধুমাত্র পরোক্ষ গুণাবলীর জন্য তাঁর প্রশংসা করার নাম শুকর। আর তা অন্তর, ভাষা, কাজের মাধ্যমে সংঘটিত হয়ে থাকে। যেমন কবির উক্তিঃ أَفَادَتْكُمُ النَّعْمَاءُ مِنِّيْ ثَلَاثَةٌ ... يَدِيْ وَلِسَانِيْ وَالضَّمِيْرُ الْمُحَجَّبَا
তবে তাঁরা حمد এবং شكر এর মধ্যে কোনটি আম এ বিষয়ে দু’টি উক্তি করেছেন। বাস্তবতা হলো এ শব্দ দু’টির মাঝে ‘আম ও খাস এর সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় গুণের সাথেই সমভাবে সম্পর্কিত ও সংযুক্ত থাকার কারণে এক দিক থেকে حمد শব্দটি شكر শব্দ হতে ‘আম। আবার শুধু জিহবা দিয়ে তা উচ্চারণ করা হয় বিধায় তা خاص এবং شكر শব্দটিই হচ্ছে ‘আম। কেননা তা কথা, কাজ ও নিয়তের মাধ্যমে সংঘটিত হয় যা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। আবার পরোক্ষ গুণের ওপর বলা হয় বলে شكر শব্দটি خاص। যেমন পবিত্রতার ওপর شكرته বলা হয় না কিন্তু شكرته على كرمه وإحسانه إليّ বলা যায়। সঠিকটি মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
আবূ নাসর ইসমা‘ঈল ইবনু হাম্মাদ আল জাওহারী (রহঃ) বলেন যে حمد অর্থাৎ প্রশংসা শব্দটি ذم তথা নিন্দা বা তিরস্কারের উল্টো। যেমন বলা হয়,
ومحمدة فهو حميد ومحمود حَمِدت الرجل أحمده حمدًا
التحميد শব্দটি حمد এর চেয়ে অর্থের আধিক্যতা রাখে। আর حمد শব্দটি شكر শব্দের চেয়ে ‘আম। তিনি বলেন দাতার দানের ওপর তার প্রশংসা করাকে ‘আরবী ভাষায় شكر বলা হয়। شكرته এবং شكرت له দু’ভাবেই বলা যায়। তবে লাম যোগে বলাই উত্তম। আর مدح শব্দটি حمد হতেও বেশি ‘আম। কেননা জীবিত ও মৃত এমনকি জড় পদার্থের ক্ষেত্রেও مدح শব্দটি প্রয়োগ হয়ে থাকে। অনুগ্রহের পূর্বে ও পরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গুণাবলীর ওপর তার ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে বলেই এটা আম হওয়া সাব্যস্ত। সঠিকটি মহান আল্লাহই ভালো জানেন।
‘হাম্দ’ শব্দের তাফসীর ও সালাফগণের অভিমত
‘উমার (রাঃ) একবার বলেছিলেনঃ سُبْحَانَ اللهِ ও لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ এবং কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, اَللهُ أَكْبَرْ-কে আমরা জানি, কিন্তু اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ-এর ভাবার্থ কি? ‘আলী (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ ‘আল্লাহ তা‘আলা এ কথাটিকে নিজের জন্য পছন্দ করেছেন। (তাফসীর তাবারী ১/১৫। অত্র হাদীসের সনদে হাজ্জাজ ইবনু আরতাত সম্পর্কে হাফিয ইবনু হাজার আসকালানী বলেন যে, তিনি সত্যবাদী, তবে খুব বেশি ভুল করতেন এবং তাদলীস করে বর্ণনা করতেন। উসতায কে বাদ দিয়ে উসতাযের উসতায বা উর্দ্ধতন কারো থেকে বর্ণনা করাকে তাদলীস বলে) কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, এটা বললে মহান আল্লাহকে খুবই ভালো লাগে।’ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ ‘এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশক বাক্য। এর উত্তরে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। (তাফসীর তাবারী ১/১৩) সুতরাং এ কথাটির মধ্যে মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা ছাড়াও তার দানসমূহ, হিদায়াত, অনুগ্রহসহ প্রভৃতির স্বীকারোক্তি রয়েছে। কা‘ব আহবার (রাঃ)-এর মত হলো এ কথাটি মহান আল্লাহর প্রশংসামূলক।
যাহহাক (রহঃ) বলেন, মহান আল্লাহর চাদর। হাদীসেও এটা আছে। ইবনু জারীর (রহঃ) হাকাম ইবনু ‘উমায়ির (রাঃ)-এর সূত্রে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ বললেই মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়ে যাবে। এবং তিনি আরো বাড়িয়ে দিবেন। (তাফসীর তাবারী, হাদীসটি য‘ঈফ) তাফসীরে তাবারী, হাদীসটি য‘ঈফ।
‘আল-হাম্দ’ শব্দের গুরুত্ব ও ফাযীলত
আসওয়াদ ইবনু সারী’ (রাঃ) একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে আরয করেনঃ ‘আমি মহান আল্লাহর প্রশংসামূলক কয়েকটি কবিতা রচনা করেছি। অনুমতি পেলে শুনিয়ে দিবো।’ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ أَمَا إِنَّ رَبَّكَ يُحِبُّ الْحَمْدَ
‘তোমার প্রতিপালক তথা মহান আল্লাহ নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন।’ (মুসনাদ আহমাদ ৩/৪৩৫, সুনান নাসাঈ ৪/৪১৬) মুসনাদ আহমাদ, সুনান নাসাঈ, জামি‘উত তিরমিযী এবং সুনান ইবনু মাজাহ্য় ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ أفضل الذكر لا إله إلا الله، وأفضل الدعاء الحمد لله.
‘সর্বোত্তম যিক্র হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এবং সর্বোত্তম প্রার্থনা হচ্ছে ‘আলহামদুলিল্লাহ।’ (হাদীসটি হাসান। জামি‘তিরমিযী ৯/৩২৪, সুনান নাসাঈ ৬/২০৮, ইবনু মাজাহ ২/১২৪৯) ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এ হাদীটিকে পরিভাষা অনুযায়ী ‘হাসান গারীব’ বলেছেন। সুনান ইবনু মাজায় রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
"ما أنعم الله على عبد نعمة فقال: الحمد لله إلا كان الذي أعطى أفضل مما أخذ"
‘মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কিছু দান করার পর যদি সে তাঁর জন্য ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পাঠ করে তাহলে তাঁর প্রদত্ত বস্তুই গৃহীত বস্তু হতে উত্তম হবে।’ (ইবনু মাজাহ ২/১২৫০, জামি‘তিরমিযী ৫/৩৩৮৫)
নাওয়াদিরুল উসূল নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন যেঃ لو أن الدنيا بحذافيرها في يد رجل من أمتي ثم قال: الحمد لله، لكان الحمد لله أفضل من ذلك
আমার উম্মাতের কোন ব্যক্তির হাতে দুনিয়া ভর্তি কিছু দেয়া হয় অতঃপর সে তাতে শুকরিয়া স্বরূপ ‘আল হামদু লিল্লাহ’ বলে, তাহলে তাকে প্রদত্ত বস্তু অপেক্ষা ‘আল হামদু লিল্লাহ’ উত্তম হবে। (হাদীসটি মাওযু)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় কুরতবী (রহঃ) ও অন্যান্যরা বলেনঃ এর ভাবার্থ হলো, ‘আল হামদু লিল্লাহ’ বলার তাওফীক লাভ যতো বড় নি‘য়ামত, সারা দুনিয়া দান করাও ততো বড় নি‘য়ামত নয়। কেননা দুনিয়া তো নশ্বর ও ধ্বংসশীল, কিন্তু একথার পুণ্য অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। যেমন পবিত্র কুর’আনের মধ্যে রয়েছেঃ الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا.
‘ধন-সম্পদ আর সন্তানাদি পার্থিব জীবনের শোভা-সৌন্দর্য। আর তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার লাভের জন্য স্থায়ী সৎকাজ হলো উৎকৃষ্ট। আর আকাক্সক্ষা পোষণের ভিত্তি হিসেবেও উত্তম।” (১৮ নং সূরাহ আল কাহাফ, আয়াত -৪৬)
সুনান ইবনু মাজায় ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ একবার এক ব্যক্তি এই দু‘আ পাঠ করলোঃ
يَارَبِّ لَكَ الْحَمْدُ كَمَا يَيْبَغِيْ لِجَلَالِ وَجْهِكَ وَعَظِيْمِ سُلْطَانِكَ.
‘হে আমার রাব্ব! তোমার বিশাল ক্ষমতা এবং মহান সত্ত্বার মর্যাদানুসারে তোমার জন্যই সমস্ত প্রশংসা।’ এতে ফিরিশতা সাওয়াব লিখার ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। অবশেষে তাঁরা মহান আল্লাহর নিকট আরয করলেনঃ আপনার এক বান্দা এমন একটি কালিমা পাঠ করেছে যার সাওয়াব আমরা কি লিখবো বুঝতে পারছিনা।’ বিশ্বপ্রভু সব কিছু জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলেনঃ ‘সে কি কথা বলেছে? তাঁরা বললেন যে, সে এই কালিমা বলেছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা বললেনঃ
اُكْتُبْاهَا كَمَا قَالَ عَبْدِيْ حَتَّى يَلْقَانِيْ فَأُجْزِيْهِ بِهَا
‘সে যা বলেছে তোমরা হুবহু তাই লিখে নাও। আমি তার সাথে সাক্ষাতের সময়ে নিজেই তার যোগ্য প্রতিদান দিবো।’ (সুনান ইবনু মাজাহ ২/৩৮০১, হাদীস য‘ঈফ) কুরতুবী (রহঃ) ‘আলিমদের একটি দল হতে বর্ণনা করেছেন যে, ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হতেও ‘আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামীন’ উত্তম। কেননা এর মধ্যে ওয়াহদানিয়ত বা একত্ববাদ ও প্রশংসা দু’টোই বিদ্যমান। কিন্তু অন্যান্য বিদ্যানগণের ধারণা হলো ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উত্তম। কেননা ইমান ও কুফরের মাঝে পার্থক্যের সীমা রেখা এটাই। আর এটা বলার জন্যই কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা হয়। যেমনটি সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। (সহীহুল বুখারী ১/২৫, সহীহ মুসলিম ১/৮, ৩৩, ৩৬, ৫২, ৫৩, হাঃ ২২; আ.প্র. হাঃ ২৪, ই.ফা. হাঃ ২৪) অন্য একটি বর্ণনায় আছে মহানবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ أَفْضَلُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّوْنَ مِنْ قَبْلِيْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ
আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ যা উচ্চারণ করেছি তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু ...। (জামি‘ তিরমিযী ৫/৩৫৮৫, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক ১/৩২, ২১৪, ২১৫, সুনান বায়হাকী ৫/১১৭, হাদীস হাসান)
জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত মারফূ‘ হাদীস যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে তাতে আছে যে, أفضل الذكر لا إله إلا الله، وأفضل الدعاء الحمد لله.
‘সর্বোত্তম যিক্র হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এবং সর্বোত্তম প্রার্থনা হচ্ছে ‘আলহামদুলিল্লাহ।’ (ইবনু মাজাহ ২/১২৫০, জামি‘তিরমিযী ৫/৩৩৮৫) ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
‘হাম্দ’ শব্দের পূর্বে ‘আল’ শব্দ প্রয়োগের গুরুত্ব ও ফাযীলত
‘আল হামদু’-এর আলিফ লাম ‘ইসতিগরাকের’ জন্য ব্যবহৃত। অর্থাৎ সমস্ত প্রকারের ‘হাম্দ’ বা স্তুতিবাদ একমাত্র মহান আল্লাহরই জন্য সাব্যস্ত। যেমন হাদীসে রয়েছেঃ
اللّٰهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ كُلُّهُ وَلَكَ الْمُلْكُ كُلُّهُ وَبِيَدِكَ الْخَيْرُ كُلُّهُ وَإِلَيْكَ يَرْجِعُ الْأَمْرُ كُلُّهُ.
‘হে মহান আল্লাহ! সমুদয় প্রশংসা তোমারই জন্য, সারা দেশ তোমারই, তোমারই হাতে সামগ্রিক মঙ্গল নিহিত রয়েছে এবং সমস্ত কিছু তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করে থাকে।’ (আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২/৪৪১, হাদীস য‘ঈফ)
‘রাব্ব’ শব্দের অর্থ
সর্বময় কর্তাকে ‘রাব্ব’ বলা হয় এবং এর আভির্ধানিক অর্থ হচ্ছে নেতা এবং সঠিকভাবে সজ্জিত ও সংশোধনকারী। এসব অর্থ হিসাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য এ পবিত্র নামটিই শোভনীয় হয়েছে। ‘রাব্ব’ শব্দটি মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ব্যবহৃত হতে পারে না। তবে সম্বন্ধ পদ রূপে ব্যবহৃত হলে সে অন্য কথা। যেমন رَبُّ الدَّارِ বা গৃহস্বামী ইত্যাদি। বলা হয়েছে যে, রাব্ব হলো মহান আল্লাহর মহান নামসমূহের অন্যতম নাম।
‘আলামীন’ শব্দের অর্থ
عَالَمِيْنَ শব্দটি عَالَمٌ শব্দের বহু বচন। মহান আল্লাহ ছাড়া সমুদয় সৃষ্টবস্তুকে عَالَم বলা হয়। عَالَم শব্দটিও বহুবচন এবং এ শব্দের এক বচনই হয় না। আকাশের সৃষ্টজীব এবং পানি ও স্থলের সৃষ্টজীবকেও عَوَالِم অর্থাৎ কয়েকটি عَالَم বলা হয়। অনুরূপভাবে এক একটি যুগ-কাল ও এক একটি সময়কেও عَالَم বলা হয়। বিশর ইবনু ‘আম্মারাহ ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি তথা ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) عَالَمٌ এর তাফসীরে বলেছেন, এর দ্বারা সকল সৃষ্টিজীবকেই বুঝায়, নভোমণ্ডলের হোক বা ভূমণ্ডলের হোক, অথবা এ দুয়ের মাঝের কিছু হোক, আর তা আমাদের জানা হোক বা না জানা হোক। ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) হতে এর ভাবার্থও বর্ণিত হয়েছে যে, ربُّ الإنس والجن অর্থাৎ তিনি মানব দানব সকলেরই প্রতিপালক। সা‘ঈদ ইবনু যুবায়র (রহঃ) ও ‘আলী ইবনু আবি তালিব (রাঃ) হতে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। তবে ইবনু আবী হাতিম বলেন হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য নয়। উক্ত কথার প্রমাণ স্বরূপ ইমাম কুরতুবী (রহঃ) নিম্নের আয়াতটি পেশ করেছেনঃ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا‘যাতে সে বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারে।’ (২৫ নং সূরাহ আল ফুরক্বান, আয়াত-১)
ফার্রা (রহঃ) ও আবূ ‘উবাইদাহ (রহঃ)-এর মতে প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন প্রাণীকে ‘আলাম’ বলা হয়। যায়দ ইবনু আসলাম (রহঃ) এবং আবূ মুহাইসীন (রহঃ) বলেন যে, প্রত্যেক প্রাণীকেই ‘আলাম’ বলা হয়। কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, প্রত্যেক শ্রেণীকে একটা ‘আলাম বলা হয়।
ইবনু ‘আসাকির (রহঃ) বানূ উমাইয়্যার সর্বশেষ খলিফা মারওয়ান ইবনু মুহাম্মাদ ইবনু মারওয়ান ইবনুল হাকাম যার উপাধি ছিলো হিমার (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন: মহান আল্লাহ সতেরো হাজার ‘আলাম সৃষ্টি করেছেন। আকাশের অধিবাসী ও যমীনের অধিবাসী প্রত্যেকটি আলাম। বাকীগুলো মহান আল্লাহই ভালো জানেন। মানুষের নিকট ওগুলো অজ্ঞাত।
আবূ জা‘ফর আর রাযী (রহঃ) আবুল ‘আলিয়া (রহঃ) হতে رب العالمين এর ব্যাখ্যা বর্ণনা করে বলেন, সমস্ত মানুষ একটা ‘আলাম। আর সমস্ত জ্বিন একটা ‘আলাম। তবে এছাড়াও আরো ১৮ হাজার বা ১৪ হাজার আলাম আছে। কিছু ফিরিশতা যমীনে আছে, আর যমীনের ৪টি প্রান্ত আছে। প্রত্যেক প্রান্তে সাড়ে তিন হাজার ‘আলাম তথা জগত রয়েছে। তাদেরকে মহান আল্লাহ শুধুমাত্র তাঁর ‘ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। ইবনু জারীর ও ইবনু আবী হাতিম(রহঃ) ও বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি সম্পূর্ণ গারীব বা অপরিচিত। তবে এ ধরনের কথা যে পর্যন্ত সহীহ দালীল ও অকাট্য প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত না হবে ততক্ষোণ পর্যন্ত তা মানবার উপযুক্ত নয়।
‘রাব্বুল ‘আলামীন’ এর ব্যাখ্যায় ইবনু আবী হাতিম হুমাইরী (রহঃ) সূত্রে বর্ণনা করেন যে, বিশ্ব জাহানে এক হাজার জাতি আছে। যার ছয়শ’ জাতি পানিতে বাস করে এবং চার শত জাতি স্থলে বাস করে। সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (রহঃ) থেকেও অনরূপ বর্ণনা রয়েছে।
আবূ ইয়া‘লা (রহঃ) জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ থেকে মারফূ‘ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, ‘উমার (রাঃ)-এর শাসনামলের কোন এক বছর টিড্ডি বা ফড়িং দেখা যাচ্ছিলো না। ফলে তিনি এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কোন সংবাদ তিনি সংগ্রহ করতে পারলেন না। ফলে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং এক পর্যায়ে তিনি ইয়ামান, সিরিয়া ও ‘ইরাকের দিকে অশ্বারোহী পাঠিয়ে দিলেন সে সব দেশে টিড্ডি বা ফড়িং দেখা যাচ্ছে কি না তা জানার জন্য। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর ইয়ামানের উদ্দেশ্যে প্রেরিত অশ্বারোহী দল এক মুষ্টি টিড্ডি বা ফড়িং নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হয়ে তাঁর সামনে সেগুলো ছেড়ে দিলেন। ‘উমার (রাঃ) সেগুলো দেখতে পেয়ে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে উঠে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘মহান আল্লাহর এক হাজার জাতি আছে। যার ছয়শ’ জাতি পানিতে বাস করে এবং চার শত জাতি স্থলে বাস করে। অতঃপর এই উম্মাতের সর্বোপ্রথম যে জাতি ধ্বংস হবে তা হলো টিড্ডি বা ফড়িং। আর যখন এ জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে তখন অন্যান্য জাতি তাসবীহের সূতা কেটে কাটি গুলো একের পর এক পরে যাওয়ার ন্যায় পরে যেতে থাকবে।’ কিন্তু এ হাদীসের সূত্রে মুহাম্মাদ ইবনু ‘ঈসা হিলালী নামক একজন দুর্বল রাবী‘ রয়েছে বিধায় হাদীসটি য‘ঈফ।
ইমাম বাগাবী (রহঃ) ও সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহঃ) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করে বলেন যে, তিনি অর্থাৎ সা‘ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব (রহঃ) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর এক হাজার জাতি আছে। যার ছয় শত জাতি জলে বাস করে এবং চার শত জাতি স্থলে বাস করে।’
ওয়াহাব ইবনু মুনাব্বিহ (রহঃ) বলেন, ‘মহান আল্লাহর আঠারো হাজার ‘আলাম তথা জগৎ আছে। পৃথিবীও একটি ‘আলাম।
মুকাতিল (রহঃ) বলেন, মোট আশি হাজার ‘আলাম আছে। আর কা‘বুল আহবার বলেন যে, ‘আলামের প্রকৃত সংখ্যা মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ জানে না। এ সবই ইমাম বাগাবী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন।
জায্যায (রহঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ইহজগত ও পরজগতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সবই ‘আলাম। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন যে, এ মতটিই সত্য। কেননা এর মধ্যে সমস্ত ‘আলামই জড়িত রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনঃ
قَالَ فِرْعَوْنُ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِيْنَ. قَالَ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِنْ كُنْتُمْ مُوْقِنِيْنَ.
ফির‘আউন বললোঃ জগতসমূহের রাব্ব আবার কি? মূসা বললোঃ তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুর রাব্ব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। (২৬ নং সূরাহ্ শু‘আরা, আয়াত নং ২৩-২৪)
সৃষ্টবস্তুকে ‘আলাম’ বলার কারণ
عَلم শব্দটি عَلَامَت শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। কেননা ‘আলাম’ সৃষ্ট বস্তু তার সৃষ্টিকারীর অস্তিত্বের পরিচয় বহন করে এবং তাঁর একাত্মবাদের চিহ্নরূপে কাজ করে থাকে। (তাফসীর কুরতুরী ১/১৩৯) যেমন কবি ইবনু মু‘তায এর কথাঃ
فيا عجبا كيف يعصى الإله ... أم كيف يجحده الجاحد
وفي كل شيء له آية ... تدل على أنه واحد
‘এটা একটি বিস্বয়কর বিষয় যে, কিভাবে মানুষ মহান আল্লাহর অবাধ্য হতে পারে এবং কেমনে অস্বীকারকারী তাকে অস্বীকার করে। অথচ প্রতিটি বিষয়ের মধ্যে এমন স্পষ্ট নিদর্শন আছে যে, তা প্রকাশ্যভাবে মহান আল্লাহর একত্ববাদের পরিচয় বহন করছে।’
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Be our beacon of hope! Your regular support fuels our mission to share Quranic wisdom. Donate monthly; be the change we need!
Are You Sure you want to Delete Pin
“” ?
Add to Collection
Bookmark
Pins
Social Share
Share With Social Media
Or Copy Link
Audio Settings