Surah Al Isra Tafseer

Surah
Juz
Page
1
Al-Fatihah
The Opener
001
2
Al-Baqarah
The Cow
002
3
Ali 'Imran
Family of Imran
003
4
An-Nisa
The Women
004
5
Al-Ma'idah
The Table Spread
005
6
Al-An'am
The Cattle
006
7
Al-A'raf
The Heights
007
8
Al-Anfal
The Spoils of War
008
9
At-Tawbah
The Repentance
009
10
Yunus
Jonah
010
11
Hud
Hud
011
12
Yusuf
Joseph
012
13
Ar-Ra'd
The Thunder
013
14
Ibrahim
Abraham
014
15
Al-Hijr
The Rocky Tract
015
16
An-Nahl
The Bee
016
17
Al-Isra
The Night Journey
017
18
Al-Kahf
The Cave
018
19
Maryam
Mary
019
20
Taha
Ta-Ha
020
21
Al-Anbya
The Prophets
021
22
Al-Hajj
The Pilgrimage
022
23
Al-Mu'minun
The Believers
023
24
An-Nur
The Light
024
25
Al-Furqan
The Criterion
025
26
Ash-Shu'ara
The Poets
026
27
An-Naml
The Ant
027
28
Al-Qasas
The Stories
028
29
Al-'Ankabut
The Spider
029
30
Ar-Rum
The Romans
030
31
Luqman
Luqman
031
32
As-Sajdah
The Prostration
032
33
Al-Ahzab
The Combined Forces
033
34
Saba
Sheba
034
35
Fatir
Originator
035
36
Ya-Sin
Ya Sin
036
37
As-Saffat
Those who set the Ranks
037
38
Sad
The Letter "Saad"
038
39
Az-Zumar
The Troops
039
40
Ghafir
The Forgiver
040
41
Fussilat
Explained in Detail
041
42
Ash-Shuraa
The Consultation
042
43
Az-Zukhruf
The Ornaments of Gold
043
44
Ad-Dukhan
The Smoke
044
45
Al-Jathiyah
The Crouching
045
46
Al-Ahqaf
The Wind-Curved Sandhills
046
47
Muhammad
Muhammad
047
48
Al-Fath
The Victory
048
49
Al-Hujurat
The Rooms
049
50
Qaf
The Letter "Qaf"
050
51
Adh-Dhariyat
The Winnowing Winds
051
52
At-Tur
The Mount
052
53
An-Najm
The Star
053
54
Al-Qamar
The Moon
054
55
Ar-Rahman
The Beneficent
055
56
Al-Waqi'ah
The Inevitable
056
57
Al-Hadid
The Iron
057
58
Al-Mujadila
The Pleading Woman
058
59
Al-Hashr
The Exile
059
60
Al-Mumtahanah
She that is to be examined
060
61
As-Saf
The Ranks
061
62
Al-Jumu'ah
The Congregation, Friday
062
63
Al-Munafiqun
The Hypocrites
063
64
At-Taghabun
The Mutual Disillusion
064
65
At-Talaq
The Divorce
065
66
At-Tahrim
The Prohibition
066
67
Al-Mulk
The Sovereignty
067
68
Al-Qalam
The Pen
068
69
Al-Haqqah
The Reality
069
70
Al-Ma'arij
The Ascending Stairways
070
71
Nuh
Noah
071
72
Al-Jinn
The Jinn
072
73
Al-Muzzammil
The Enshrouded One
073
74
Al-Muddaththir
The Cloaked One
074
75
Al-Qiyamah
The Resurrection
075
76
Al-Insan
The Man
076
77
Al-Mursalat
The Emissaries
077
78
An-Naba
The Tidings
078
79
An-Nazi'at
Those who drag forth
079
80
Abasa
He Frowned
080
81
At-Takwir
The Overthrowing
081
82
Al-Infitar
The Cleaving
082
83
Al-Mutaffifin
The Defrauding
083
84
Al-Inshiqaq
The Sundering
084
85
Al-Buruj
The Mansions of the Stars
085
86
At-Tariq
The Nightcommer
086
87
Al-A'la
The Most High
087
88
Al-Ghashiyah
The Overwhelming
088
89
Al-Fajr
The Dawn
089
90
Al-Balad
The City
090
91
Ash-Shams
The Sun
091
92
Al-Layl
The Night
092
93
Ad-Duhaa
The Morning Hours
093
94
Ash-Sharh
The Relief
094
95
At-Tin
The Fig
095
96
Al-'Alaq
The Clot
096
97
Al-Qadr
The Power
097
98
Al-Bayyinah
The Clear Proof
098
99
Az-Zalzalah
The Earthquake
099
100
Al-'Adiyat
The Courser
100
101
Al-Qari'ah
The Calamity
101
102
At-Takathur
The Rivalry in world increase
102
103
Al-'Asr
The Declining Day
103
104
Al-Humazah
The Traducer
104
105
Al-Fil
The Elephant
105
106
Quraysh
Quraysh
106
107
Al-Ma'un
The Small kindnesses
107
108
Al-Kawthar
The Abundance
108
109
Al-Kafirun
The Disbelievers
109
110
An-Nasr
The Divine Support
110
111
Al-Masad
The Palm Fiber
111
112
Al-Ikhlas
The Sincerity
112
113
Al-Falaq
The Daybreak
113
114
An-Nas
Mankind
114

Al-Isra : 1

17:1
سُبْحَٰنَٱلَّذِىٓأَسْرَىٰبِعَبْدِهِۦلَيْلًامِّنَٱلْمَسْجِدِٱلْحَرَامِإِلَىٱلْمَسْجِدِٱلْأَقْصَاٱلَّذِىبَٰرَكْنَاحَوْلَهُۥلِنُرِيَهُۥمِنْءَايَٰتِنَآإِنَّهُۥهُوَٱلسَّمِيعُٱلْبَصِيرُ ١

Saheeh International

Exalted is He who took His Servant by night from al-Masjid al-Haram to al-Masjid al- Aqsa, whose surroundings We have blessed, to show him of Our signs. Indeed, He is the Hearing, the Seeing.

Tafseer 'Ibn Kathir Full' (BN)

সহীহ বুখারী শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সূরায়ে বাণী ইসরাঈল, সূরায়ে কাহাফ এবং সূরায়ে মারইয়াম সর্বপ্রথম, সর্বোত্তম এবং ফযীলতপূর্ণ সূরা।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) কখনো কখনো নফল রোযা এমনভাবে পর্যায়ক্রমে রেখে যেতেন যে, আমরা মনে মনে বলতাম, সম্ভবতঃ তিনি এই পুরো মাসটি রোযার অবস্থাতেই কাটিয়ে দিবেন। আবার কখনো কখনো মোটেই রোযা রাখতেন না। শেষ পর্যন্ত আমরা ধারণা করতাম যে, সম্ভবতঃ তিনি এই মাসে রোযা রাখবেনই না। তাঁর অভ্যাস ছিল এই যে, প্রত্যেক রাত্রে তিনি সূরায়ে বাণী ইসরাঈল ও সূরায়ে যুমার পাঠ করতেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদ' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

আল্লাহ তাআলা স্বীয় সত্তার পবিত্রতা, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব এবং ক্ষমতার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, তিনি সবকিছুর উপর পুর্ণক্ষমতাবান। তার ন্যায় ক্ষমতা কারো মধ্যে নেই। তিনিই ইবাদতের যোগ্য এবং একমাত্র তিনিই সমস্ত সৃষ্টজীবের লালনপালনকারী। তিনি তাঁর বান্দা অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদকে (সঃ) একই রাত্রির একটা অংশে মক্কা শরীফের মসজিদ হতে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যান, যা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) যুগ হতে নবীদের (আঃ) কেন্দ্রস্থল ছিল। এ কারণেই সমস্ত নবীকে (আঃ) সেখানে তাঁর পাশে একত্রিত করা হয় এবং তিনি সেখানে তাঁদেরই জায়গায় তাঁদের ইমামতি করেন। এটা একথাই প্রমাণ করে যে, বড় ইমাম ও অগ্রবর্তী নেতা তিনিই। আল্লাহর দুরূদ ও সালাম তাঁর উপর ও তাঁদের সবারই উপর বর্ষিত হোক।

মহান আল্লাহ বলেনঃ এই মসজিদের চতুষ্পৰ্শ আমি ফল-ফুল, ক্ষেতখামার, বাগ-বাগিচা ইত্যাদি দ্বারা বরকতময় করে রেখেছি। আমার এই মর্যাদা সম্পন্ন নবীকে (সঃ) আমার বড় বড় নিদর্শনাবলী প্রদর্শন করা-ই ছিল আমার উদ্দেশ্য, যেগুলি তিনি ঐ রাত্রে দর্শন করেছিলেন।।

আল্লাহ তাআলা তাঁর মু'মিন, কাফির, বিশ্বাসকারী এবং অস্বীকারকারী সমস্ত বান্দার কথা শুনে থাকেন এবং দেখে থাকেন। প্রত্যেককে তিনি ওটাই দেন যার সে হকদার, দুনিয়াতেও এবং আখেরাতেও।

মি'রাজ সম্পর্কে বহু হাদীস রয়েছে যেগুলি এখন বর্ণনা করা হচ্ছেঃ

হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মিরাজের রাত্রে যখন কা’বাতুল্লাহ শরীফ হতে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় সেই সময় তাঁর নিকট তিনজন ফেরেশতা আগমন করেন, তাঁর কাছে ওয়াহী করার পূর্বে। ঐ সময় তিনি বায়তুল্লাহ শরীফে শুয়ে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রথম জন জিজ্ঞেস করেনঃ “ইনি এই সবের মধ্যে কে?” মধ্যজন উত্তরে বলেনঃ “ইনি এসবের মধ্যে উত্তম।” তখন সর্বশেষজন বলেনঃ “তা হলে তাঁকে নিয়ে চল।” ঐ রাত্রে এটুকুই ঘটলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদেরকে দেখতে পেলেন না। দ্বিতীয় রাত্রে আবার ঐ তিনজন ফেরেশতা আসলেন। ঘটনাক্রমে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময়েও ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু তাঁর ঘুমন্ত অবস্থা এমনই ছিল যে, তাঁর চক্ষুদ্বয় ঘুমিয়েছিল বটে, কিন্তু তাঁর অন্তর ছিল জাগ্রত। নবীদের (আঃ) নিদ্রা এরূপই হয়ে থাকে। ঐ রাত্রে তাঁরা তাঁর সাথে কোন আলাপ আলোচনা করেন নাই। তাঁরা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে যমযম কূপের নিকট শায়িত করেন এবং হযরত জিবরাঈল (আঃ) স্বয়ং তাঁর বক্ষহতে গ্রীবা পর্যন্ত বিদীর্ণ করে দেন এবং বক্ষ ও পেটের সমস্ত জিনিস বের করে নিয়ে যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করেন।

যখন খুব পরিষ্কার হয়ে যায় তখন তাঁর কাছে একটা সোনার থালা আনয়ন করা হয় যাতে বড় একটি সোনার পেয়ালা ছিল। ওটা ছিল হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ। ওটা দ্বারা তাঁর বক্ষ ও গলার শিরাগুলিকে পূর্ণ করে দেন। তারপর বক্ষকে শেলাই করে দেয়া হয়। তারপর তাঁকে দুনিয়ার আকাশের দিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তথাকার দরজাগুলির একটিতে করাঘাত করা হয়। ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “কে?” উত্তরে বলা হয়ঃ “জিবরাঈল (আঃ)।” আবার তাঁরা প্রশ্ন করেনঃ “আপনার সাথে কে আছেন?” জবাবে তিনি বলেনঃ “আমার সাথে রয়েছেন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।” পুনরায় তারা জিজ্ঞেস করেনঃ “তঁাকে কি ডাকাহয়েছে?” হযরত জিবরাঈল (আঃ) উত্তর দেনঃ “হ” এতে সবাই খুবই খুশী হন এবং ‘মারহাবা’ বলে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁকে নিয়ে যান। যমীনে যে আল্লাহ তাআলা কি করতে চান তা আকাশের ফেরেশতারাও জানতে পারেন না। যে পর্যন্ত না তাদেরকে জানানো হয়। দুনিয়ার আকাশের উপর হযরত আদমের (আঃ) সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর সাথে রাসূলুল্লাহর (সঃ) পরিচয় করিয়ে দেন। তাঁকে বলেনঃ “ইনি আপনার পিতা হযরত আদম (আঃ)। তাঁকে সালাম দিন।” তিনি তাঁকে সালাম দেন। হযরত আদম (আঃ) সালামের জবাব দেন এবং মারহাবা বলে অভ্যর্থনা জানান ও বলেনঃ “আপনি আমার খুবই উত্তম ছেলে। সেখানে প্রবাহিত দু'টি নহর দেখে তিনি হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “এ নহর দু'টি কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “এ দু'টো হলো নীল ও ফোরাতের উৎস। তারপর তাঁকে আসমানে নিয়ে যান। তিনি আর একটি নহর দেখতে পান। তাতে ছিল মনিমুক্তার প্রাসাদ এবং ওর মাটি ছিল খাটি মিশকে আম্বর। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “এটা কি নহর?” উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “এটি হচ্ছে নহরে কাওসার। এটা আপনার প্রতিপালক আপনার জন্যে তৈরী করে রেখেছেন।” এরপর তাঁকে দ্বিতীয় আকাশে নিয়ে যান। তথাকার ফেরেশতাদের সাথেও অনুরূপ কথাবার্তা চলে। তারপর তাঁকে নিয়ে তৃতীয় আকাশে উঠে যান। সেখানকার ফেরেশতাদের সাথেও ঐরূপ প্রশ্ন ও উত্তরের আদান প্রদান হয় যেরূপ প্রথম ও দ্বিতীয় আকাশে হয়েছিল। অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহকে (সঃ) নিয়ে চতুর্থ আকাশে উঠে যান। তথাকার ফেরেশতাগণও অনুরূপ প্রশ্ন করেন ও উত্তর পান। তারপর পঞ্চম অকাশে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও অনুরূপ কথা শোনা যায়।

এরপর তাঁরা ষষ্ট আকাশে উঠে যান। সেখানেও এরূপই কথাবার্তা চলে। তারপর সপ্তম আকাশে গমন করেন এবং তথায়ও এরূপই কথাবার্তা হয়। (বর্ণনাকারী হযরত আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেনঃ প্রত্যেক আকাশে তথাকার নবীদের (আঃ) সাথে রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাদের নাম করেছিলেন। যাঁদের নাম আমার স্মরণ আছে তারা হলেনঃ দ্বিতীয় আকাশে হযরত ইদরীস (আঃ), চতুর্থ আকাশে হযরত হারূণ (আঃ), পঞ্চম আকাশে যিনি ছিলেন তাঁর নাম আমার মনে নেই, ষষ্ট আকাশে ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) এবং সপ্তম আকাশে ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)। হযরত মুহাম্মদের (সঃ) উপর এবং অন্যান্য সমস্ত নবীর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক।

যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) এখান হতেও উপরে উঠতে থাকেন তখন হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহ! আমার ধারণা ছিল যে, আমার চেয়ে বেশী উপরে আপনি আর কাউকেও উঠাবেন না। এখন ইনি (হযরত মুহাম্মদ (সঃ)। যে কত উপরে উঠাবেন তা একমাত্র আপনিই জানেন।” শেষ পর্যন্ত তিনি সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছে যান। অতঃপর তিনি আল্লাহ তাআলার অতি নিকটবর্তী হন। ফলে তাঁদের মধ্যে দু' ধনুকের ব্যবধান থাকে বা তাঁর চেয়েও কম। অতঃপর আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তাঁর কাছে ওয়াহী করা হয়, যাতে তাঁর উম্মতের উপর প্রত্যহ দিনরাত্রে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়। যখন তিনি সেখান হতে নেমে আসেন তখন হযরত মূসা (আঃ) তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে আপনি কি হুকুম প্রাপ্ত হলেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “দিন রাত্রে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায।” হযরত মূসা (আঃ) এ হুকুম শুনে বললেনঃ “এটা আপনার উম্মতের ক্ষমতার বাইরে। আপনি ফিরে যান এবং কমানোর জন্যে প্রার্থনা করুন।” তাঁর একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত জিবরাঈলের (আঃ) দিকে পরামর্শ চাওয়ার দৃষ্টিতে তাকান এবং তিনি ইঙ্গিতে সম্মতি দান করেন। সুতরাং তিনি পুনরায় আল্লাহ তাআলার নিকট গমন করেন এবং স্বস্থানে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেনঃ “হে আল্লাহ! হালকা করে দিন। এটা পালন করা আমার উম্মতের সাধ্য হবে না।” আল্লাহ তাআলা তখন দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) ফিরে আসলেন। হযরত মূসা (আঃ) আবার তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ “কি হলো?” জবাবে তিনি বললেনঃ “দশ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন।” একথা শুনে হযরত মূসা (আঃ) তাঁকে বললেনঃ “যান, আরো কমিয়ে আনুন।” তিনি আবার গেলেন। আবার কম করা হলো এবং শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায থাকলো। হযরত মূসা (আঃ) তাঁকে আবারও বললেনঃ “দেখুন, বাণী ইসরাঈলের মধ্যে আমি আমার জীবন কাটিয়ে এসেছি। তাদের উপর এর চেয়েও কমের নির্দেশ ছিল, তবুও তারা ওর উপর ক্ষমতা রাখে নাই। ওটা পরিত্যাগ করেছে। আপনার উম্মত তো তাদের চেয়েও দুর্বল, দেহের দিক দিয়েও, অন্তরের দিক দিয়েও এবং চক্ষু কর্ণের দিক দিয়েও। সুতরাং আপনি আবার যান এবং আল্লাহ তাআলার নিকট এটা আরো কমানোর জন্যে আবেদন করুন।” অভ্যাস অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত জিবরাঈলের (আঃ) দিকে তাকালেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে উপরে নিয়ে গেলেন। তিনি আল্লাহ তাআলার নিকট আবেদন জানালেনঃ “হে আল্লাহ! আমার উম্মতের অন্তর, কর্ণ, চক্ষু এবং দেহ দুর্বল। সুতরাং দয়া করে এটা আরো কমিয়ে দিন” তৎক্ষণাৎ আল্লাহ তাআলা বললেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! “রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “লাব্বায়কা ওয়া সা’দায়কা (আমি আপনার নিকট হাজির আছি)।” আল্লাহ তাআলা বললেনঃ “জেনে রেখো যে, আমার কথার কোন পরিবর্তন নাই। আমি যা নির্ধারণ করেছি তাই আমি উম্মুল কিতাবে লিখে দিয়েছি। পড়ার হিসেবে এটা পাচই থাকলো, কিন্তু সওয়াবের হিসেবে পঞ্চাশই রইলো।” যখন তিনি ফিরে আসলেন তখন হযরত মূসা (আঃ) তাঁকে বললেনঃ “প্রার্থনা মঞ্জুর হলো কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “হাঁ, কম করা হয়েছে অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্তের উপর পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব পূর্ণ হয়েছে। প্রত্যেক সৎ কাজের সওয়াব দশগুণ করা হয়েছে।” হযরত মূসা (আঃ) আবার বললেনঃ “আমি বাণী ইসরাঈলকে পরীক্ষা করেছি। তারা এর চেয়ে হালকা হুকুমকেও পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং আপনি আবার গিয়ে প্রতিপালকের কাছে এটা আরো কমানোর আবেদন করুন। এবার রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাব দিলেনঃ “হে কালীমুল্লাহ (আঃ)! এখন তো আমি আবার তাঁর কাছে যেতে লজ্জা পাচ্ছি।” তখন তিনি বললেনঃ “ঠিক আছে। তাহলে যান ও আল্লাহর নামে শুরু করে দিন।” অতঃপর তিনি জেগে দেখেন যে, তিনি মসজিদে হারামে রয়েছেন। (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারীর কিতাবুত তাওহীদ এবং সিফাতুন্নবী (সঃ)-এর মধ্যেও রয়েছে। এই রিওয়াইয়াতটিই শুরায়েক ইবনু আবদিল্লাহ ইবনু আবূ নামর (রাঃ) হতেও বর্ণিত আছে। কিন্তু নিজের স্মরণ শক্তির ত্রুটির কারণে সঠিকভাবে বর্ণনা করতে পারেন নাই)

কেউ কেউ এটাকে স্বপ্নের ঘটনা বলেছেন যা এর শেষে এসেছে। এ সব। ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

এই হাদীসের “তিনি আল্লাহর অতি নিকটবর্তী হন, এমনকি তাঁদের মধ্যে দু’ধনুকের ব্যবধান থাকে বা তার চেয়েও কম” এই কথাগুলিকে ইমাম হাফিয আবু বকর বায়হাকী (রঃ) শুরায়েক নামক বর্ণনাকারীর বাড়াবাড়ি বলে উল্লেখ করেছেন এবং এতে তিনি একাকী রয়েছেন। এজন্যেই কোন কোন গুরুজন বলেছেন যে, এ রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহ তাআলাকে দেখেছিলেন। কিন্তু হযরত আয়েশা (রাঃ) , হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) এবং হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) আয়াতগুলিকে এর উপর স্থাপন করেছেন যে, তিনি হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) দেখেছিলেন। এটাই সঠিকতম উক্তি এবং ইমাম বায়হাকীর (রঃ) কথা সম্পূর্ণরূপে সত্য।

অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, যখন হযরত আবু যার (রাঃ) রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কি আল্লাহ তাআলাকে দেখেছেন?” তখন উত্তরে তিনি বলেনঃ “তিনি তো নূর! সুতরাং আমি কি করে তাঁকে দেখতে পারি?” আর একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি নূর (জ্যোতি দেখেছি।” যা সূরায়ে নাজমে রয়েছেঃ (আরবি) অর্থাৎ “অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী।” (৫৩:৮) এর দ্বারা হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) বুঝানো হয়েছে, যেমন উক্ত তিনজন সাহাবী বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের মধ্যে কেউই এই আয়াতের এই তাফসীরে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করেন নাই।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার কাছে ‘বুরাক’ আনয়ন করা হয়, যা গাধার চেয়ে উঁচু ও খচ্চরের চেয়ে নীচু ছিল। ওটা ওর এক এক কদম এতো দূরে রাখছিল যত দূর ওর দৃষ্টি যায়। আমি ওর উপর সওয়ার হলাম এবং সে আমাকে নিয়ে চললো। আমি বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছে গেলাম এবং ওকে দ্বারের ঐ শিকলের সাথে বেঁধে দিলাম যেখানে নবীগণ বাধতেন। তারপর আমি মসজিদে প্রবেশ করে দু রাক'আত নামায পড়লাম। যখন সেখান থেকে বের হলাম তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে একটি পাত্রে সূরা ও একটি পাত্রে দুধ আনলেন। আমি দুধ পছন্দ করলাম। জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “আপনি ফিরত (প্রকৃতি) পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন।" তারপর উপরোক্ত হাদীসের বর্ণনার মতই তিনি প্রথম আকাশে পৌঁছলেন, ওর দর উন্মুক্ত করালেন, ফেরেশতাগণ প্রশ্ন করলেন, জবাব পেলেন। প্রত্যেক আকাশেই অনুরূপ হওয়ার কথা বর্ণিত আছে। প্রথম আকাশে হযরত আদমের (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হলো। তিনি মারহাবা বললেন এবং কল্যাণের জন্যে দুআ করলেন। দ্বিতীয় আকাশে হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) ও হযরত ঈসার (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। যারা একে অপরের খালাতো ভাই ছিলেন। তাঁরা দুজনও তাঁকে মারহাবা বললেন এবং কল্যাণের জন্যে প্রার্থনা করলেন। তৃতীয় আকাশে সাক্ষাৎ হলো হযরত ইউসুফের (আঃ) সাথে যাকে অর্ধেক সৌন্দর্য দেয়া হয়েছিল। তিনিও মারহাবা বললেন ও মঙ্গলের দুআ করলেন। তারপর চতুর্থ আকাশে হযরত ইদরীসের (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হলো, যাঁর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “আমি তাকে উন্নীত করেছিলাম উচ্চ মর্যাদায়।” পঞ্চম আকাশে সাক্ষাৎ হয় হযরত হারূণের (আঃ) সাথে। ষষ্ঠ আকাশে হযরত মূসার (আঃ) সাথে। সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) বায়তুল মা'মূরে হেলান দেয়া অবস্থায় দেখতে পান। বায়তুল মা'মূর প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা গমন করে থাকেন, কিন্তু আজ যারা যান তাঁদের পালা কিয়ামত পর্যন্ত আর আসবে না। তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছেন, যার পাতা ছিল হাতীর কানের সমান এবং যার ফল ছিল বৃহৎ মৃৎপাত্রের মত। ওটাকে আল্লাহ তাআলার আদেশে ঢেকে রেখেছিল। ওর সৌন্দর্যের বর্ণনা কেউই দিতে পারে না। তারপর ওয়াহী হওয়া, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া এবং হযরত মূসার (আঃ) পরামর্শক্রমে ফিরে গিয়ে কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্ত পর্যন্ত পৌঁছার বর্ণনা রয়েছে। তাতে এও রয়েছে যে, পরিশেষে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বলা হয়ঃ “যে ব্যক্তি কোন ভাল কাজের ইচ্ছা করে, যদি সে ওটা করতে না পারে তবুও তার জন্যে একটি নেকী লিখা হয়। আর যদি করে ফেলে তবে দশটি নেকী সে পেয়ে থাকে। পক্ষান্তরে কেউ যদি কোন পাপ কার্যের ইচ্ছা করে অতঃপর তা না করে তবে তার জন্যে কোন পাপ লিখা হয় না। আর যদি করে বসে তবে একটি মাত্র পাপ লিখা হয়। (এ হাদীসটি এভাবে মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে। সহীহ মুসলিমেও এভাবে বর্ণিত আছে) এ হাদীস দ্বারা এটাও জানা যাচ্ছে যে, যেই রাত্রে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বায়তুল্লাহ হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয় সেই রাত্রেই মি'রাজও হয় এবং এটা সত্যও বটে এতে সন্দেহের লেশ মাত্র নেই।

মুসনাদে আহমদে রয়েছে যে, বুরাকের লাগামও ছিল এবং জিন বা গদীও ছিল। রাসূলুল্লাহর (সঃ) সওয়ার হওয়ার সময় যখন সে ছটফট করতে থাকে তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি এটা কি করছো? আল্লাহর কসম! তোমার উপর ইতিপূর্বে এঁর চেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি কখনো সওয়ার হয় নাই।” একথা শুনে বুরাক সম্পূর্ণরূপে শান্ত হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যখন আমাকে আমার মহামহিমান্বিত প্রতিপালকের দিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমার গমন এমন কতকগুলি লোকের পার্শ্ব দিয়ে হয় যাদের তামার নখ ছিল, যার দ্বারা তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ও বক্ষ নুচতে ছিল।” আমি। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করলামঃ “এরা কারা?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “এরা হচ্ছে ওরাই যারা লোকের গোশত ভক্ষণ করতো (অর্থাৎ গীবত করতো) এবং তাদের মর্যাদার হানি করতো।”

সুনানে আবি দাউদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন আমি হযরত মূসার (আঃ) কবরের পার্শ্ব দিয়ে গমন করি তখন তাঁকে ওখানে নামাযে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখতে পাই।” হযরত আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মাসজিদুল আকসার (বায়তুল মুকাদ্দাসের চিহ্নগুলি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতে শুরু করে দেন। তিনি বলতেই আছেন এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর (রাঃ) তাকে বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি সত্য বর্ণনাই দিচ্ছেন এবং আপনি চরম সত্যবাদী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল।” হযরত আবু বকর (রাঃ) মাসজিদুল আকসা পূর্বে দেখেছিলেন।

মুসনাদে বায্যারে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি শুয়েছিলাম এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করেন এবং আমার দু’কাঁধের মাঝে হাত রাখেন। আমি তখন দাঁড়িয়ে গিয়ে এক গাছে বসে যাই যাতে পাখীর বাসার মত কিছু ছিল। একটিতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বসে যান। তখন ঐ গাছটি ফুলে উঠলো ও উঁচু হতে শুরু হলো, এমনকি আমি ইচ্ছা করলে আকাশ ছুঁয়ে নিতে পারতাম। আমি তো আমার চাদর ঠিক করছিলাম, কিন্তু দেখলাম যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) অত্যন্ত বিনীত অবস্থায় রয়েছেন। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহর মারেফাতের জ্ঞানে তিনি আমার চেয়ে উত্তম। আকাশের একটি দরজা আমার জন্যে খুলে দেয়া হলো। আমি এক যবরদস্ত ও জাঁকজমকপূর্ণ নূর দেখলাম যা পর্দার মধ্যে ছিল। আর ওর ঐদিকে ছিল ইয়াকূত ও মণিমুক্তা তারপর আমার কাছে অনেক কিছু ওয়াহী করা হয়।”

দালায়েলে বায়হাকীতে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সাহাবীদের জামাআতে বসে ছিলেন, এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন এবং অঙ্গুলি দ্বারা পিঠে ইশারা করলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর একটি গাছের দিকে চললেন যাতে পাখীর বাসার মত বাসা ছিল। (শেষপর্যন্ত) তাতে এও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যখন আমাদের দিকে নূর অবতীর্ণ হলো তখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। (শেষ পর্যন্ত)।” অতঃপর তিনি বলেনঃ“ এরপর আমার কাছে ওয়াহী আসলো “নবী এবং বাদশাহ হতে চাও, না নবীও বান্দা হয়ে জান্নাতী হতে চাও?” হযরত জিবরাঈল (আঃ) ঐভাবেই বিনয়ের সাথে পড়ে ছিলেন, ইশারায় তিনি আমাকে বললেনঃ “বিনয় অবলম্বন করুন।” আমি তখন উত্তরে বললাম :হে আল্লাহ! আমি নবী ও বান্দা হতে চাই।” (দালায়েলে বায়হাকীর এই রিওয়াইয়াত যদি সঠিক হয় তবে সম্ভবতঃ এটা মিরাজের ঘটনা না হয়ে অন্য কোন ঘটনা হবে। কেননা, এতে বায়তুল মুকাদ্দাসের কোন উল্লেখ নেই এবং আকাশের আরোহণেরও কোন কথা নেই। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ)

মুসনাদে বায্যারে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহ তাআলাকে দেখেছিলেন। কিন্তু এ রিওয়াইয়াতটিও গারীব। (যে সহীহ হাদীসে মাত্র একজন বর্ণনাকারী থাকেন তাকে গারীব হাদীস বলা হয়)

তাফসীরে ইবনু জারীরে বর্ণিত আছে যে, বুরাক যখন হযরত জিবরাঈলের (আঃ) কথা শুনে এবং রাসূলুল্লাহকে (সঃ) সওয়ার করিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করে তখন তিনি পথের এক ধারে এক বুড়িকে দেখতে পান। এই বুড়িটি কে তা তিনি হযরত জিবরাঈলের (আঃ) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ চলুন।”

আবার চলতে চলতে পথে কোন একজনকে দেখতে পান যে তাঁকে ডাকতে রয়েছে। আরো কিছু দূর গিয়ে তিনি আল্লাহর এক মাখলূখককে দেখতে পান, যে উচ্চ স্বরে বলতে রয়েছেঃ (আরবি) হযরত জিবরাঈল (আঃ) সালামের জবাব দিলেন। দ্বিতীয়বারও এইরূপই ঘটলো এবং তৃতীয়বারও এটাই ঘটলো। শেষ পর্যন্ত তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে। পৌঁছে গেলেন। সেখানে তাঁর সামনে পানি, মদ ও দুধ হাজির করা হলো। তিনি দুধ গ্রহণ করলেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “আপনি ফিতরাতের (প্রকৃতির) রহস্য পেয়ে গেছেন। যদি আপনি পানির পাত্র নিয়ে পান করতেন তবে আপনার উম্মত ডুবে যেতো। পথভ্রষ্ট হয়ে যেতো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সঃ) সামনে হযরত আদম (আঃ) থেকে নিয়ে তাঁর যুগের পূর্ব পর্যন্ত সমস্ত নবীকে পেশ করা হলো। তিনি তাঁদের সবারই ইমামতি করলেন। ঐ রাত্রে সমস্ত নবী নামাযে তাঁর ইকতিদা করলেন। এরপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বলেনঃ “যে বুড়িকে আপনি পথের ধারে দেখেছিলেন, তাকে যেন এজন্যেই দেখানো হয়েছিল যে, দুনিয়ার বয়স ততটুকুই বাকী আছে যতটুকু বাকী আছে এই বুড়ীর বয়স। আর যে শব্দের দিকে আপনি মনোযোগ দিয়েছিলেন সে ছিল আল্লাহর শত্রু ইবলীস। যাদের সালামের শব্দ আপনার কাছে পৌঁছেছিল তারা ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত ঈসা আঃ)।” (এবৰ্ণনাতেও গারাবাত (অস্বাভাবিকতা) ও নাকারাত বা অস্বীকৃতি রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার জ্ঞানই সবচেয়ে বেশী)

অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যখন আমি হযরত জিবরাঈলের (আঃ) সাথে বুরাকে চলি তখন এক জায়গায় তিনি আমাকে বলেনঃ “এখানে নেমে নামায আদায় করে নিন।” নামায শেষে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এটা কোন জায়গা তা জানেন কি?” আমি উত্তরে বলিঃ না। তিনি বলেনঃ “এটা তায়্যেবা অর্থাৎ মদীনা। এটাই হচ্ছে হিজরতের জায়গা।” তারপর তিনি আমাকে আর এক জায়গায় নামায পড়ান এবং বলেনঃ “এটা হচ্ছে ভূরে সাইনা”। এখানে আল্লাহ তাআ’লাহযরত মূসার (আঃ) সাথে কথা বলেন। তারপর তিনি আমাকে আর এক স্থানে নামায পড়ান ও বলেনঃ “এটা হলো বায়তে লাহাম। এখানে হযরত ঈসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ বরেন। এরপর আমি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছি। সেখানে সমস্ত নবী একত্রিত হন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে ইমাম নির্বাচন করেন। আমি তাঁদের ইমামতি করি। অতঃপর তিনি আমাকে নিয়ে আকাশে উঠে যান।” এরপর তাঁর এক এক আকাশে পৌছা এবং বিভিন্ন আকাশে বিভিন্ন নবীদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যখন আমি সিদরাতুল মুনতাহায় পৌছলাম তখন আমাকে একটি নূরানী মেঘে ঢেকে নেয়। তখনই আমি সিজদায় পড়ে গেলাম।”

তারপর তার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া এবং পরে কমে যাওয়া ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। শেষে হযরত মূসার (আঃ) বর্ণনায় রয়েছেঃ “আমার উম্মতের উপর তো মাত্র দু'ওয়াক্ত নামায নির্ধারণ করা হয়েছিল, কিন্তু ওটাও তারা পালন করে নাই।” তাঁর এই কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) পাঁচ ওয়াক্ত হতে আরো কমাবার জন্যে গেলেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বললেনঃ “আমি তো আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করার দিনই তোমার উপর ও তোমার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে রেখেছিলাম। এটা পড়তে পাঁচ ওয়াক্ত, কিন্তু সওয়াব হবে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সমান। সুতরাং তুমি ও তোমার উম্মত যেন এর রক্ষণাবেক্ষণ কর।” আমার তখন দৃঢ় প্রত্যয় হলো যে, এটাই আল্লাহ তাআলার শেষ হুকুম। অতঃপর আবার যখন আমি হযরত মূসার (আঃ) কাছে পৌছলাম তখন আবার তিনি আমাকে আল্লাহ তাআলার নিকট ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন, কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হিসেবে এটাই ছিল আল্লাহ তাআলার অকাট্য হুকুম, তাই আমি আর তাঁর কাছে ফিরে গেলাম না।”

মুসনাদে ইবনু আবি হাতিমেও মিরাজের ঘটনাটির সুদীর্ঘ হাদীস রয়েছে। তাতে এও রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদের পার্শ্বে ঐ দরজার কাছে পৌঁছেন যাকে ‘বাবে মুহাম্মদ (সঃ) বলা হয়, ওখানে একটি পাথর ছিল যাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) অঙ্গুলি লাগিয়েছিলেন, তখন তাতে ছিদ্র হয়ে যায়। সেখানে তিনি বুরাকটি বাঁধেন এবং এর পর মসজিদে প্রবেশ করেন। মসজিদের মধ্যভাগে পৌঁছলে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বলেনঃ “আপনি কি আল্লাহ তাআলার কাছে এই আকাংখা করছেন যে, তিনি আপনাকে হ্র দেখাবেন?” উত্তরে তিনি বলেন, “হ্যা” তিনি তখন বলেনঃ “তা হলে আসুন। এই যে তারা। তাদেরকে সালাম করুন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “তারা সাখরার বাম পার্শ্বে বসেছিল। আমি তাদের কাছে গিয়ে সালাম করলাম। সবাই সালামের জবাব দিলো। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ তোমরা কে? উত্তরে তারা বললোঃ “আমরা হলাম চরিত্রবতী সুন্দরী হুর। আল্লাহর পরহেযগার ও নেককার বান্দাদের আমরা স্ত্রী। যারা পাপকার্য থেকে দুরে থাকে এবং যাদেরকে পবিত্র করে আমাদের কাছে আনয়ন করা হবে। অতঃপর আর তারা কখনো বের হবে না। তারা সদা আমাদের কাছেই অবস্থান করবে। আমাদের থেকে কখনো তারা পৃথক হবে না। চিরকাল তারা জীবিত থাকবে, কখনো মৃত্যু বরণ করবেনা।” অতঃপর আমি তাদের নিকট থেকে চলে আসলাম। সেখানে মানুষ জমা হতে শুরু করলো এবং অল্পক্ষণের মধ্যে বহু লোক জমা হয়ে গেল এবং আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম। ইমামতি কে করবেন এজন্যে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার হাত ধরে সামনে বাড়িয়ে দিলেন। আমি তাদেরকে নামায পড়ালাম। নামায শেষে হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “যাদের আপনি ইমামতি করলেন তাঁরা কে তা জানেন কি? আমি জবাব দিলামঃ না। তখন তিনি বললেনঃ “আপনার এই সব মুকতাদী ছিলেন আল্লাহর নবী যাদেরকে তিনি প্রেরণ করে ছিলেন। তারপর তিনি আমার হাত ধরে অসমানের দিকে নিয়ে চললেন।” এরপর বর্ণনা আছে যে, আকাশের দরজাগুলি খুলিয়ে দেয়া হয়। ফেরেশতাগণ প্রশ্ন করেন, উত্তর পান, দরজা খুলে দেন ইত্যাদি। প্রথম আকাশে হযরত আদমের (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি বলেনঃ “হে আমার উত্তম পুত্র! (হে উত্তম নবী (সঃ)! আপনার আগমন শুভ হোক।” এতে চতুর্থ আকাশে হযরত ইদরীসের (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হওয়ারও উল্লেখ রয়েছে। সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হওয়া এবং হযরত আদমের (আঃ) মত তাঁরও তাকে উত্তম পুত্র ও উত্তম নবী (সঃ) বলে সম্ভাষণ জানানোর বর্ণনা রয়েছে। তারপর আমাকে (নবী সঃ কে) হযরত জিবরাঈল (আঃ) আরো উপরে নিয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি একটি নদী দেখলাম। যাতে মণিমুক্তা, ইয়াকূত ও যবরজদের পানপাত্র ছিল এবং উত্তম ও সুন্দর রঙ-এর পাখী ছিল। আমি বললামঃ এতো খুবই সুন্দর পাখী! আমার একথার জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এটা যারা খাবে তারা আরো উত্তম।” অতঃপর তিনি বললেনঃ “এটা কোন নহর তা জানেন কি?” আমি জবাব দিলামঃ “না”। তিনি তখন বললেনঃ “এটা হচ্ছে। নহরে কাওসার। এটা আল্লাহ তাআলা আপনাকে দান করার জন্য রেখেছেন।” তাতে স্বর্ণ ও রৌপ্যের পানপাত্র ছিল যাতে ইয়াকূত ও মণিমাণিক্য জড়ানো ছিল। ওর পানি ছিল দূধের চেয়েও বেশী সাদা। আমি একটি সোনার পেয়ালা নিয়ে তা ঐ পানি দ্বারা পূর্ণ করে পান করলাম। ঐপানি ছিল মধুর চেয়েও বেশী মিষ্ট এবং মিক আম্বারের চেয়েও বেশী সুগন্ধময়। আমি যখন এর চেয়েও আরো উপরে উঠলাম তখন এক অত্যন্ত সুন্দর রঙ-এর মেঘ এসে। আমাকে ঘিরে নিলো, যাতে বিভিন্ন রঙছিল। জিবরাঈল (আঃ) তো আমাকে ছেড়ে দিলেন এবং আমি আল্লাহ তাআলার সামনে সিজদায় পড়ে গেলাম।” অতঃপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার বর্ণনা রয়েছে। তারপর তিনি ফিরে আসেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তো কিছুই বললেন না। কিন্তু হযরত মূসা (আঃ) নামায হালকা করবার জন্যে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট ফিরিয়ে পাঠালেন। মোট কথা, অনুরূপভাবে তাঁর মহান আল্লাহর কাছে বারবার যাওয়া, মেঘের মধ্যে পরিবেষ্টিত হওয়া, নামাযের ওয়াক্ত হালকা হয়ে যাওয়া, হযরত ইবরাহীমের (আঃ) সাথে মিলিত হওয়া, হযরত মূসার (আঃ) ঘটনার বর্ণনা দেয়া, শেষ পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায থেকে যাওয়া ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এরপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে নিয়ে নীচে অবতরণ করেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলামঃ যে সব আকাশে আমি গিয়েছি সেখানকার ফেরেশতাগণ আনন্দ প্রকাশ করেছেন এবং হাসিমুখে আমার সাথে মিলিত হয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র একজন ফেরেস্তা হাসেন নাই। তিনি আমার সালামের জবাব দিয়েছেন এবং মারহাবা বলে অভ্যর্থনাও জানিয়েছেন বটে, কিন্তু তার মুখে আমি হাসি দেখি নাই। তিনি কে?” আর তার না হাসার কারণই বা কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ “তার নাম মালিক। তিনি জাহান্নামের দারোগা। জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কোন হাস্য করেন। নাই এবং কিয়ামত পর্যন্ত হাসবেনও না। কারণ তাঁর খুশীর এটাই ছিল একটা বড় সময়।” ফিরবার পথে আমি কুরায়েশের এক যাত্রী দলকে খাদ্য সম্ভার নিয়ে যেতে দেখলাম। তাদের সাথে এমন একটি উট দেখলাম যার উপর একটি সাদা ও একটি কালো চটের বস্তা ছিল। যখন হযরত জিবরাঈল (আঃ) এবং আমি ওর নিকটবর্তী হলাম তখন সে ভয় পেয়ে পড়ে গেল এবং এর ফলে সে খোঁড়া হয়ে গেল। এভাবে আমাকে আমার স্বস্থানে পৌঁছিয়ে দেয়াহলো।” সকালে তিনি জনগণের সামনে মিরাজের ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। মুশরিকরা এ খবর শুনে সরাসরি হযরত আবু বকরের (রাঃ) নিকট গমন করলো এবং তাঁকে বললোঃ “তোমার সঙ্গী কি বলছে শুনেছো কি? সে নাকি আজ রাত্রেই একমাসের পথ ভ্রমণ করে এসেছে।” উত্তরে হযরত আবূ বকর (রাঃ) বললেনঃ “যদি প্রকৃতই তিনি একথা বলে থাকেন তবে তিনি সত্য কথাই বলছেন। এর চেয়ে আরো বড় কথা বললেও তো আমরা তাঁকে সত্যবাদী বলেই জানবো। আমরা জানি যে, তাঁর কাছে মাঝে মাঝে আকাশের খবর এসে থাকে।

মুশরিকরা রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বললোঃ “তুমি আমাদের কাছে তোমার সত্যবাদিতার কোন প্রমাণ পেশ করতে পার কি?” তিনি জবাবে বললেনঃ “হাঁ, পারি। আমি অমুক অমুক জায়গায় কুরায়েশদের যাত্রীদলকে দেখেছি। তাদের একটি উট, যার উপর সাদা ও কালো দু'টি বস্তা ছিল, আমাদেরকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং চক্কর খেয়ে পড়ে যায়, ফলে তার পা ভেঙ্গে যায়।” ঐ যাত্রীদল আগমন করলে জনগণ তাদেরকে জিজ্ঞেস করেঃ “পথে নতুন কিছু ঘটে ছিল কি?” তারা উত্তরে বললোঃ “হাঁ, ঘটেছিল। অমুক উট উমুক জায়গায় এইভাবে খোঁড়া হয়ে যায় ইত্যাদি।” বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) মিরাজের ঘটনাকে সত্য বলে স্বীকার করার কারণেও হযরত আবু বকরের (রাঃ) উপাধি হয় সিদ্দীক। জনগণ রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করেঃ “আপনি তো হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ঈসার (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, সুতরাং তাদের আকৃতির বর্ণনা দিন তো?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হাঁ বলছি। হযরত মূসা (আঃ) গোধূম বর্ণের লোক, যেমন ইদে অম্মািনের লোক হয়ে থাকে। আর হযরত ঈসার (আঃ) অবয়ব মধ্যম ধরণের এবং রঙ ছিল কিছুটা লালিমা যুক্ত। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, তাঁর চুল দিয়ে যেন পানি। ঝরে পড়ছে।” (এই বর্ণনাতেও অস্বাভাবিকতা ও অদ্ভুত বস্তুনিচয় পরিলক্ষিত হয়)

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) শুয়ে ছিলেন (কা’বা শরীফের) হাতীম’ নামক স্থানে। অন্য রিওয়াইয়াতে আছে যে, তিনি সখরের উপর শুয়েছিলেন। এমন সময় আগমনকারীরা আগমন করেন। একজন অপরজনকে আদেশ করেন এবং তিনি তাঁর কাছে এসে এখান থেকে এখান। পর্যন্ত বিদীর্ণ করে দেন অর্থাৎ গলার পার্শ্ব থেকে নিয়ে নাভী পর্যন্ত। তারপর উপরে বর্ণিত হাদীসগুলির বর্ণনার মতই বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ষষ্ঠ আকাশে আমি হযরত মূসাকে (আঃ) সালাম করি এবং তিনি সালামের জবাব দেন। অতঃপর বলেনঃ “সৎ ভাই ও সৎ নবীর (সঃ) আগমন শুভ হোক।” আমি সেখান হতে আগে বেড়ে গেলে তিনি কেঁদে ফেলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আপনি কাঁদছেন কেন?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “এই জন্যে যে, যে ছেলেটিকে আমার পরে নবী করে পাঠান হয়েছে তাঁর উম্মত আমার উম্মতের তুলনায় অধিক সংখ্যক জান্নাতে যাবে।” তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সিদরাতুল মুনতাহার নিকট চারটি নহর দেখেন। দুটি যাহির ও দুটি বাতিন। তিনি বলেনঃ “আমি বললামঃ হে জিবরাঈল (আঃ)! এই চারটি নহর কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “বাতিনী নহর দু’টি হচ্ছে জান্নাতের নহর এবং যাহিরী নহর দুটি হলো নীল ও ফুরাত।” অতঃপর আমার সামনে বায়তুল মা'মূর’ উঁচু করা হলো। তারপর আমার সামনে মদ, দূধ ও মধুর পাত্র পেশ করা হলো। আমি দূধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এটাই হচ্ছে ‘ফিতরত’ (প্রকৃতি) যার উপর আপনি রয়েছেন ও আপনার উম্মত রয়েছে। তাতে রয়েছে যে, যখন পাঁচ ওয়াক্ত নামায রয়ে গেল এবং হযরত মূসা কালীমুল্লাহ (আঃ) আবার তাঁকে আল্লাহ তাআলার কাছে ফিরে যেতে বললেন তখন তিনি বললেনঃ “আমি তো এখন আমার প্রতিপালকের কাছে আবেদন করতে লজ্জা পাচ্ছি। এখন আমি সম্মত হয়ে গেলাম এবং এটাই স্বীকার করে নিলাম।”

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হলো। এ সময় আমি মক্কায় ছিলাম (শেষ পর্যন্ত)।” তাতে রয়েছে যে, নবী (সঃ) বলেনঃ “যখন আমি হযরত জিবরাঈলের (আঃ) সাথে দুনিয়ার আকাশে আরোহণ করলাম তখন দেখলাম যে, একটি লোক বসে রয়েছেন এবং তাঁর ডানে ও বামে বড় বড় দল রয়েছে। ডান দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে উঠছেন এবং বাম দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলছেন। আমি হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করলামঃ ইনি কে? আর তার ডানে ও বামে যারা রয়েছে তারা কারা?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “ইনি হলেন হযরত আদম (আঃ)। আর ওরা হলো তাঁর সন্তান। ডান দিকেরগুলো জান্নাতী এবং বাম দিকের গুলো জাহান্নামী। ওদেরকে দেখে তিনি খুশী হচ্ছেন এবং এদেরকে দেখে কেঁদে ফেলছেন।” এই রিওয়াইয়াতে আছে যে, ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাতে আছে যে, তিনি বলেনঃ “সপ্তম আকাশ। হতে আমাকে আরো উপরে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সমান্তরালে পৌঁছে আমি কলমের লিখার শব্দ শুনতে পাই।” তাতে আছে যে, নবী (সঃ) বলেনঃ “হযরত মূসার (আঃ) পরামর্শ অনুযায়ী যখন আমি নামাযের ওয়াক্ত হালকা করাবার জন্যে আবার আল্লাহ তাআলার নিকট গমন করলাম তখন তিনি অর্ধেক মাফ করলেন। আবার গেলাম। এবারও তিনি অর্ধেক ক্ষমা করলেন, পুনরায় গেলে পাঁচ ওয়াক্ত নির্ধারিত হয়।” ওতে রয়েছে যে, তিনি বলেনঃ “সিদরাতুল মুনতাহা হয়ে আমি জান্নাতে পৌঁছি যেখানে খাটি মণিমুক্তার তাঁবু ছিল এবং যেখানকার মাটি ছিল খাঁটি মি আম্বার।” হযরত শাকীক (রঃ) হযরত আবু যারকে (রাঃ) বলেনঃ “যদি আমি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) দেখতাম তবে কমপক্ষে তাঁকে একটি কথা অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম।” তখন হযরত আবু যার (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “সেই কথাটি কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “তিনি আল্লাহ তাআলাকে দেখেছিলেন কিনা এই কথাটি।” একথা শুনে হযরত আবু যার (রাঃ) বলেনঃ “একথা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “আমি তার নূর (আলো) দেখেছিলাম। তাকে আমি কিরূপে দেখতে পারি?” (এই পূর্ণ হাদীসটি সহীহ বুখারীর ‘কিতাবুস সালাত -এর মধ্যেও বর্ণিত হয়েছে এবং যিকরে বানী ইসরাঈলের মধ্যেও আছে। ইমাম মুসলিম (রঃ) তাঁর সহীহ মুসলিম গ্রন্থে কিতাবুল ঈমান’-এর মধ্যে এটা বর্ণনা করেছেন)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি তো নূর। সুতরাং আমি তাঁকে কি করে দেখতে পারি?” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমি মিরাজের ঘটনাটি যখন জনগণের কাছে বর্ণনা করি এবং কুরায়েশরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, ঐ সময় আমি হাতীমে দাঁড়িয়েছিলাম। আল্লাহ তাআলা বায়তুল মুকাদ্দাসকে আমার চোখের সামনে এনে ধরলেন এবং ওটাকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করে দিলেন। এখন তারা যে নিদর্শনগুলি সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, সেগুলির উত্তর আমি সঠিকভাবে দিয়ে যাচ্ছিলাম।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) ও হযরত ঈসার (আঃ) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ফিরে এসে জনগণের সামনে তিনি এ ঘটনাটি বর্ণনা করলে যারা তার সাথে নামায পড়েছিল তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। কুরায়েশ কাফিরদের দল তৎক্ষণাৎ দৌড়ে হযরত আবু বকরের (রাঃ) নিকট গমন করে এবং বলেঃ “দেখো, আজ তোমার সাথী (নবী সঃ) কি এক বিস্ময়কর কথা বলছে! বলছে যে, সে নাকি এক রাত্রেই রায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছে ও ফিরে এসেছে!” একথা শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “যদি তিনি একথা বলে থাকেন তবে সত্যিই তিনি এভাবে গিয়ে ফিরে এসেছেন। তারা তখন বললোঃ “তাহলে তুমি এটাও বিশ্বাস করছো যে, সে রাত্রে বের হলো এবং সকাল হওয়ার পূর্বেই সিরিয়া হতে মক্কায় ফিরে আসলো?” উত্তরে তিনি বললেনঃ এর চেয়েও আরো বড় ব্যাপার আমি এর বহু পূর্ব হতেই বিশ্বাস করে আসছি। অর্থাৎ আমি এটা স্বীকার করি যে, তাঁর কাছে আকাশ হতে খবর পৌঁছে থাকে। আর এ সব খবর দেয়ার বাপরে তিনি চরম সত্যবাদী।” ঐ সময় থেকেই তাঁর উপাধি হয় আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) । (এ হাদীসটি ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত যার ইবনু জায়েশ (রঃ) বলেনঃ “আমি হযরত হুযাইফার (রাঃ) নিকট (একদা) আগমন করি। ঐ সময় তিনি মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। এ বর্ণনায় তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা চলতে থাকি, শেষ পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে যাই।” এরপর হযরত হুযাইফা (রাঃ) বলেন যে, তারা দু'জন (অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও হযরত জিবরাঈল (আঃ)) ভিতরে প্রবেশ করেন নাই। একথা শোনা মাত্র আমি বললামঃ এটা ভুল কথা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভিতরেও গিয়েছিলেন এবং ঐ রাত্রে তিনি সেখানে নামাযও পড়েছিলেন। আমার একথা শুনে হযরত হুযাইফা (রাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার নাম কি? আমি তোমাকে চিনি বটে, কিন্তু নামটা আমার মনে নেই।” উত্তরে আমি বললামঃ আমার নাম যার ইবনু জায়েশ। তিনি তখন জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি এটা কি করে জানতে পারলে যে, (রাসূলুল্লাহ (সঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসের ভিতরে গিয়েছিলেন)?” জবাবে আমি বললামঃ এটা কুরআন কারীমেরই খবর। তিনি তখন বললেনঃ “কুরআন কারীম হতে যে কথা বলে সে তো মুক্তি পেয়েছে! কুরআনের কোন্ আয়াতে এটা রয়েছে, পাঠ করতো?” আমি তখন (আরবি) এই আয়াতটি পাঠ করলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “এই আয়াতের কোন শব্দের অর্থ এটা হলো যে, তিনি সেখানে নামায পড়েছিলেন? না, না। তিনি সেখানে নামায পড়েন নাই। যদি পড়তেন তবে তোমাদের উপর অনুরূপভাবে তথাকার নামায লিখে দেয়া হতো, যেমন ভাবে বায়তুল্লাহ শরীফের নামায লিখে দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! তাঁরা দু'জন বুরাকের উপরই ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তাঁদের জন্যে আকাশের দরজাগুলি খুলে দেয়া হয়। সুতরাং তারা জান্নাত ও জাহান্নাম দেখে। নেন এবং আরো দেখে নেন আখেরাতের ওয়াদাকৃত অন্যান্য সমস্ত জিনিস। তারপর ঐভাবেই ফিরে আসেন। এরপর তিনি খুব হাসলেন এবং বলতে লাগলেনঃ “মজার কথা তো এটাই যে, লোকেরা বলেঃ তিনি সেখানে বুরাক বাঁধেন যেন কোথাও পালিয়ে না যায়, অথচ দৃশ্য ও অদৃশ্যের খবর রাখেন যিনি সেই মহান আল্লাহ ঐ বুরাককে রাসূলুল্লাহর (সঃ) আয়ত্ত্বাধীন করে দিয়েছিলেন।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ জনাব! বুরাক কি? উত্তরে তিনি বললেনঃ “বুরাক হলো দীর্ঘ অবয়বু বিশিষ্ট সাদা রঙ-এর একটি জন্তু, যা এক একটি পা এতো দূরে রাখে যত দূর দৃষ্টি যায়।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। তবে এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, হযরত হুযাইফার (রাঃ) বর্ণিত এই হাদীসের উপর অগ্রগণ্য হচ্ছে ঐ হাদীসগুলি যেগুলি দ্বারা রাসূলুল্লাহর (সঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায পড়া সাব্যস্ত হয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)

একবার সাহীবগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মি'রাজের ঘটনা বর্ণনা করার আবেদন জানান। তখন প্রথমতঃ তিনি (আরবি) এই আয়াতটি পাঠ করেন, এবং বলেনঃ “এশার নামাযের পর আমি মসজিদে শুয়েছিলাম এমতাবস্থায় এক আগমনকারী আগমন করে আমাকে জাগ্রত করেন। আমি উঠে বসলাম কিন্তু কাউকেও দেখতে পেলাম না। তবে জানোয়ারের মত একটা কি দেখলাম এবং গভীর ভাবে দেখতেই থাকলাম। অতঃপর মসজিদ হতে বেরিয়ে দেখতে পেলাম যে, একটা বিস্ময়কর জন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাদের জন্তগুলির মধ্যে খচ্চরের সঙ্গে ওর কিছুটা সাদৃশ্য ছিল। ওর কান দুটি ছিল উপরের দিকে উথিত ওদোদুল্যমান। ওর নাম হচ্ছে বুরাক। আমার পূর্ববর্তী নবীরাও (আঃ) এরই উপর সওয়ার হয়ে এসেছেন। আমি ওরই উপর সওয়ার হয়ে চলতেই রয়েছি এমন সময় আমার ডান দিক থেকে একজন ডাক দিয়ে বললোঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! আমার দিকে তাকাও, আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবো।” কিন্তু আমি না জবাব দিলাম, না দাঁড়ালাম। এরপর কিছু দূর গিয়েছি এমন সময় বাম দিক থেকেও ডাকের শব্দ আসলো। কিন্তু এখানেও আমি থামলাম না এবং জবাবও দিলাম না। আবার কিছু দূর অগ্রসর হয়ে দেখি যে, একটি স্ত্রীলোক দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে এবং কামউদ্দীপনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেও আমাকে বললোঃ “আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। কিন্তু আমি তার দিকে ভুক্ষেপও করলাম না এবং থামলামও না।” এরপর তাঁর বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছা, দুধের পাত্র গ্রহণ করা এবং হযরত জিবরাঈলের (আঃ) কথায় খুশী হয়ে দু’বার তাকবীর পাঠ করার কথা বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আপনার চেহারায় চিন্তারভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে কেন?” (নবী সঃ বলেনঃ) আমি তখন পথের ঘটনা উঁটির কথা বর্ণনা করলাম। তিনি তখন বলতে শুরু করলেনঃ “প্রথম লোকটি ছিল ইয়াহূদী। যদি আপনি তার কথার উত্তর দিতেন এবং সেখানে দাঁড়াতেন তবে আপনার উম্মত ইয়াহুদী হয়ে যেতো। দ্বিতীয় আহ্বানকারী ছিল খৃষ্টান। যদি আপনি সেখানে থেমে তার সাথে কথা বলতেন তবে আপনার উম্মত খৃস্টান হয়ে যেতো। আর ঐ স্ত্রী লোকটি ছিল দুনিয়া। যদি আপনি সেখানে থেমে তার সাথে কথা বলতেন তবে আপনার উম্মত আখেরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে হতো।” (রাসূলুল্লাহ, সঃ বলেনঃ) অতঃপর আমি এবং হযরত জিবরাঈল (আঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলাম এবং দু’জনই দু'রাকাত করে নামায আদায় করলাম। তারপর আমাদের সামনে মি'রাজ (আরোহণের সিঁড়ি) হাজির করা হলো যাতে চড়ে বানী আদমের আত্মাসমূহ উপরে উঠে থাকে। দুনিয়া এইরূপ সুন্দর জিনিস আর কখনো দেখে নাই। তোমরা কি দেখ না যে, মরণান্মুখ ব্যক্তির চক্ষু মরণের সময় আকাশের দিকে উঠে থাকে? এটা দেখে বিস্মিত হয়েই সে ঐরূপ করে থাকে। আমরা দু’জন উপরে উঠে গেলাম। আমি ইসমাঈল নামক ফেরেস্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি দুনিয়ার আকাশের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। তার অধীনে সত্তর হাজার ফেরেশতা রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রত্যেক ফেরেশতার সঙ্গীয় লশকরী ফেরেশতাদের সংখ্যা হলো এক লাখ। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “তোমার প্রতিপালকের লস্করদেরকে শুধুমাত্র তিনিই জানেন।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) ঐ আকাশের দরজা খুলতে বললে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “কে?” তিনি উত্তর দিলেনঃ “জিবরাঈল (আঃ)।” প্রশ্ন করা হলোঃ “আর কে আছেন?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।” পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলোঃ আপনাকে কি তাঁর নিকট পাঠানহয়েছিল?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হা” সেখানে আমি হযরত আদমকে (আঃ) ঐ আকৃতিতে দেখলাম যে আকৃতিতে ঐ দিন ছিলেন যেই দিন আল্লাহ তাআলা তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সামনে তাঁর সন্তানদের আত্মাগুলি পেশ করা হয়। সৎ লোকদের আত্মাগুলি দেখে তিনি বলেনঃ “আত্মও পবিত্র এবং দেহও পবিত্র। একে ইল্লীনে নিয়ে যাও।” আর অসৎ লোকদের আত্মাগুলি দেখে বলেনঃ আত্মাও অপবিত্র এবং দেহও অপবিত্র। একে সিজ্জীনে নিয়ে যাও।” কিছু দূর গিয়ে দেখি যে, একটি খাঞ্চা রাখা আছে এবং তাতে অত্যন্ত উত্তম ভাজা গোশত রয়েছে আর এক দিকে রয়েছে আর একটি খাঞ্চা। তাতে আছে পচা দুর্গন্ধময় ভাজা গোশত। এমন কতকগুলি লোককে দেখলাম যারা উত্তম গোশতের কাছেও যাচ্ছে না। এবং ঐ পচা দুর্গন্ধময় ভাজা গোশত খেতে। রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ “হে জিবরাঈল (আঃ)! এই লোকগুলি কারা?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “এরা হলো আপনার উম্মতের ঐ সব লোক যারা হালাল কে ছেড়ে হারামের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে।” আরো কিছু দূর অগ্রসর হয়ে দেখি যে, কতকগুলি লোকের ঠোট উটের মত। ফেরেস্তারা তাদের মুখ ফেড়ে ফেড়ে ঐ গোশত তাদের মখের মধ্যে ভরে দিচ্ছেন যা। তাদের অন্য পথ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তারা ভীষণ চীৎকার করছে এবং মহান আল্লাহর সামনে মিনতি করতে রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ “এরা কারা?” জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এরা আপনার উম্মতের ঐসব লোক যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতো। যারা ইয়াতীমদের মাল অন্যায়ভাবে খায় তারা নিজেদের পেটের মধ্যে আগুন ভরে দিচ্ছে এবং অবশ্য অবশ্যই তারা জাহান্নামের জ্বলন্ত অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করবে।” আরো কিছু দূর গিয়ে দেখি যে, কতকগুলি স্ত্রী লোক নিজেদের বুকের ভরে লটকানো রয়েছে এবং হায়! হায়! করতে আছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের ব্যভিচারিণী স্ত্রীলোক।” আর একটু অগ্রসর হয়ে দেখি যে, কতকগুলি লোকের পেট বড় বড় ঘরের মত। যখন উঠতে চাচ্ছে তখন পড়ে যাচ্ছে এবং বার বার বলতে আছেঃ “হে আল্লাহ! কিয়ামত যেন সংঘটিত না হয়।” ফিরআউনী জন্তুগুলি দ্বারা তারা পদদলিত হচ্ছে। আর তারা আল্লাহ তাআলার সামনে হা-হুতাশ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এরা কারা? জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের ঐ সব লোক যারা সূদ খেতো। সূদ খোররা ঐ লোকদের মতই দাড়াবে যাদেরকে শয়তান পাগল করে রেখেছে। আরো কিছু দূর গিয়ে দেখি যে, কতকগুলি লোকের পার্শ্বদেশের গোশত কেটে কেটে ফেরেশতাগণ। তাদেরকে খাওয়াচ্ছেন। আর তাদেরকে তারা বলতে আছেন, “যেমন তোমরা তোমাদের জীবদ্দশায় তোমাদের ভাইদের গোশত খেতে তেমনই এখনো খেতে থাকো।” আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরাঈল (আঃ)! এরা কারা? উত্তরে তিনি বললেনঃ “এরা হচ্ছে আপনার উম্মতের ঐ সব লোক যারা অপরের দোষ অন্বেষণ করে বেড়াতো।”

এরপর আমরা দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে আমি একজন অত্যন্ত সুদর্শন লোককে দেখলাম। তিনি সুদর্শন লোকদের মধ্যে ঐ মর্যাদাই রাখেন যেমন মর্যাদা রয়েছে চন্দ্রের তারকারাজির উপর। জিজ্ঞেস করলামঃ ইনি কে? জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “ইনি হলেন আপনার ভাই ইউসুফ (আঃ)।” তাঁর সাথে তাঁর কওমের কিছু লোক রয়েছে। আমি তাদেরকে সালাম করলাম এবং তারা আমার সালামের জবাব দিলেন। তারপর আমরা তৃতীয় আকাশে আরোহণ করলাম। আকাশের দরজা খুলে দেয়া হলো। সেখানে আমি হযরত ইয়াহইয়া (আঃ) ও হযরত যাকারিয়াকে (আঃ) দেখলাম। তাদের সাথে তাঁদের কওমের কিছু লোক ছিল। আমি তাদেরকে সালাম করলাম এবং তারা আমার সালামের উত্তর দিলেন। এরপর আমরা চতুর্থ আকাশে উঠলাম। সেখানে হযরত ইদ্রীসকে (আঃ) দেখলাম। আল্লাহ তাআলা তাঁকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আমি তাকে সালাম করলাম। তিনি আমার সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর আমরা পঞ্চম আকাশে আরোহণ করলাম। সেখানে ছিলেন হযরত হারূণ (আঃ)। তাঁর শ্মশ্রুর অর্ধেকটা সাদা ছিল এবং অর্ধেকটা কালো ছিল। তাঁর শ্মশ্রু ছিল অত্যন্ত লম্বা, তা প্রায় নাভী পর্যন্ত লটকে গিয়েছিল। আমার প্রশ্নের উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “ইনি হচ্ছেন তাঁর কওমের মধ্যে হৃদয়বান ব্যক্তি হযরত হারূণ ইবনু ইমরান (আঃ)। তাঁর সাথে তাঁর কওমের একদল লোক ছিল। তারাও আমার সালামের উত্তর দেন। তারপর আমরা আরোহণ করলাম ষষ্ঠ আকাশে। সেখানে আমার সাক্ষাৎ হলো হযরত মূসা ইবনু ইমরানের (আঃ) সঙ্গে। তিনি গোধুম বর্ণের লোক ছিলেন। তার চুল ছিল খুবই বেশী। দু’টো জামা পরলেও চুল তা ছড়িয়ে যেতো। মানুষ বলে থাকে যে, আল্লাহ তাআলার কাছে আমার বড় মর্যাদা রয়েছে, অথচ দেখি যে, এর মর্যাদা আমার চেয়েও বেশী। আমি হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, ইনি হচ্ছেন হযরত মূসা ইবনু ইমরান (রাঃ) । তার পার্শ্বেও তার কওমের কিছু লোক ছিল। তিনিও আমার সালামের জবাব দিলেন। তারপর আমরা সপ্তম আকাশে উঠলাম। সেখানে আমি আমার পিতা হযরত ইবরাহীম খলীলকে (আঃ) দেখলাম। তিনি স্বীয় পৃষ্ঠ বায়তুল মা'মূরে লাগিয়ে দিয়ে বসে রয়েছেন। তিনি অত্যন্ত ভাল মানুষ। জিজ্ঞেস করে আমি তাঁর নামও জানতে পারলাম। আমি সালাম করলাম এবং তিনি জবাব দিলেন। আমি আমার উম্মতকে দু'ভাগে। বিভক্ত দেখলাম। অর্ধেকের কাপড় ছিল বকের মত সাদা এবং বাকী অর্ধেকের কাপড় ছিল অত্যন্ত কালো। আমি বায়তুল মামুরে গেলাম। সাদা পোশাক যুক্ত লোকগুলি সবাই আমার সাথে গেল এবং কালো পোশাকধারী লোকদেরকে আমার সাথে যেতে দেয়া হলো না। আমরা সবাই সেখানে নামায পড়লাম। তারপর সবাই সেখান হতে বেরিয়ে আসলাম। এই বায়তুল মামুরেই প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায পড়ে থাকেন। কিন্তু যারা একদিন নামায পড়েছেন তাঁদের পালা কিয়ামত পর্যন্ত আসবে না। অতঃপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় উঠিয়ে নেয়া হলো। যার প্রত্যেকটি পাতা এতো বড় যে, আমার সমস্ত উম্মতকে ঢেকে ফেলবে।” তাতে একটি নহর প্রবাহিত ছিল যার নাম সালসাবীল। এর থেকে দু'টি প্রস্রবণ বের হয়েছে। একটি হলো নহরে কাওসার এবং আর একটি নহরে রহমত। আমি তাতে গোসল করলাম। আমার পূর্বাপর সমস্ত পাপ মোচন হয়ে গেল। এরপর আমাকে জান্নাতের দিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আমি একটি হুর দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ তুমি কার? উত্তরে সে বললোঃ “আমি হলাম হযরত যায়েদ ইবনু। হারেসার (রাঃ) সেখানে আমি নষ্ট না হওয়া পানি, স্বাদ পরিবর্তন না হওয়া দুধ, নেশাহীন সুস্বাদু মদ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মধুর নহর দেখলাম। ওর ডালিম ফল বড় বড় বালতির সমান ছিল। ওর পাখী ছিল তোমাদের এই তক্তা ও কাঠের ফালির মত। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তাঁর সৎবান্দাদের জন্যে ঐ সব নিয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছেন যা কোন চক্ষু দর্শন করে নাই, কোন কর্ণ শ্রবণ করে নাই এবং কোন অন্তরে কল্পনাও জাগে নাই। অতঃপর আমার সামনে জাহান্নাম পেশ করা হলো, যেখানে ছিল আল্লাহ তাআলার ক্রোধ, তার শাস্তি এবং তাঁর অসন্তুষ্টি। যদি তাতে পাথর ও লোহ নিক্ষেপ করা হয় তবে ওগুলিকেও খেয়ে ফেলবে। এরপর আমার সামনে থেকে ওটা বন্ধ করে দেয়া হলো। আবার আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছিয়ে দেয়া হলো এবং ওটা আমাকে ঢেকে ফেললো। এখন আমার মধ্যে এবং তাঁর (হযরত জিবরাঈলের (আঃ) মধ্যে মাত্র দুটি কামান পরিমাণ দূরত্ব থাকলো, এমনকি এর চেয়েও নিকটবর্তী। প্রত্যেক পাতার উপর ফেরেশতা এসে গেলেন। এবং আমার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হলো। আর আমাকে বলা হলোঃ “তোমার জন্যে প্রত্যেক ভাল কাজের বিনিময়ে দশটি পূণ্য রইলো। তুমি যখন কোন ভাল কাজের ইচ্ছা করবে, অথচ তা পালন করবে না, তথাপি একটি পূণ্য লিখা হবে। আর যদি করেও ফেল তবে দশটি পূর্ণ লিপিবদ্ধ হবে। পক্ষান্তরে যদি কোন খারাপ কাজের ইচ্ছা কর, কিন্তু তা না কর তবে একটিও পাপ লিখা হবে না। আর যদি করে বস তবে মাত্র একটি পাপ লিখা হবে।” তারপর হযরত মূসার (আঃ) নিকট আগমন করা এবং তার পরামর্শক্রমে বারবার আল্লাহ তাআলার নিকট গমন করা এবং নামাযের ওয়াক্তের সংখ্যা কম হওয়ার বর্ণনা রয়েছে, যেমন ইতিপূর্বে গত হয়েছে। শেষে যখন পাঁচ ওয়াক্ত বাকী থাকলো তখন ফেরেশতার মাধ্যমে ঘোষণা করা হলোঃ “আমার ফরজ পূর্ণ হয়ে গেল এবং আমি আমার বান্দার উপর হাল্কা করলাম। তাকে প্রত্যেক সৎ কাজের বিনিময়ে দশটি পূণ্য দান করা হবে।” এর পরেও হযরত মূসা (আঃ) আমাকে আল্লাহ তাআলার নিকট ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমি বললামঃ এখন আমাকে আবারও যেতে লজ্জা লাগছে। অতঃপর সকালে তিনি জনগণের সামনে এই সব বিস্ময়কর ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তিনি ঐ রাত্রে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছেছেন, তাঁকে আকাশ সমূহে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তিনি এটা, ওটা দেখেছেন। তখন আবু জেহেল ইবনু হিশাম বলতে শুরু করেঃ “আরে দেখো, বিস্ময়কর কথা শুনো! আমরা উটকে মেরে পিটেও দীর্ঘ এক মাসে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে থাকি।, আবার ফিরে আসতেও এক মাস লেগে যায়, আর এ বলছে যে, সে দু'মাসের পথ এক রাত্রেই অতিক্রম করেছে!” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাকে বললেনঃ “শুন, যাওয়ার সময় আমি তোমাদের যাত্রীদলকে অমুক জায়গায় দেখেছিলাম। অমুক রয়েছে অমুক রঙ এর উটের উপর এবং তার কাছে রয়েছে এইসব আসবাবপত্র।” আবু জেহেল তখন বললোঃ খবর তো তুমি দিলে, দেখা যাক, কি হয়?” তখন তাদের মধ্যে একজন বললোঃ “আমি বায়তুল মুকাদ্দাসের অবস্থা তোমাদের চাইতে বেশী ওর ইমারত, ওর আকৃতি, পাহাড় হতে ওটা কাছাকাছি হওয়া ইত্যাদি সবই আমার জানা আছে। সুতরাং আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহর (সঃ) চোখের সামনে হতে পর্দা সরিয়ে ফেললেন এবং যেমন আমার ঘরে বসে বসে জিনিসগুলি দেখে থাকি, অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহর (সঃ) সামনে বায়তুল মুকাদ্দাসকে হাজির করে দেয়া হলো। তিনি বলতে লাগলেনঃ “ওর গঠনাকৃতি এই প্রকারের, ওর আকার এইরূপ এবং ওটা পাহাড় থেকে এই পরিমাণ নিকটে রয়েছে ইত্যাদি।” ঐলোকটি একথা শুনে বললোঃ “নিশ্চয়ই আপনি সত্য কথাই বলছেন।” অতঃপর সে কাফিরদের সমাবেশের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললোঃ “মুহাম্মদ (সঃ) নিজের কথায় সত্যবাদী।” কিংবা এই ধরনের কোন একটা কথা বলেছিলেন। (এই বর্ণনাটি হাফিয আবু বকর বায়হাকীর (রঃ) কিতাবু দালায়িলিন নুবওয়াহ' নামক গ্রন্থে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে)

এই রিওয়াইয়াতটি আরো বহু গ্রন্থে রয়েছে। এর স্বাভাবিকতা, অস্বীকৃতি এবং দুর্বলতা সত্ত্বেও আমরা এটা বর্ণনা করলাম, এর কারণ এই যে, এতে আরো বহু হাদীসের গ্রন্থের প্রমাণাদি বিদ্যমান রয়েছে। আর এজন্যেও যে, ইমাম বায়হাকীর (রঃ) হাদীস গ্রন্থে রয়েছেঃ হযরত আবুল আযহার ইয়াযীদ ইবনু আবি হাকীম (রঃ) বলেনঃ “একদা স্বপ্নে আমি রাসূলুল্লাহকে (সঃ) দেখতে পাই। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করিঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার উম্মতের মধ্যে এমন একটি লোক রয়েছেন যাকে সুফইয়ান ছাওরী (রঃ) বলা হয়, তার মধ্যে কোন দোষ-ত্রুটি তো নেই? উত্তরে তিনি বলেনঃ “না, তার মধ্যে কোন দোষ-ত্রুটি নেই।” আমি আরো বর্ণনাকারীদের নাম বর্ণনা করে জিজ্ঞেস করলামঃ তারা আপনার হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, আপনি বলেছেনঃ “এক রাত্রে আপনার মি’রাজ হয় এবং আপনি আকাশে দেখেছেন (শেষ পর্যন্ত)”? তিনি উত্তরে বললেনঃ “হাঁ, এটা ঠিক কথাই বটে।” আবার আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার উম্মতের কতকগুলি লোক আপনার মিরাজের ঘটনায় অনেক বিস্ময়কর ও অস্বাভাবিক কথা বর্ণনা করে থাকে। তিনি বললেনঃ “হা এগুলো হচ্ছে কাহিনী কথকদের কথা।”

হযরত শাদ্দাদ ইবনু আউস (রাঃ) বলেনঃ “আমরা নবীকে (সঃ) জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! (দয়া করে আমাদের সামনে আপনার মিরাজের ঘটনাটি বর্ণনা করবেন কি”? উত্তরে তিনি বললেনঃ “তা হলে শুনো! আমি আমার সাহাবীদেরকে নিয়ে মক্কায় এশার নামায দেরীতে পড়লাম।

অতঃপর হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে সাদা রঙ-এর একটি জন্তু আনয়ন করেন, যা গাধার চেয়ে উঁচু ও খচ্চরের চেয়ে নীচু। এরপর আমাকে বলেনঃ “এর উপর আরোহণ করুন!” জন্তুটি একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলে হযরত জিবরাঈল (আঃ) ওর কানটি ধরে মুচড়িয়ে দেন। তখনই সে শান্ত হয়ে যায়। আমি তখন ওর উপর সওয়ার হয়ে যাই।”এতে মদীনায় নামায পড়া, পরে মাদইয়ানে ঐ বৃক্ষটির পাশে নামায পড়ার কথা বর্ণিত আছে যেখানে হযরত মূসা (আঃ) থেমেছিলেন। তারপর বায়তে লাহামে নামায পড়ার বর্ণনা রয়েছে যেখানে হযরত ঈসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এরপর বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায পড়ার কথা রয়েছে। সেখানে পিপাসার্ত হওয়া, দূধ ও মধুর পাত্র হাজির হওয়া এবং পেট পুরে দুধ পান করার কথা বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেনঃ “সেখানে একজন বৃদ্ধ লোক হেলান লাগিয়ে বসে ছিলেন যিনি বললেন যে, ইনি ফিতরত (প্রকৃতি) পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন এবং সুপথ প্রাপ্ত হয়েছেন। অতঃপর আমরা একটি উপত্যকায় আসলাম। সেখানে আমি জাহান্নামকে দেখলাম যা জ্বলন্ত অগ্নির আকারে ছিল। তারপর ফিরবার পথে অমুক জায়গায় আমি কুরায়েশদের যাত্রী দলকে দেখলাম যারা তাদের একটি হারানো উট খোজ করছিল। আমি তাদেরকে সালাম করলাম। তাদের কতক লোক আমার কণ্ঠস্বর চিনেও ফেললো এবং পরস্পর বলাবলি করতে লাগলোঃ “এটা তো একেবারে মুহম্মদের (সঃ) কণ্ঠস্বর।” অতঃপর সকালের পূর্বেই আমি মক্কায় আমার সহচরবৃন্দের কাছে পৌঁছে গেলাম। আমার কাছে হযরত আবূ বকর (রাঃ) আসলেন এবং বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আজ রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? যেখানে যেখানে আমার ধারণা হয়েছে সেখানে সেখানে আমি আপনাকে খোঁজ করেছি, কিন্তু কোথাও খুঁজে পাই নাই।” আমি বললামঃ আজ রাত্রে তো আমি বায়তুল মক্কাদ্দাস গিয়েছি ও ফিরে এসেছি।” তিনি বললেনঃ “বায়তুল মুকাদ্দাস তো এখান থেকে এক মাসের পথের ব্যবধানে রয়েছে। আচ্ছা সেখানকার কিছু নিদর্শন বর্ণনা করুন তো।” তৎক্ষণাৎ ওটাকে আমার সামনে করে দেয়া হয়, যেন আমি ওটা দেখছি। এখন আমাকে যা কিছু প্রশ্ন করা হয়, আমি দেখে তার উত্তর দিয়ে দিই। তখন হযরত আবু বকর (রাঃ) বলেনঃ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর সত্যবাদী রাসূল (সঃ)।” কিন্তু কুরায়েশ কাফিররা বিদ্রুপ করে বলে বেড়াতে লাগলোঃ “দেখো, ইবনু আবি কাবশা’ (সঃ) বলে বেড়াচ্ছে যে, সে এক রাত্রেই বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়ে ফিরে এসেছে।" আমি বললামঃ শুন! আমি তোমাদের কাছে এর একটা প্রমাণ পেশ করছি। তোমাদের যাত্রীদলকে আমি অমুক জায়গায় দেখে এসেছি। তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল, যা অমুক ব্যক্তি নিয়ে এসেছে। এখন তারা এতোটা ব্যবধানে রয়েছে। এক মনযিল হবে তাদের অমুক জায়গা, দ্বিতীয় মনযিল হবে অমুক জায়গা এবং অমুক দিন তারা এখানে পৌঁছে যাবে। ঐ যাত্রী দলের সাথে সর্বপ্রথমে একটি গোধূম বর্নের উট রয়েছে। ওর উপর পড়ে রয়েছে একটি কালো স্কুল এবং আসবাবপত্রের দুটি কালো বস্তা ওর দু’দিকে বোঝাই করা আছে।” ঐ যাত্রী দলের মক্কায় আগমনের যে দিনের কথা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছিলেন, ঐ দিন যখন আসলো তখন দুপুরের সময় লোকেরা দৌড়িয়ে শহরের বাইরে গেল যে, দেখা যাক, তার কথা কতদূর সত্য? তারা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলো যে, যাত্রীদল আসছে এবং সত্য সত্যই এ উটটিই আগে রয়েছে। (এই হাদীসটি এইভাবে জামে তিরমিযীতে বর্ণিত রয়েছে। এই রিওয়াইয়াতই অন্যান্য কিতাবে দীর্থভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং তাতে বহু অস্বীকার্য (মুনকার) কথাও রয়েছে, যেমন বায়তুল লাহামে তাঁর নামায আদায় করা, হযরত সিদ্দীকে আকবরের (রাঃ) তাঁকে বায়তুল মুকাদ্দাসের নিদর্শন গুলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা, ইত্যাদি)

হযরত ইবনু আব্বাসের (রাঃ) রিওয়াইয়াতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মিরাজের রাত্রে যখন জান্নাতে তশরীফ আনেন তখন একদিক হতে পায়ের চাপের শব্দ শোনা যায়। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “হে জিবরাঈল (আঃ)! এটা কে?” উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “ইনি হচ্ছেন মুআযযিন হযরত বিলাল (রাঃ) ।” রাসুলল্লাহ (সঃ) মি’রাজ হতে ফিরে এসে বলেনঃ “হে বিলাল (রাঃ) ! তুমি মুক্তি পেয়ে গেছ। আমি এরূপ এরূপ দেখেছি।” তাতে রয়েছে যে, সাক্ষাতের সময় হযরত মূসা (আঃ) বলেনঃ “নবী উম্মীর (সঃ) আগমন শুভ হোক।” হযরত মূসা (আঃ) ছিলেন গোধূম বর্ণের দীর্ঘ অবয়ব বিশিষ্ট লোক। তার মাথার চুল ছিল কান পর্যন্ত অথবা কান হতে কিছুটা উঁচু।এতে আছে যে, প্রত্যেক নবী প্রথমে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) সালাম দিয়েছিলেন। জাহান্নাম পরিদর্শনের সময় তিনি কতকগুলি লোককে দেখতে পান যে, তারা মৃতদেহ ভক্ষণ করছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “এরা কারা?” হযরত জিবরাঈল (আঃ) উত্তর দিলেনঃ “যারা লোকদের গোশত ভক্ষণ করতো অর্থাৎ গীবত করতো।” সেখানেই তিনি একটি লোককে দেখতে পেলেন যে, স্বয়ং আগুনের মত লাল ছিল এবং চোখ ছিল বাঁকা ও টেরা। তিনি প্রশ্ন করলেনঃ “এটা কে?”উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এটাই হচ্ছে ঐ ব্যক্তি যে হযরত সালেহের (আঃ) উষ্ট্রীকে হত্যা করেছিল।

মুসনাদে আহমদে রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছিয়ে দিয়ে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে একই রাত্রে মক্কা শরীফে পৌঁছিয়ে দেন এবং এই খবর তিনি জনগণের মধ্যে প্রচার করেন, বায়তুল মুকাদ্দাসের নিদর্শনগুলি বলে দেন, তাদের যাত্রী দলের খবর প্রদান করেন তখন কতকগুলি লোক বললোঃ “এ সব কথায় আমরা তাঁকে সত্যবাদী মনে করি না।” একথা বলে তারা ইসলাম ধর্ম থেকে ফিরে যায়। এরা সবাই আবু জেহেলের সাথে নিহত হয়। আবু জেহেল বলতে শুরু করেঃ “এই লোকটি (নবী (সঃ) আমাদের যাককুম গাছের ভয় দেখাচ্ছে। খেজুর ও মাখন নিয়ে এসো এবং এ দ’টোকে মিশিয়ে খেয়ে নাও।” এ রাত্রে রাসুলল্লাহ (সঃ) দাজ্জালকে তার। প্রকৃত রূপে দেখেছিলেন, সেটা ছিল চোখের দেখা, স্বপ্নের দেখা নয়। সেখানে তিনি হযরত ঈসা (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত ইবরাহীমকেও (আঃ) দেখেছিলেন। দাজ্জালের সাদৃশ্য তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, সে বিশ্রী, ম্লেচ্ছ এবং ক্ষীণ দৃষ্টি সম্পন্ন। তার একটি চক্ষু এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, যেন তারকা এবং চুল এমন যেন কোন গাছের ঘন শাখা। হযরত ঈসার (আঃ) গঠন তিনি এইভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর রঙ সাদা, চুলগুলি কোঁকড়ানো এবং দেহ মধ্যমাকৃতির। আর হযরত মূসার (আঃ) দেহ গোধূম বর্ণের এবং তিনি দৃঢ় ও সুঠাম দেহের অধিকারী। হযরত ইবরাহীম (আঃ) হুবহু আমারই মত। (শেষ পর্যন্ত)।”

একটি রিওয়াওয়াতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জাহান্নামের দারোগা মালিককেও দেখেছিলেন ঐ নিদর্শনাবলীর মধ্যে যেগুলি আল্লাহ তাআলা তাকে দেখিয়েছিলেন। অতঃপর তার চাচাতো ভাই হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) পাঠ করেন (আরবি) (৩২:২৩) এই আয়াতটি। হযরত কাতাদা (রঃ) এর নিম্নরূপ তাফসীর করেছেনঃ “মূসার (আঃ) সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে তুমি সন্দেহ পোষণ করো না, আমি তাকে অর্থাৎ মূসাকে (আঃ) বাণী ইসরাঈলের হিদায়াতের জন্যে পাঠিয়েছিলাম।” (এই রিওয়াইয়াতটি সহীহ মুসলিমেও বর্ণিত হয়েছে)

অন্য সনদে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মিরাজের রাত্রে এক স্থান হতে আমার কাছে এক অতি উচ্চমানের খুশবৃ’র সুগন্ধ আসছিল। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এই খুশবু কিরূপ? হযরত জিবরাঈল (আঃ) উত্তরে বললেনঃ “ফিরাউনের কন্যার পরিচারিকা এবং তার সন্তানদের প্রাসাদ হতে এই সুগন্ধ আসছে। একদা এই পরিচারিকা ফিরাউনের কন্যার চুল আঁচড়াচ্ছিল। ঘটনাক্রমে তার হাত হতে চিরুণী পড়ে যায়। অকস্মাৎ তার মুখ দিয়ে বিসমিল্লাহ বেরিয়ে যায়। তখন শাহজাদী তাকে বলেঃ “আল্লাহ তো আমার আব্বা”। পরিচারিকাটি তার একথায় বললোঃ “না, বরং আল্লাহ তিনিই যিনি আমাকে, তোমাকে এবং স্বয়ং ফিরাউনকে জীবিকা দান করে থাকেন।” শাহজাদী বললোঃ “তাহলে তুমি কি আমার পিতাকে ছাড়া অন্য কাউকেও তোমার প্রতিপালক স্বীকার করে থাকো?” জবাবে সে বললোঃ “হাঁ, আমার, তোমার এবং তোমার পিতার, সবারই প্রতিপালক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলাই।” শাহজাদী এ সংবাদ তার পিতা ফিরআউনের কাছে পৌঁছিয়ে দিলো। এতে ফিরাউন ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে গেল এবং তৎক্ষণাৎ তার দরবারে তাকে ডেকে পাঠালো। সে তার কাছে হাজির হলো। তাকে সে জিজ্ঞেস করলোঃ “তুমি কি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকেও তোমার প্রতিপালক স্বীকার করে থাকো?” উত্তরে সে বললোঃ “হাঁ, আমার এবং আপনার প্রতিপালক আল্লাহ তাআ'লাই বটে।” তৎক্ষণাৎ ফিরাউন নির্দেশ দিলোঃ “তামার যে গাভীটি নির্মিত আছে ওকে খুবই গরম কর। যখন ওটা সম্পূর্ণরূপে আগুনের মত হয়ে যাবে তখন তার ছেলে মেয়েগুলিকে এক এক করে ওর উপর নিক্ষেপ কর। পরিশেষে তাকে নিজেকেও তাতে নিক্ষেপ করবে।” তার এই নিদের্শ অনুযায়ী ওটাকে গরম করা হলো এবং যখন আগুনের মত হয়ে গেল তখন তার সন্তানদেরকে একের পর এক তীতে নিক্ষেপ করতে শুরু করলো। পরিচারিকাটি বাদশাহর কাছে একটি আবেদন জানিয়ে বললোঃ “আমার এবং আমার এই সন্তানদের অস্থিগুলি একই জায়গায় নিক্ষেপ করবেন।” বাদশাহ তাকে বললোঃ “ঠিক আছে, তোমার এই আবেদন মঞ্জুর করা হলো। কারণ, আমার দায়িত্বে তোমার অনেকগুলি হক বা প্রাপ্য বাকী রয়ে গেছে।” যখন তার সমস্ত সন্তানকে তাতে নিক্ষেপ করা হয়ে গেল এবং সবাই ভষ্মে পরিণত হলো তখন তার সর্বকনিষ্ঠ শিশুটির পালা আসলো। এই শিশুটি তার মায়ের স্তনে মুখ লাগিয়ে দুধপান করছিল। ফিরাউনের সিপাহীরা শিশুটিকে যখন তার মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নিলো তখন ঐ সতী সাধ্বী মহিলাটির চোখের সামনে শিশুটির মুখ। ফুটে গেল এবং উচ্চ স্বরে বললোঃ আম্মাজান! দুঃখ করবেন না। মোটেই আফসোস করবেন না। সত্যের উপর জীবন উৎসর্গ করাই তো হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুণ্যের কাজ।” শিশুর এ কথা শুনে মায়ের মনে সবর এসে গেল। অতঃপর ঐ শিশুটিকে তাতে নিক্ষেপ করে দিলো এবং সর্বশেষে মাতাকেও তাতে ফেলে দিলো। এই সুগন্ধ তাদের বেহেৰ্তী প্রাসাদ হতেই আসছে (আল্লাহ তাদের সবারই প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই ঘটনাটি বর্ণনা করার পরেই একথাও বর্ণনা করেন যে, চারটি শিশু দোলনাতেই কথা বলছিল। একটি হচ্ছে এই শিশুটি। দ্বিতীয় হচ্ছে ঐ শিশুটি যে হযরত ইউসুফের (আঃ) পবিত্রতার সাক্ষ্য প্রদান করেছিল। তৃতীয় হলো ঐ শিশুটি যে আল্লাহর ওয়ালী হযরত জুবায়েজের (রাঃ) পবিত্রতার সাক্ষ্য দিয়েছিল। আর চতুর্থ হলেন হযরত ঈসা ইবনু মরিয়ম (আঃ)। (এই রিওয়াইয়াতটির সনদ ত্রুটি মুক্ত)

অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “মিরাজের রাত্রের সকালে আমার দৃঢ় বিশ্বাস হলো যে, জনগণের সামনে এ ঘটনা বর্ণনা করলেই তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলবে।” সুতরাং তিনি দুঃখিত মনে এক প্রান্তে বসে পড়লেন। ঐ সময় আল্লাহ তাআলার শত্রু আবু জেহেল সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। তাঁকে দেখে সে তাঁর পার্শ্বেই বসে পড়লো এবং উপহাস করে বললোঃ “কোন নতুন খবর আছে কি?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হাঁ, আছে।” সে তা জানতে চাইলো। তিনি বলেনঃ “ আজ রাত্রে আমাকে ভ্রমণ করানো হয়েছে।” সে প্রশ্ন করলোঃ “ কত দূর পর্যন্ত?” তিনি জবাবে বললেনঃ “বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত।” সে জিজ্ঞেস করলোঃ “ আবার এখন এখানে। বিদ্যমানও রয়েছো?” তিনি উত্তর দিলেনঃ হাঁ।” এখন ঐ কষ্টদায়ক ব্যক্তি মনে মনে বললোঃ “এখনই একে মিথ্যাবাদী বলে দেয়া ঠিক হবে না। অন্যথায় হয়তো জনসমাবেশে সে এ কথা বলবেই না।” তাই, সে তাঁকে জিজ্ঞেস করলোঃ “এই লোকটি! আমি যদি জনগণকে একত্রিত করি তবে তুমি সবারই সামনেও কি একথাই বলবে?” জবাবে তিনি বললেনঃ “কেন বলবো না? সত্য কথা গোপন করার তো কোন প্রয়োজন নেই।” তৎক্ষণাৎ সে উচ্চ স্বরে ডাক দিয়ে বললোঃ “হে বানু কাব -ঈর সন্তানরা! তোমরা এসে পড়।” সবাই তখন দৌড়ে এসে তার পাশে বসে পড়ে। এ অভিশপ্ত ব্যক্তি (আবু জেহেল) তখন তাঁকে বললোঃ “এখন তুমি তোমার কওমের সামনে এ কথা বর্ণনা কর যে কথা আমার সামনে বর্ণনা করছিলে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সামনে বলতে শুরু করেনঃ “আজ রাত্রে আমাকে ভ্রমণ করানো হয়েছে।” সবাই জিজ্ঞেস করলোঃ “কতদূর পর্যন্ত ভ্রমণ করে এসেছো?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত।” জনগণ প্রশ্ন করলোঃ “এখন আবার আমাদের মধ্যেই বিদ্যমানও রয়েছো?” তিনি জবাব দিলেনঃ “হাঁ”। তাঁরা এ কথা শুনে কেউ তো হাত তালি দিতে শুরু করলো, কেউ বা অতি বিস্ময়ের সাথে নিজের হাতের উপর হাত রেখে বসে পড়লো এবং তার অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করতঃ সবাই একমত হয়ে তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে ধারণা করলো। আবার কিছুক্ষণ পর তারা তাকে বললোঃ “আচ্ছা, আমরা তোমাকে তথাকার কতকগুলি অবস্থা ও নিদর্শন সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছি, তুমি উত্তর দিতে পারবে কি?” তাদের মধ্যে এমন কতকগুলি লোকও ছিল যারা বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছিল এবং তথাকার অলিগলি সম্পর্কে ছিল পূর্ণ ওয়াকিফহাল। রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “কি জিজ্ঞেস করবে কর।” তারা জিজ্ঞেস করতে থাকলো এবং তিনি উত্তর দিতে থাকলেন। তিনি বলেনঃ তারা আমাকে এমন কতকগুলি সূক্ষ্ম প্রশ্ন করেছিল যেগুলি আমাকে কিছুটা হতভম্ব করে ফেলেছিল। তৎক্ষণাৎ মসজিদটিকে আমার সামনে করে দেয়া হয়। তখন আমি দেখতে ছিলাম ও বলতে ছিলাম। তোমরা এটাই মনে কর যে, মসজিদটি ছিল আকীলের বাড়ীর পার্শ্বে বা আক্কালের বাড়ীর পার্শ্বে। এটা একারণেই যে, মসজিদের কতকগুলি সিফত বা বিশেষণ আমার স্মরণ ছিল না।” তাঁর এই নিদর্শনগুলির বর্ণনার পর সবাই সমস্বরে বলে উঠলোঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) খুঁটিনাটি ও সঠিক বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহর কসম! তিনি একটি কথাও ভুল বলেননি।” (এই হাদীসটি সুনানে নাসাঈ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থেও বিদ্যমান রয়েছে)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মি'রাজ করানো হয় তখন তিনি সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছেন যা সপ্তম আকাশে রয়েছে। যে জিনিস উপরে উঠে তা এখন পর্যন্ত পৌঁছে, তারপর এখান থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। আর যে জিনিস অবতরণ করে তা এখন পর্যন্ত অবতারিত হয় এবং তারপর এখান থেকে গ্রহণ করা হয়। এ গাছের উপর সোনার ফড়িং ছেয়েছিল। রাসূলুল্লাহকে (সঃ) পাঁচ ওয়াক্তের নামায এবং সূর্যয়ে বাকারার শেষের আয়াতগুলি দেয়া হয় এবং এটাও দেয়া হয় যে, তাঁর উম্মতের মধ্যে যারা শিরক করবে না তাদের কাবীরা গুনাহ গুলিও মাফ করে দেয়া হবে। (এই হাদীসটি ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থেও এই রিওয়াইয়াতটি হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে মি'রাজের সুদীর্ঘ হাদীস রূপে বর্ণিত আছে। হাসান ইবনু আরফা (রঃ) তাঁর প্রসিদ্ধ খণ্ডে এটা আনয়ন করেছেন। এতে দুর্বলতা রয়েছে)

হযরত আবু যারবান (রঃ) বলেনঃ আমরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদের (রাঃ) পুত্র হযরত আবু উবাইদার (রাঃ) পার্শ্বে বসে ছিলাম, তার পাশে হযরত মুহাম্মদ ইবনু সা'দ ইবনু সা'দ ইবনু আবি অক্কাসও (রাঃ) বিদ্যমান ছিলেন। হযরত মুহাম্মদ ইবনু সা'দ (রাঃ) হযরত আবু উবাইদাকে (রাঃ) বললেনঃ “আপনি মিরাজ সম্পর্কে আপনার পিতার নিকট থেকে যা শুনেছেন তা বর্ণনা করুন।” তিনি বললেনঃ “না, বরং আপনি যা আপনার পিতার নিকট থেকে শুনেছেন তা আমাদেরকে শুনিয়ে দিন।” তিনি তখন বর্ণনা করতে শুরু করলেন। তাতে এটাও রয়েছে যে, বুরাক যখন উপরের দিকে উঠতো তখন তার হাত-পা সমান হয়ে যেতো। অনুরূপভাবে যখন নীচের দিকে নামতো তখনও সমানই থাকতো, যাতে আরোহীর কোন কষ্ট না হয়। তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমরা এক ব্যক্তির পার্শ্ব দিয়ে গমন করলাম যিনি ছিলেন দীর্ঘাকৃতির লোক। চুল ছিল সোজা এবং বর্ণ ছিল গোধূম। তিনি ছিলেন । এমনই যেমন ইদে শিনওয়ার গোত্রের লোক হয়ে থাকে। তিনি উচ্চ স্বরে বলতে ছিলেনঃ “আপনি তাঁকে সম্মান দিয়েছেন এবং তাঁকে মর্যাদা দান করেছেন। আমরা তাকে সালাম করলাম। তিনি উত্তর দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হে জিবরাঈল (আঃ)! ইনি কে? উত্তরে তিনি বললেনঃ “ইনি হলেন আহমদ (সঃ)।” তিনি তখন বললেনঃ “আরবী নবী উম্মীকে (সঃ) মারহাবা, যিনি তাঁর প্রতিপালকের রিসালাত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং নিজের উম্মতের মঙ্গল কামনা করেছেন। এরপর আমরা ফিরে আসলাম। আমি হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করলামঃ ইনি কে? জবাবে তিনি বললেনঃ “ইনি হলেনঃ মূসা ইবনে ইমরান (আঃ)।” আমি আবার তাঁকে প্রশ্ন করলামঃ এরূপ ভাষায় তিনি কার সাথে কথা বলছিলেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ “আপনার ব্যাপারে তিনি আল্লাহ তাআলার সাথে কথা বলেছিলেন।”আমি বললামঃ আল্লাহর সাথে এবং এই ভাষায়? তিনি জবাব দিলেনঃ “হাঁ, তার তেজস্বিতা, সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সম্যক অবগত।” তারপর আমরা একটা গাছের কাছে গেলাম যার ফলগুলি ছিল প্রদীপের মত। ঐ গাছের নীচে এক সম্ভ্রান্ত লোক বসেছিলেন, যার পার্শ্বে অনেক ছোট ছোট শিশু ছিল। হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমাকে বললেনঃ “চলুন, আপনার পিতা হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) ‘সালামুন আলাইকা (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলুন।” আমরা সেখানে গিয়ে তাঁকে সালাম করলাম। তিনি জবাব দিলেন। তারপর হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) তিনি আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। তিনি জবাবে বললেনঃ “ইনি হলেন আপনার ছেলে আহমাদ (সঃ)।” তখন তিনি বললেনঃ “নবী উম্মীকে (সঃ) মারহাবা, যিনি তাঁর প্রতিপালকের পয়গাম পূর্ণভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং নিজের উম্মতের কল্যাণ কামনা করেছেন। আমার ভাগ্যবান ছেলের আজ রাত্রে তাঁর প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ হবে। তাঁর উম্মত সর্বশেষ উম্মত এবং সবচেয়ে দুর্বলও বটে। খেয়াল রাখতে হবে যেন তাদের উপর এমন কাজের দায়িত্বভার অর্পিত হয় যা তাদের পক্ষে সহজ। হয়।”তারপর আমরা মসজিদে আকসায় পৌঁছলাম। আমি নেমে বুরাককে ঐ হলকায় বাঁধলাম যেখানে নবীরা বাঁধতেন। তারপর আমরা মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করলাম। সেখানে আমি নবীদের পরিচয় পেলাম ও তাঁদের সাথে পরিচিত হলাম। তাঁদের কেউ নামাযে দণ্ডায়মান ছিলেন, কেউ ছিলেন রুকুতে এবং কেউ ছিলেন সিজদাতে। এরপর আমার কাছে মধু ও দুধের পাত্র আনয়ন করা হলো। আমি দুধের পাত্রটি নিয়ে তা পান করলাম। হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার ঋন্ধে হাত রেখে বললেন মুহাম্মদ (সঃ)-এর রবের পশথ! আপনি ফিাতে (প্রকৃতিতে) পৌছে গেছেন। তারপর নামাযের তাকবীর হলো এবং সকলকে আমি নামায পড়ালাম। এরপর আমরা ফিরে আসলাম।” (এর ইসনাদ দুর্বল। মনের মধ্যেও অস্বাভাবিকতা রয়েছে। যেমন নবীদের পরিচয় লাভ করার জন্যে তাঁর প্রশ্ন করা, তারপর তাঁর তাঁদের নিকট থেকে যাওয়ার পর তাঁদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্যে প্রশ্নকরণ ইত্যাদি। অথচ সহীহ হাদীস সমূহে রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রথমেই তাঁকে বলে আসছিলেন যে, ইনি হলেন অমুক নবী, যাতে সালামটা হয় পরিচিতির পর। তারপর এতে রয়েছে যে, নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদে প্রবেশ করার পূর্বেই। অথচ বিশুদ্ধ রিওয়াইয়াত সমূহে আছে যে, তাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল বিভিন্ন আসমানে। তারপর দ্বিতীয়বার অবতরণরত অবস্থায় ফিরবার পথে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদে আগমন করেন। তাঁরাও সবাই তার সাথে ছিলেন এবং সেখানে তিনি তাঁদেরকে নামায পড়ান। তারপর বুরাকের উপর সওয়ার হয়ে তিনি মক্কা শরীফ পোঁছেন। এ সব ব্যাপারে সর্বাধিক সটিক জ্ঞানের অধিকারী হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ)

হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, মিরাজের রাত্রে হযরত ইবরাহীম (আঃ), হযরত মূসা (আঃ) এবং হযরত ঈসার (আঃ) সঙ্গে রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাক্ষাৎ হয়। সেখানে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে আলোচনা হয়। হযরত ইবরাহীম (আঃ) বলেনঃ “কিয়ামতের নির্দিষ্ট সময় আমার জানা নেই। এটা হযরত মূসাকে (আঃ) জিজ্ঞেস করুন।” তিনিও এটা না জানার খবর প্রকাশ করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, এ ব্যাপারে হযরত ঈসাকে (আঃ) জিজ্ঞেস করা হোক। হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ “এর সঠিক সংবাদ তো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানে না, তবে আমাকে এটুকু জানানো হয়েছে যে, দাজ্জাল বের হবে। এ সময় আমার হাতে থাকবে দুটি ছড়ি। সে আমাকে দেখা মাত্রই সীসার মত গলে যাবে। অবশেষে আমার কারণে আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করে দিবেন। তারপর গাছ এবং পাথরও বলে উঠবেঃ হে মুসলমান! দেখ, আমার নীচে এক কাফির লুকিয়ে আছে, তাকে হত্যা কর।” সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকেই ধ্বংস করে দিবেন। জনগণ প্রশান্ত মনে নিজেদের শহরে ও দেশে ফিরে যাবে। ঐ যুগেই ইয়াজুজ মাজুজ বের হবে। তারা প্রত্যেকে উঁচু স্থান হতে লাফাতে লাফাতে আসবে। তারা যা পাবে তাই ধ্বংস করে দেবে। পানি দেখলে তা পান করে ফেলবে। শেষ পর্যন্ত মানুষ অসহ্য হয়ে আমার কাছে অভিযোগ করবে। আমি তখন মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবো। তিনি তাদেরকে একই সাথে ধ্বংস করে দিবেন। কিন্তু তাদের মৃতদেহের দুর্গন্ধের কারণে চলাফেরা মুশকিল হয়ে পড়বে। এ সময় আল্লাহ তাআলা বৃষ্টি বর্ষণ করবেন, যা তাদের মৃত দেহগুলিকে বইয়ে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেবে। আমার খুব ভাল রূপেই জানা আছে যে, এরপরেই কিয়ামত সংঘটিত হয়ে যাবে। যেমন পূর্ণ দিনের গর্ভবতী মহিলা জানতে পারে না যে, হয়তো সকালেই সে সন্তান প্রসব করবে, না হয় রাত্রে প্রসব করবে।” (এটা ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন)

আর একটি হাদীসে রয়েছে যে, যেই রাত্রে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মসজিদে হারাম হতে বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়, ঐ রাত্রে তিনি যমযম কূপ ও মাকামে ইবরাহীমের (আঃ) মাঝামাঝি জায়গায় ছিলেন, এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) ডান দিক থেকে এবং হযরত মীকাঈল (আঃ) বাম দিক থেকে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি আকাশের উচ্চতম স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যান। ফিরবার সময় তিনি তাঁদের তসবীহ এবং অন্যান্যদের তসবীহ পাঠ শুনতে পান। এই রিওয়াইয়াত এই সূরারই (আরবি) (১৭:৪৪) এর আয়াতের তফসীরে আসবে।

মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, আমীরুল মু'মিনীন হযরত উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) একবার জাবিয়াহ্ নামক জায়গায় ছিলেন। এ সময় বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের আলোচনা হয়। হযরত কা’বকে (রাঃ) তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার ধারণায় আমাকে সেখানে কোন জায়গায় নামায পড়া উচিত?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমাকে যখন জিজ্ঞেস করছেন তখন আমার মতে সাখরার পিছনে আপনার নামায পড়া উচিত যাতে বায়তুল মুকাদ্দাস আপনার সামনে হয়।” একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “তাহলে তুমি তো ইয়াহূদীদের সাথেই সাদৃশ্য স্থাপন করলে? আমি তো ঐ জায়গাতেই নামায পড়বো যেখানে নবী (সঃ) নামায পড়েছিলেন।” সুতরাং তিনি সামনে অগ্রসর হয়ে কিবলার দিক হয়ে নামায আদায় করেন। নামায শেষে তিনি সাখরার আশ পাশের সমস্ত খড়কুটা কুড়িয়ে একত্রিত করেন এবং ওগুলি নিজের চাদরে বেঁধে বাইরে ফেলে দিতে শুরু করেন। তার দেখা দেখি জনগণও এরূপ করেন। সুতরাং ঐ দিন তিনি ইয়াহূদীদের মত সাখরার সম্মানও করলেন না যে, তারা ওর পিছনে নামাযও পড়তো, এমনকি তারা ওটাকে কিবলা বানিয়ে রেখেছিল। হযরত কা'ব (রাঃ) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ইয়াহূদী ছিলেন বলেই তিনি এই মতই পেশ করেছিলেন, যা খলীফাতুল মুসলেমীন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আবার খৃস্টানদের মত তিনি সাখরার প্রতি তাচ্ছিল্যও প্রকাশ করলেন না। তারা তো সাখরাকে খড়কুটা ফেলার জায়গা বানিয়ে নিয়েছিল। বরং স্বয়ং তিনি সেখান থেকে খড় কুটা কুড়িয়ে নিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করেন। এটা ঠিক ঐ হাদীসের সাথেই সাদৃশ্য যুক্ত যেখানে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা কবরের উপর বসো না এবং ঐ দিকে নামাযও পড়ো না।”

মিরাজ সম্পর্কিত একটি সুদীর্ঘ ‘গারীব’ হাদীস হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেও বর্ণিত আছে। তাতে রয়েছে যে, হযরত জিবরাঈল (আঃ) ও হযরত মীকাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহর (সঃ) নিকট আগমন করেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) হযরত মীকাঈলকে (আঃ) বলেনঃ “আমার কাছে থালা ভর্তি যমযমের পানি নিয়ে এসো। আমি ওর দ্বারা হযরত মুহাম্মদের (সঃ) অন্তর পবিত্র করবো এবং তাঁর বক্ষ খুলে দিবো।” অতঃপর তিনি তাঁর পেট বিদীর্ণ করলেন এবং ওটা তিনবার ধৌত করলেন। তিনবারই তিনি হযরত মীকাঈলের (আঃ) আনিত পানির তশত দ্বারা তা ধুলেন। তাঁর বক্ষ খুলে দিলেন এবং ওর থেকে সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ ও কালিমা দূর করে দিলেন। আর ওটা ঈমান ও ইয়াকীন দ্বারা পূর্ণ করলেন। তাতে ইসলাম ভরে দিলেন এবং তার দু' কাধের মাঝে মহরে নুবুওয়াত স্থাপন করলেন। তারপর তাকে একটি ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে তাঁকে নিয়ে হযরত জিবরাঈল (আঃ) চলতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) দেখতে পেলেন যে, এক কওম একদিকে ফসল কাটছে, অন্যদিকে ফসল গজিয়ে যাচ্ছে। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ “এ লোকগুলি কারা?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “এরা হচ্ছে আল্লাহর পথের মুজাহিদ যাদের পুণ্য সাতশ'গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। তারা যা খরচ করে তার প্রতিদান তারা পেয়ে থাকে। আল্লাহ তাআলা উত্তম রিযক দাতা।” তার পর তিনি এমন কওমের পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন যাদের মস্তক প্রস্তর দ্বারা পিষ্ট করা হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “এ লোকগুলি কারা?” জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ এরা হচ্ছে ঐ সব লোক যাদের মাথা ফরয নামাযের সময় ভারী হয়ে যেতো।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এমন কতকগুলি লোককে আমি দেখলাম যাদের সামনে ও পিছনে বস্ত্র খণ্ড লটকানো আছে এবং তারা উট ও অন্যান্য জন্তুর মত জাহান্নামের কাঁটাযুক্ত গাছ খাচ্ছে এবং দুযখের পাথর ও অঙ্গার ভক্ষণ করছে। আমি প্রশ্ন করলামঃ এরা কারা? উত্তরে তিনি (জিবরাঈল আঃ) বললেনঃ “এরা ঐ সব লোক যারা তাদের মালের যাকাত প্রদান করতো। আল্লাহ তাদের উপর যুলুম করেন নাই, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করতো।”এরপর আমি এমন কতকগুলি লোককে দেখলাম যাদের সামনে একটি পাতিলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও উত্তম গোত রয়েছে এবং অপর একটি পাতিলে রয়েছে পচা-সড়া ও দুর্গন্ধময় গোশত। তাদেরকে ঐ উত্তম গোশত থেকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তারা ঐ পচা-সড়া ও দুর্গন্ধময় গোশত ভক্ষণ করছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এলাকগুলি কোন্ পাপ কার্য করেছিল? জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “এরা হলো ঐ সব পুরুষ লোক যারা নিজেদের হালাল স্ত্রীদেরকে ছেড়ে দিয়ে হারাম স্ত্রীদের পার্শ্বে রাত্রি যাপন করতো এবং ঐ সব স্ত্রীলোক যারা তাদের হালাল স্বামীদেরকে ছেড়ে অন্য পুরুষ লোকদের ঘরে রাত্রি কাটাতো।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) দেখেন যে, পথে একটি কাঠ রয়েছে এবং এটা প্রত্যেক কাপড়কে ছিড়ে দিচ্ছে এবং প্রত্যেক জিনিসকে যখম করছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এটা কি? জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এটা হচ্ছে আপনার উম্মতের ঐ লোকদের দৃষ্টান্ত যারা রাস্তা ঘিরে বসে যায়। অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তোমরা লোকদেরকে ভীত করা ও আল্লাহর পথ হতে বাধা দানের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক রাস্তার উপর বসো না। (৭:৮৬)।

রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আমি দেখলাম যে, একটি লোক এক বিরাট স্তুপ জমা করেছে যা সে উঠাতে পারছে না। অথচ আরো বাড়াতে রয়েছে। আমি প্রশ্ন করলামঃ এটা কে? জবাবে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বললেনঃ “এটা হচ্ছে আপনার উম্মতের ঐ লোক যার উপর মানুষের এতো বেশী হক বা প্রাপ্য রয়েছে যা আদায় করার ক্ষমতা তার নেই, তথাপি নিজের উপর আরো প্রাপ্য বাড়িয়ে চলেছে এবং জনগণের আমানত গ্রহণ করতেই আছে।” তারপর আমি। এমন একটি দল দেখলাম যাদের জিহ্বা ও ঠোঁট লোহার কেঁচি দ্বারা কর্তন করা হচ্ছে। একদিক কর্তিত হচ্ছে এবং অপর দিকে ঠিক হয়ে যাচ্ছে, আবার ঐ দিক কর্তিত হচ্ছে। এই অবস্থায়ই অব্যাহত রয়েছে। জিজ্ঞেস করলামঃ এরা। কারা? হযরত জিবরাঈল (আঃ) উত্তরে বললেনঃ এরা হচ্ছে ফিৎনা ফাসাদ সৃষ্টিকারী বক্তা ও উপদেষ্টা।” তারপর দেখি যে, একটি ছোট পাথরের ছিদ্র দিয়ে একটি বিরাট বলদ বের হচ্ছে এবং আবার তাতে ফিরে যেতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরাঈল (আঃ)! এটা কে? জবাবে তিনি বললেনঃ “যে মখে খুব বড় বড় বুলি আওড়াতো, তারপর লজ্জিত হতো বটে, কিন্তু ওর থেকে ফিরতে পারতো না।” তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি উপত্যকায় পৌঁছেন। সেখানে অত্যন্ত সুন্দর মন মাতানো ঠাণ্ডা বাতাস এবং মনোমুগ্ধকর সুগন্ধ ও আরাম ও শান্তির বরকতময় শব্দ শুনে তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “এটা কি?” উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “এটা হচ্ছে। জান্নাতের শব্দ। সে বলছেঃ “হে আমার প্রতিপালক! আমার সাথে আপনি যে ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ করুন! আমার অট্টালিকা, রেশম, মনিমুক্তা, সোনারূপা, জাম-বাটী, মধু, দুধ, মদ ইত্যাদি নিয়ামতরাজি খুব বেশী হয়ে গেছে।” তাকে তখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে জবাব দেয়া হয়ঃ “প্রত্যেক মুসলমান-মুমিন নর ও নারী যে আমাকে ও আমার রাসূলদেরকে মেনে চলে, ভাল কাজ করে, আমার সাথে কাউকে শরীক করে না, আমার সমকক্ষ কাউকেও মনে করে না, তারা সবাই তোমার মধ্যে প্রবেশ করবে। জেনে রেখো, যার অন্তরে আমার ভয় আছে সে সমস্ত ভয় থেকে রক্ষিত থাকবে। যে আমার কাছে চায় সে বঞ্চিত হয় না। যে আমাকে কর্জ দেয় (অর্থাৎ কর্জে হাসানা দেয়) তাকে আমি প্রতিদান দিয়ে থাকি। যে আমার উপর ভরসা করে আমি তার জন্যে যথেষ্ট হই। আমি সত্য মা’রূদ। আমি ছাড়া অন্য কোন মাবুদ নেই। আমি ওয়াদার খেলাফ করি না। মুমিন মুক্তিপ্রাপ্ত। আল্লাহ তাআলা কল্যাণময়। তিনি সর্বোত্তম সৃষ্টিকর্তা।” একথা শুনে জান্নাত বললোঃ “যথেষ্ট হয়েছে। আমি খুশী হয়ে গেলাম। এরপর আমি অন্য একটি উপত্যকায় গেলাম। যেখান থেকে বড় ভয়ানক ও জঘন্য শব্দ আসছিল। আর ছিল খুবই দুর্গন্ধ। আমি এসম্পর্কে হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “এটা হচ্ছে জাহান্নামের শব্দ। সে বলছেঃ “হে আমার প্রতিপালক। আপনি আমার সাথে যে, ওয়াদা করেছেন তা পূর্ণ করুন! আমাকে তা দিয়ে দিন! আমার শৃংখল, আমার অগ্নিশিখা, আমার প্রখরতা, আমার রক্ত-পূজ এবং আমার শাস্তির আসবাবপত্র খুবই বেশী হয়ে গেছে, আমার গভীরতাও অত্যন্ত বেড়ে গেছে এবং আমার অগ্নি ভীষণ তেজ হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমার মধ্যে যা দেয়ার আপনি ওয়াদা করেছেন তা দিয়ে দিন!” আল্লাহ তাআলা তখন তাকে বলেনঃ “প্রত্যেক মুশরিক কাফির, খবীস, বেঈমান পুরুষ ও নারী তোমার জন্যে রয়েছে।” একথা শুনে জাহান্নাম সন্তোষ প্রকাশ করলো।”

রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবার চলতে থাকলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছে গেলেন। নেমে তিনি সাখরার স্তম্ভে ঘোড়া বাঁধলেন এবং ভিতরে গিয়ে ফেরেশতাদের সাথে নামায আদায় করলেন। নামায শেষে তারা জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে জিবরাঈল (আঃ)! আপনার সাথে ইনি কে?” তিনি জবাব দিলেনঃ “ ইনি হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।” তাঁরা আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ তার কাছে কি পাঠানো হয়েছিল?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ”। সবাই তখন মারহাবা বললেন এবং আরো বললেনঃ “উত্তম ভাই, অতি উত্তম প্রতিনিধি। তিনি খুবই বড় মর্যাদার সাথে এসেছেন। তারপর তার সাক্ষাৎ হলো নবীদের রূহগুলির সাথে। সবাই নিজেদের প্রতিপালকের প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলেন। হযরত ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ “আমি আল্লাহ তাআলার নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি আমাকে নিজের বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন এবং আমাকে বড় রাজ্য দান করেছেন। আর আমার উম্মত এমনই অনুগত যে, তাদের অনুসরণ করা হয়ে থাকে। তিনিই আমাকে আগুন থেকে রক্ষা করেছেন। এবং ওটাকে আমার জন্যে ঠাণ্ডা ও প্রশান্তি বানিয়েছেন।” হযরত মূসা (আঃ) বললেনঃ “এটা আল্লাহ তাআলারই বড় মেহেরবানী যে, তিনি আমার সাথে কথা বলেছেন, আমার শত্রু ফিরআউনীদেরকে ধ্বংস করেছেন, বাণী ইসরাঈলকে আমার মাধ্যমে মুক্তি দিয়েছেন এবং আমার উম্মতের মধ্যে এমন দল রেখেছেন যারা সত্যের পথ প্রদর্শক এবং ন্যায়ের সাথে বিচার মীমাংসাকারী।”

তারপর হযরত দাউদ (আঃ) আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণকীর্তণ করতে শুরু করলেন। তিনি বললেনঃ “সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যে, তিনি আমাকে বিরাট সাম্রাজ্য দান করেছেন। আমাকে দান করেছেন তিনি অলংকার তৈরীর জ্ঞান। আমার জন্যে তিনি লোহাকে নরম করে দিয়েছেন, পাহাড় পবর্তকে করেছেন অনুগত। এমনকি পাখীরাও আমার সাথে আল্লাহর তসবীহ পাঠ করতো। তিনি আমাকে দান করেছেন হিকমত ও জোরালোভাবে বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতা।”

এরপর হযরত সুলাইমান (আঃ) আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করতে শুরু করেন। তিনি বলেনঃ “যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তাআলারই জন্যে যে, তিনি বায়ুকে আমার বাধ্য করে দিয়েছেন এবং শয়তানদেরকেও করেছেন আমার অনুগত। তারা আমার নির্দেশ অনুযায়ী বড় বড় প্রাসাদ, নকশা, পাত্র ইত্যাদি তৈরী করতো। তিনি আমাকে জীব জন্তুর ভাষা বুঝার জ্ঞান দান করেছেন। সব কিছুর উপর তিনি আমাকে মর্যাদা দিয়েছেন। দানব, মানব এবং পাখীর “ লশকরকে আমার অধীনস্থ করে দিয়েছেন এবং তাঁর বহু মু'মিন বান্দাদের উপর আমাকে ফযীলত দান করেছেন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য ও রাজত্ব দান করেছেন যা আমার পরে আর কারো জন্যে শোভনীয় নয়। আর তা আবার এমন যে, তাতে অপবিত্রতার লেশমাত্র নেই এবং কোন হিসাবও নেই।

অতঃপর হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করতে শুরু করেন। তিনি বলেনঃ “তিনি আমাকে নিজের “কালেমা বানিয়েছেন এবং আমার দৃষ্টান্ত হচ্ছে হযরত আদমের (আঃ) মত। তাকে তিনি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করে বলেছিলেনঃ ‘হও’, আর তেমনই তিনি হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে কিতাব, হিকমত, তাওরাত, ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছেন। আমি মাটি দ্বারা পাখি তৈরী করতাম, তারপর তাতে ফুক মারতাম, তখন উড়ে যেতো। আমি জন্মান্ধ ও শ্বেত কুষ্ঠরোগীকে আল্লাহর হুকুমে ভাল করে দিতাম। আল্লাহর নির্দেশক্রমে আমি মৃতকে জীবিত করতাম। আমাকে তিনি উঠিয়ে নিয়েছেন এবং আমাকে পবিত্র করেছেন। আমাকে ও আমার মাতাকে শয়তান থেকে রক্ষা করেছেন। শয়তান আমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারতো না।”

এখন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) বলেনঃ “আপনারা তো আল্লাহ তাআলার প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলেন, আমি এখন তাঁর প্রশংসা করছি। আল্লাহ তাআলার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা যিনি আমাকে বিশ্বশান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। তিনি আমাকে সমস্ত সৃষ্ট জীবের জন্যে ভয় প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা বানিয়েছেন। তিনি আমার উপর কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন। যাতে সমস্ত কিছুর বর্ণনা রয়েছে। তিনি আমার উম্মতকে সমস্ত উম্মতের উপর ফযীলত দান করেছেন। তাদেরকে সকলের মঙ্গলের জন্যে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদেরকে করেছেন সর্বোত্তম উম্মত। তাদেরকেই তিনি প্রথমের ও শেষের উম্মত বানিয়েছেন। তিনি আমার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে আমার মধ্যকার সমস্ত হিংসা-বিদ্বেষ ও গ্লানি দূর করেছেন। আমার খ্যাতি তিনি সমুন্নত করেছেন এবং আমাকে তিনি শুরুকারী ও শেষকারী বানিয়েছেন।” হযরত ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ “হে মুহাম্মদ (সঃ)! এসব কারণেই আপনি সবারই উপর ফযীলত লাভ করেছেন।

ইমাম আবু জাফর রাযী (রঃ) বলেনঃ “হযরত মুহাম্মদই (সঃ) শুরুকারী অর্থাৎ কিয়ামতের দিন শাফাআত বা সুপারিশ তাঁর থেকেই শুরু হবে। অতঃপর রাসূলুল্লাহর (সঃ) সামনে উপরাচ্ছাদিত তিনটি পাত্র পেশ করা হয়। পানির পাত্র হতে সামান্য পানি পান করে তা ফিরিয়ে দেন। তারপর দুধের পাত্র নিয়ে তিনি পেট পুরে দুধ পান করেন। এরপর তাঁর কাছে মদের পাত্র আনয়ন করা হয়, কিন্তু তিনি তা পান করতে অস্বীকার করেন এবং বলেনঃ “আমার পেট পূর্ণ হয়ে গেছে এবং আমি পরিতৃপ্ত হয়েছি।” হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁকে বললেনঃ “এই মদ আপনার উম্মতের জন্যে হারাম করে দেয়া হবে। যদি আপনি এর থেকে পান করতেন তবে আপনার উম্মতের মধ্যে আপনার অনুসারী খুবই কম হতো।”

এরপর রাসূলুল্লাহকে (সঃ) আকাশের দিকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দরজা খুলতে বলা হলে প্রশ্ন হয়ঃ “কে?” হযরত জিবরাঈল (আঃ) উত্তর দেনঃ “হযরত মুহাম্মদ (সঃ)।” আবার প্রশ্ন করা হয়ঃ “তাঁর কাছে কি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে?” উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “হ” তারা তখন বলেনঃ “আল্লাহ তাআলা এই উত্তম ভাই ও উত্তম প্রতিনিধিকে সন্তুষ্ট রাখুন। ইনি বড়ই উত্তম ভাই এবং খুবই ভাল প্রতিনিধি।” তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে দেয়াহয়। রাসূলুল্লাহ (সঃ) দেখেন যে, পূর্ণ সৃষ্টির একটি লোক রয়েছেন, যার সৃষ্টিতে কোনই ত্রুটি নেই যেমন সাধারণ লোকের সৃষ্টির মধ্যে ত্রুটি থাকে। তার ডান দিকে রয়েছে একটি দরজা যেখান দিয়ে বাতাস সুগন্ধি বয়ে আনছে। বাম দিকেও রয়েছে একটি দরজা, যেখান দিয়ে দুর্গন্ধময় বাতাস বয়ে আসছে। ডান দিকের দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি হাসছেন এবং আনন্দিত হচ্ছেন। আর বাম দিকের দরজার দিকে তাকিয়ে তিনি কেঁদে ফেলছেন এবং দুঃখিত হচ্ছেন। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে জিবরাঈল (আঃ)! পূর্ণ সৃষ্টির এই বৃদ্ধ লোকটি কে? উত্তরে তিনি বললেনঃ “ইনি হলেন আপনার পিতা হযরত আদম (আঃ)। তার ডান দিকে রয়েছে জান্নাতের দরজা। তাঁর জান্নাতী সন্তানদেরকে দেখে তিনি খুশী হয়ে হাসছেন। আর তার বাম দিকে রয়েছে জাহান্নামের দরজা। তিনি তার জাহান্নামী সন্তানদের দেখে দুঃখিত হয়ে কেঁদে ফেলছেন।”

তারপর তাকে দ্বিতীয় আকাশের উপর উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অনুরূপ প্রশ্নোত্তরের পর আকাশের দরজা খুলে দেয়া হয় সেখানে তিনি দু'জন যুবককে দেখতে পান। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারেন যে, তাদের একজন হলেন হযরত ঈসা ইবনু মরিয়ম (আঃ) ও অপরজন হলেন হযরত ইয়াহইয়া ইবনু যাকারিয়া (আঃ)। তাঁরা দুজন একে অপরের খালাতো ভাই। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তৃতীয় আকাশে পৌঁছেন। সেখানে তিনি হযরত ইউসুফকে (আঃ) দেখতে পান, যিনি সৌন্দর্যে অন্যান্য লোকদের উপর এমনই ফযীলত লাভ করে ছিলেন যেমন ফযীলত রয়েছে চন্দ্রের সমস্ত তারকার উপর। অনুরূপভাবে তিনি চতুর্থ আকাশে পৌঁছেন। তথায় তিনি হযরত ইদরীসকে (আঃ) দেখতে পান, যাকে আল্লাহ তাআলা মর্যাদাপূর্ণ স্থানে উঠিয়ে নিয়েছেন। অনুরূপ প্রশ্ন ও উত্তরের আদান প্রদানের পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) পঞ্চম আকাশে পৌঁছেন। দেখেন যে, একজন বসে আছেন এবং তাঁর আশে পাশে কতকগুলি লোক রয়েছেন যারা তাঁর সাথে আলাপ করছেন। তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “ইনি কে?” উত্তরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) বলেনঃ “ইনি হলেন হযরত হারূণ (আঃ)। ইনি নিজের কওমের মধ্যে ছিলেন একজন হৃদয়বান ব্যক্তি। আর এই লোকগুলি হচ্ছে বাণী ইসরাঈল।” তারপর তিনি ষষ্ঠ আকাশে পৌঁছেন। সেখানে তিনি হযরত মূসাকে (আঃ) দেখতে পান। তিনি তাঁর চেয়েও উপরে উঠে যান দেখে তিনি কেঁদে ফেলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর কাঁদার কারণ হযরত জিবরাঈলের (আঃ) কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ “এঁর সম্পর্কে বানী ইসরাঈলের এই ধারণা ছিল যে, সমস্ত বানী আদমের মধ্যে আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁরই মর্যাদা সবচেয়ে বেশী। কিন্তু এখন তিনি দেখতে পেলেন যে, আল্লাহ তাআলার নিকট হযরত মুহাম্মদের (সঃ) মর্যাদাই সর্বাপেক্ষা বেশী। তাই, তিনি কেঁদে ফেললেন।”

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সপ্তম আকাশে পৌঁছেন। সেখানে তিনি এমন একটি লোককে দেখতে পান যার দাড়ীর কিছু অংশ সাদা হয়ে গিয়েছিল। তিনি জান্নাতের দরজার উপর একটি চেয়ার লাগিয়ে বসে ছিলেন। তার পার্শ্বে আরো কিছু লোকও ছিলেন। কতকগুলি চেহারা ঔজ্জ্বল ঝকঝকে, কিন্তু কতকগুলি চেহারায় ঔজ্জ্বল্য কিছু কম ছিল এবং রঙ এ কিছুটা ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এই লোকগুলি উঠে গিয়ে নদীতে ডুব দিলো। ফলে রঙ কিছুটা পরিষ্কার হলো। তারপর আর এক নহরে তারা ডুব দিলো। এবার রঙ আরো কিছুটা পরিচ্ছন্ন হলো। এরপর তারা তৃতীয় একটি নহরে গোসল করলো। এবার তাদের উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট লোকদের সাথে মিলিত ভাবে বসে পড়লো। এখন তারা তাদের মতই হয়ে গেল। হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) এঁদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “বৃদ্ধ লোকটি হলেন আপনার পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ)। সারা দুনিয়ার সাদা চুল সর্বপ্রথম তাঁরই দেখা যায়। ঐ উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট লোক হচ্ছে ঐ সব ঈমানদার লোক যারা মন্দ কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থেকেছে। আর যাদের চেহারায় কিছুটা কালিমা ছিল তারা হচ্ছে ঐ সব লোক যারা ভাল কাজের সাথে কিছু খারাপ কাজও করেছিল তারা তাওবা করায় মহান আল্লাহ তাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। প্রথমে তারা গোসল করেছে নহরে রহমতে, দ্বিতীয় বার নহের নিয়ামতিল্লা হতে এবং তৃতীয়বার নহরে শরাবে তহূরে। এই শরাব হচ্ছে জান্নাতীদের বিশিষ্ট শরাব বা মদ।”

এরপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছেন। তখন তাঁকে বলা হলোঃ “আপনার সুন্নাতের যারা অনুসরণ করবে তাদেরকে এখন পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়া হবে। এর মূল থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পানি, খাঁটি দুধ, নেশাহীন সুস্বাদু মদ এবং পরিষ্কার মধুর নহর প্রবাহিত রয়েছে। ঐ গাছের ছায়ায় কোন সওয়ার যদি সত্তর বছরও ভ্রমণ করে তথাপি ওর ছায়া শেষ হবেনা। ওর এক একটি পাতা এতো বড় যে, একটি উম্মতকে ঢেকে ফেলবে। মহামহিমান্বিত আল্লাহর নূর ওকে চতুর্দিক থেকে আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। আর পাখীর আকৃতি বিশিষ্ট ফেরেশতারা ওটাকে ঢেকে ফেলে ছিলেন, যাঁরা আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলার মুহব্বতে সেখানে ছিলেন। ঐ সময় মহামহিম আল্লাহ রাসূলুল্লাহর (সঃ) সাথে কথা বলেন। তিনি তাঁকে বলেনঃ “কি চাবে চাও?” উত্তরে তিনি বলেনঃ“ হে আল্লাহ! আপনি হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) আপনার দোস্ত বানিয়েছেন এবং তাঁকে বড় সাম্রাজ্য দান করেছেন, হযরত মূসার (আঃ) সাথে আপনি কথা বলেছেন, হযরত দাউদকে (আঃ) দিয়েছেন বিরাট সাম্রাজ্য এবং তার জন্যে লোহাকে নরম করে দিয়েছেন, হযরত সুলাইমানকে (আঃ) আপনি দান করেছেন রাজত্ব, দানব, মানব, শয়তান ও বাতাসকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছেন, আর তাকে এমন রাজত্ব দান করেছেন যা তাঁর পরে আর কারো জন্যে উপযুক্ত নয়, হযরত ঈসাকে (আঃ) তাওরাত ও ইনজীল শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার নির্দেশক্রমে আপনি তাকে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দানকারী করেছেন ও মৃতকে জীবন দানকারী বানিয়েছেন, তাঁকে ও তাঁর মাতাকে বিতাড়িত শয়তান হতে রক্ষা করেছেন, তাঁদের উপর শয়তানের কোন হাত নেই। এখন আমার সম্পর্কে কি বলবেন বলুন।” তখন বিশ্বপ্রতিপালক মহামহিমান্বিত অল্লিাহ বললেনঃ “তুমি আমার খলীল (দোস্ত)। তাওরাতে আমি তোমাকে খলীলুর রহমান’ উপাধিতে ভূষিত করেছি। তোমাকে আমি সমস্ত মানুষের নিকট ভয় প্রদর্শক ও সুসংবাদ দাতারূপে প্রেরণ করেছি। তোমার বক্ষ আমি বিদীর্ণ করেছি, তোমার বোঝা হালকা করেছি এবং তোমার যিকর সমুন্নত করেছি। যেখানে আমার যি হয় সেখানে তোমারও যিকর হয়ে থাকে। (যেমন পাঁচ বারের আযানে বলা হয়ঃ “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাস্য নেই। এর পরেই বলা হয়ঃ ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর রাসূল। যিকর দ্বারা এখানে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে) তোমার উম্মতকে আমি সর্বোত্তম উম্মত বানিয়েছি, যাদেরকে জনগণের কল্যাণের) নিমিত্তে বের করা হয়েছে। তোমার উম্মতকেও আমি পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বানিয়েছি। তাদের খুৎবা জায়েয নয় যে পর্যন্ত না তারা তোমাকে আমার বান্দা ও রাসূল বলে সাক্ষ্য দেবে। আমি তোমার উম্মতের মধ্যে এমন কতকগুলি লোক রেখেছি যাদের অন্তরে তাদের কিতাবসমূহ রয়েছে। সৃষ্টি হিসেবে আমি তোমাকে সর্বপ্রথম করেছি এবং বি’ছাত হিসেবে সর্বশেষ করেছি। আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়েছি যা বারবার পাঠ করা হয়ে থাকে। (এই সাতটি আয়াত দ্বারা সূরায়ে ফাতেহাকে বুঝানো হয়েছে) এ আয়াতগুলি তোমার পূর্বে আর কাউকেও দেয়া হয় নাই। তোমাকে আমি কাওসার দান করেছি এবং ইসলামের আটটি অংশ দিয়েছি। ওগুলি হচ্ছেঃ ইসলাম, হিজরত, জিহাদ, নামায, সাদকা, রমযানের রোযা, ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ হতে নিষেধ। আমি তোমাকে শুরুকারী ও শেষকারী বানিয়েছি।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতে। লাগলেনঃ “আমাকে আমার প্রতিপালক ছ'টি জিনিসের ফযীলত দিয়েছেন। সেগুলি হচ্ছেঃ কালামের শুরু ও শেষ আমাকে দেয়া হয়েছে, আমাকে দান করা হয়েছে জামে’ কালাম (ব্যাপক ভাবপূর্ণ কথা), সমস্ত মানুষের নিকট আমাকে সুসংবাদদাতা ও ভয়প্রদর্শক রূপে প্রেরণ করা হয়েছে, এক মাসের পথের ব্যবধান থেকে শত্রুদের উপর আমার ভীতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ এক মাসের পথের দূরত্বে থেকেও শত্রুরা আমার নামে সদা ভীত সন্ত্রস্ত থাকে)। আমার জন্যে গনীমতের মাল (যুদ্ধ লব্ধ মাল) হালাল করা হয়েছে যা আমার পূর্বে কারো জন্যে হালাল ছিল না এবং আমার জন্যে সারা যমীনকে মসজিদ (সিজদার স্থান) ও অযুর স্থান বানানো হয়েছে।” তারপর রাসূলুল্লাহর (সঃ) উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়া এবং হযরত মূসার (আঃ) পরামর্শক্রমে আল্লাহ তাআলার কাছে নামাযের ওয়াক্ত কমাবার প্রার্থনা করা ও সর্বশেষে পাঁচ ওয়াক্ত থেকে যাওয়ার বর্ণনা রয়েছে। যেমন ইতিপূর্বে গত হয়েছে। সুতরাং পড়তে পাঁচ কিন্তু সওয়াবে পঞ্চাশ। এতে তিনি খুবই খুশী হন। যাওয়ার সময় হযরত মূসা (আঃ) ছিলেন কঠিন এবং আসার সময় হয়ে গেলেন অত্যন্ত কোমল ও সর্বোত্তম।

অন্য কিতাবের এই হাদীসে এটাও রয়েছে যে, (আরবি) এই আয়াতেরই তাফসীরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই ঘটনা বর্ণনা করেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের একটি রিওয়াইয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত মূসা (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং হযরত ইবরাহীমের (আঃ) দেহাকৃতির বর্ণনা দেয়ার কথাও বর্ণিত রয়েছে। সহীহ মুসলিমের হাদীসে হাতীমে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) বায়তুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা এবং তাঁর সামনে ওটা প্রকাশিত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। তাতেও এই তিনজন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করা এবং তাঁদের দৈহিক গঠনের বর্ণনা রয়েছে এবং এও আছে যে, তিনি তাদেরকে নামাযে দণ্ডায়মান পেয়েছিলেন। তিনি জাহান্নামের রক্ষক মালিককেও দেখেছিলেন এবং তিনিই প্রথমে তাঁকে সালাম করেন। ইমাম বায়হাকীর (রঃ) হাদীস গ্রন্থে কয়েকজন সাহাবী হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উম্মে হানীর (রাঃ) বাড়ীতে শুয়ে ছিলেন। তখন তিনি এশার নামায হতে ফারেগ (অবকাশপ্রাপ্ত) হয়েছিলেন। সেখান হতেই তাঁর মি’রাজ হয়। অতঃপর ইমাম হাকিম (রঃ) খুবই দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করেছেন যাতে শ্রেণী বিভাগ, ফেরেশতামণ্ডলী ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। কোন কিছুই আল্লাহ তাআলার শক্তির বাইরে নয়, যদি ঐ রিওয়াইয়াত সঠিক প্রমাণিত হয়ে যায়।

ইমাম বায়হাকী (রঃ) এই রিওয়াইয়াত বর্ণনা করার পর বলেন যে, মক্কা শরীফ হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত গমন এবং মিরাজের ব্যাপারে এই হাদীসে পূর্ণ প্রাচুর্য রয়েছে। কিন্তু এই রিওয়াইয়াতকে অনেক ইমাম মুরসাল রূপে বর্ণনা করেছেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

ইমাম বায়হাকী (রাঃ) হযরত আয়েশার (রাঃ) প্রমুখাৎ বর্ণনা করেছেন যে, সকালে যখন রাসূলুল্লাহ মিরাজের ঘটনা বর্ণনা করেন তখন বহু লোক মুরতাদ (ধর্মত্যাগী) হয়ে যায় যারা ইতিপুর্বে ঈমান আনয়ন করেছিল। তারপর হযরত সিদ্দীকে আকবারের (রাঃ) নিকট তাদের গমন, তাঁর সত্যায়িতকরণ এবং সিদ্দীক উপাধি ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে।

(প্রকাশ থাকে যে, এই সুদীর্ঘ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন আবু জা'ফর রাযী। তাঁর স্মরণ শক্তি খুব ভাল নয়। এর কতকগুলি শব্দে খুবই গরীবত ও নাকরিত রয়েছে। একে দুর্বলও বলা হয়েছে। আর শুধু তারই বর্ণিত হাদীস সমালোচনা মুক্ত নয়। কথা এই যে, স্বপ্নযুক্ত হাদীসের কিছু অংশও এতে এসে গেছে আর এটাও খুব সম্ভব যে, এটা অনেকগুলি হাদীসের সমষ্টি হবে, কিংবা স্বপ্ন অথবা মিরাজ ছাড়া অন্য কোন ঘটনার রিওয়াইয়াত হবে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)

স্বয়ং উম্মে হানী (রাঃ) বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহকে (সঃ) আমার বাড়ী হতেই মিরাজ করানো হয়। ঐ রাত্রে তিনি এশার নামাযের পর আমার বাড়ীতেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনিও ঘুমিয়ে পড়েন এবং আমরাও সবাই ঘুমিয়ে পড়ি। ফজর হওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বে আমরা তাঁকে জাগ্রত করি। তারপর তার সাথেই আমরা ফজরের নামায আদায় করি। এরপর তিনি বলেনঃ “হে উম্মে হানী (রাঃ) ! আমি তোমাদের সাথেই এশার নামায আদায় করেছি এবং এর মাঝে আল্লাহ তাআলা আমাকে বায়তুল মুকাদ্দাসে পৌঁছিয়েছেন এবং আমি সেখানে নামাযও পড়েছি।” (এই হাদীসের কালবী নামক একজন বর্ণনাকারীর বর্ণিত হাদীস সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। কিন্তু আবু ইয়ালা (রঃ) অন্য সনদে এটাকে খুব ফলাও করে বর্ণনা করেছেন)

হযরত উম্মে হানী (রাঃ) হতেই বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “রাসূলুল্লাহর (সঃ) মি’রাজ আমার এখান থেকেই হয়েছিল। আমি রাত্রে তাঁকে সব জায়গাতেই খোঁজ করি, কিন্তু কোথায়ও পাই নাই। তখন আমি ভয় পেলাম যে, না জানি হয়তো তিনি কুরায়েশদের প্রতারণায় পড়েছেন। কিন্তু পরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বর্ণনা করেনঃ “হযরত জিবরাঈল (আঃ) আমার নিকট আগমন করেছিলেন এবং আমার হাত ধরে আমাকে নিয়ে চলেন। দরজার উপর একটি জন্তু দাঁড়িয়েছিল যা খচ্চরের চেয়ে ছোট এবং গাধার চেয়ে বড়। তিনি আমাকে ওর উপর সওয়ার করিয়ে দেন। অতঃপর আমরা বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছে যাই। হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) আমি দেখতে পাই যিনি স্বভাব চরিত্রে ও আকৃতিতে সম্পূর্ণরূপে আমার সাথেই সাদৃশ্যযুক্ত ছিলেন। হযরত মূসার (আঃ) সাথেও আমাদের দেখা হয়। যিনি ছিলেন লম্বা এবং চুল ছিল সোজা। তাঁকে দেখতে অনেকটা ইদ শানওয়ার গোত্রের লোকদের মত। অনুরূপভাবে হযরত ঈসার (আঃ) সাথেও আমার সাক্ষাৎ হয় যিনি ছিলেন মধ্যমাকৃতির লোক। তার দেহের রঙ ছিল সাদা লাল মিশ্রিত। তাঁকে দেখতে অনেকটা উরওয়া ইবনু মাসউদ সাকাফীর মত। দাজ্জালকেও আমি দেখতে পাই। তার একটি চক্ষু নষ্ট ছিল। তাঁকে দেখতে ঠিক কুতনা ইবনু আবিদুল উয্যার মত।” এটুকু বলার পর তিনি বলেনঃ “আচ্ছা, আমি যাই এবং যা যা দেখেছি, কুরায়েশদের নিকট বর্ণনা করবো।” আমি তখন তার কাপড়ের বর্ডার টেনে ধরলাম এবং আরয করলামঃ আপনাকে আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি যে, আপনি এটা আপনার কওমের সামনে বর্ণনা করবেন না, তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে। তারা আপনার কথা মোটেই বিশ্বাস করবে না। আপনি তাদের কাছে গেলে তারা আপনার সাথে বে-আদবী করবে। কিন্তু তিনি ঝটকা মেরে তাঁর অঞ্চল আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলেন এবং সরাসরি কুরায়েশদের সমাবেশে গিয়ে সমস্ত কিছু বর্ণনা করলেন। তার একথা শুনে জুবাইর ইবনু মুতইম বলতে শুরু করলোঃ “দেখো, আজ আমরা জানতে পারলাম যে, যদি তুমি সত্যবাদী হতে তবে আমাদের মধ্যে বসে থেকে এরূপ কথা বলতে না।” একটি লোক বললোঃ “আচ্ছা বলতো, পথে আমাদের যাত্রীদলের সাথে দেখা হয়েছিল কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “হাঁ, তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছিল যা তারা খোঁজ করছিল।” আর একজন বললোঃ “অমুক গোত্রের উটও কি রাস্তায় দেখেছিলে?” তিনি জবাবে বলেনঃ “হাঁ, তাদেরকেও দেখেছিলাম। তারা অমুক জায়গায় ছিল। তাদের মধ্যে লাল রং এর একটি উষ্ট্রীও ছিল যার পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাদের কাছে একটি বড় পেয়ালায় পানি ছিল যার থেকে আমি পানও করেছি। তারা বললোঃ “আচ্ছা, তাদের উটগুলির সংখ্যা বল। তাদের মধ্যে রাখাল কে ছিল?” ঐ সময়েই আল্লাহ তাআলা ঐ যাত্রীদলকে তাঁর সামনে করে দেন। সুতরাং তিনি উটগুলির সংখ্যাও বলে দেন এবং রাখালদের নামও বলে দেন। তাদের মধ্যে একজন রাখাল ছিল ইবনু আবি কুহাফা। তিনি একথাও বলে দেন যে, কাল সকালে তারা সানিয়্যাহ নামক স্থানে পৌঁছে যাবে। তখন ঐ সময় অধিকাংশ লোক পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সানিয়্যাতে পৌঁছে গেলেন। গিয়ে দেখলো যে, সত্যি ঐ যাত্রীদল সেখানে এসে গেছে। তাদেরকে তারা জিজ্ঞেস করলোঃ “তোমাদের উট হারিয়ে গিয়েছিল কি?” তারা উত্তর দিলোঃ “ঠিকই হারিয়ে গিয়েছিল বটে।” দ্বিতীয় যাত্রীদলকে তারা প্রশ্ন করলোঃ “কোন লাল রঙ এর উটের পা কি ভেঙ্গে গেছে?” তারা জবাবে বললোঃ “হাঁ, এটাও সঠিকই বটে।” আবার তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “তোমাদের কাছে একটি পানির বড় পেয়ালা ছিল কি?” জবাবে আবু বকর নামক একটি লোক বললেনঃ “হাঁ, আল্লাহর শপথ! আমি নিজেই তো ওটা রেখেছিলাম। তার থেকে না তো কেউ পানি পান করছে, না তা ফেলে দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সঃ) সত্যবাদী।” এ কথা বলেই তিনি তাঁর উপর ঈমান আনলেন। আর সেদিন তাঁর নাম সিদ্দীক রাখা হলো।

এই সমুদয় হাদীস জানার পর, যে হাদীসগুলির মধ্যে সহীহও রয়েছে, হাসানও রয়েছে, দুর্বলও রয়েছে, কমপক্ষে এটুকুতো অবশ্যই জানা গেছে যে, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। আর এটাও জানা গেল যে, এটা শুধুমাত্র একবারই হয়, যদিও এটা বর্ণনাকারীগণ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশ করেছেন এবং এতে কিছু কম বেশীও রয়েছে। এটা অস্বাভাবিক কিছুই নয়। কেননা, নবীগন ছাড়া ভুল ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত কে আছে? কেউ কেউ এ ধরনের প্রত্যেক রিওয়াইয়াতকে এক একটি পৃথক ঘটনা বলেছেন। কিন্তু এ লোকগুলি বহু দূরে বেরিয়ে গেছেন এবং অসাধারণ কথা বলেছেন। তাঁরা অজানা স্থানে গমন করেছেন। তবুও তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয় নাই পরযুগীয় কোন কোন গুরুজন অন্য আর একটি বর্ণনায় ক্রমিক তালিকা পেশ করেছেন এবং এতে তারা বেশ গর্ববোধ করেছেন। তা এই যে, একবার রাসূলুল্লাহকে (সঃ) মক্কা হতে শুধু বায়তুল মুক্কাদাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। দ্বিতীয়বার মক্কা থেকে আসমান পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। তৃতীয়বার ভ্রমণ করানো হয় মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত এবং বায়তুল মুকাদ্দাস হতে আসমান পর্যন্ত। কিন্তু এই উক্তিটিও খুবই দূরের। উক্তি এবং খুবই দুর্বল উক্তি। পূর্ব যুগীয় মনীষীদের কেউই এই উক্তি করেন। নাই। যদি এরূপ হতো তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেই খুলে খুলে এটা বর্ণনা করতেন এবং বর্ণনাকারী তার থেকে এটা বার বার হওয়ার কথা রিওয়াইয়াত করতেন।

হযরত যুহরীর (রঃ) উক্তি অনুযায়ী মিরাজের এই ঘটনাটি হিজরতের এক বছর পূর্বে ঘটেছিল। উরওয়াও (রঃ) একথাই বলেন। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এটা হিজরতের ছ'মাস পূর্বের ঘটনা। সত্য কথা যে, এটা হিজরতের ছ'মাস পূর্বের ঘটনা। সত্য কথা এটাই যে, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) স্বপ্নের অবস্থায় নয়, বরং জাগ্রত অবস্থায় মক্কা হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। এ সময় তিনি বুরাকের উপর সওয়ার ছিলেন। মসজিদে কুদসের দরযার উপর তিনি বুরাকটিকে বাঁধেন এবং ভিতরে গিয়ে ওর কিবলামুখী হয়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ হিসেবে দু'রাকআত নামায আদায় করেন। তারপর মিরাজ আনয়ন করা হয়, যাতে শ্রেণী বিভাগ ছিল এবং এটা সোপান হিসেবে। তাতে করে তাঁকে দুনিয়ার আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এইভাবে তাঁকে সাতটি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। প্রত্যেক আসমানে আল্লাহর নৈকট্য লাভ কারীদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। নবীদের সাথে তাদের শ্রেণী মোতাবেক সালামের আদান প্রদান হয়। ষষ্ঠ আকাশে হযরত মূসা কালীমুল্লাহর (আঃ) সাথে এবং সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহর (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি সমান্তরালে পৌঁছেন যেখানে তিনি ভাগ্য লিখনের কলমের শব্দ শুনতে পান। তিনি সিদরাতুল মুনতাহাকে দেখেন যেখানে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ছেয়েছিল। সোনার ফড়িং এবং বিভিন্ন প্রকারের রঙ সেখানে দেখা যাচ্ছিল। ফেরেস্তাগণ কর্তৃক চারদিক ভ্রমণ করানো হয়। তৃতীয়বার ভ্রমণ করানো হয় মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত এবং বায়তুল মুকাদ্দাস হতে আসমান পর্যন্ত। কিন্তু এই উক্তিটিও খুবই দূরের উক্তি এবং খুবই দুর্বল উক্তি। পূর্ব যুগীয় মনীষীদের কেউই এই উক্তি করেন নাই। যদি এরূপ হতো তবে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেই খুলে খুলে এটা বর্ণনা করতেন। এবং বর্ণনাকারী তার থেকে এটা বারবার হওয়ার কথা রিওয়াইয়াত করতেন।

হযরত যুহরীর (রঃ) উক্তি অনুযায়ী মিরাজের এই ঘটনাটি হিজরতের এক বছর পূর্বে ঘটেছিল। উরওয়াও (রঃ) -এ কথাই বলেন যে, রাসূলুল্লাহকে (সঃ) স্বপ্নের অবস্থায় নয়, বরং জাগ্রত অবস্থায় মক্কা হতে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়। এ সময় তিনি বুরাকের উপর সওয়ার ছিলেন। মসজিদে কুদসের দরজার উপর তিনি বুরাকটিকে বাঁধেন এবং ভিতরে গিয়ে ওর কিবলামুখী হয়ে তাহিয়্যাতুল মসজিদ হিসেবে দু'রাকআত নামায আদায় করেন। তারপর মি’রাজ আনয়ন করা হয়, যাতে শ্রেণী বিভাগ ছিল এবং এটা সোপান হিসেবে। তাতে করে তাঁকে দুনিয়ার আকাশে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এইভাবে তাঁকে সাতটি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। প্রত্যেক আসমানে আল্লাহর নৈকট্যলাভকারীদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। নবীদের সাথে তাদের শ্রেণী মোতাবেক সালামের আদান প্রদান হয়। ষষ্ঠ আকাশে হযরত মূসা কালীমুল্লাহর (আঃ) সাথে এবং সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহর (আঃ) সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি ভাগ্য লিখনের কলমের শব্দ শুনতে পান। তিনি সিদরাতুল মুনতাহাকে দেখেন যেখানে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ছেয়েছিল। সোনার ফড়িং এবং বিভিন্ন প্রকারের রঙ সেখানে দেখা যাচ্ছিল। ফেরেশতাগণ চারদিক থেকে ওটাকে পরিবেষ্টন করে ছিলেন। সেখানে তিনি হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) তার আসল রূপে দেখতে পান যার ছ’শ’টি পালক ছিল। সেখানে তিনি সবুজ রঙ এর ‘ররফ” (মি’রাজের রাত্রে রাসূলুল্লাহ (সঃ) যার উপর আরোহণ করেছিলেন ওটাই রফরফ) দেখেছিলেন যা আকাশের প্রান্ত সমূহকে ঢেকে রেখেছিল। তিনি বায়তুল মা'মূরের যিয়ারত করেন যা হযরত খলীলুল্লাহ (আঃ) তাতে হেলান লাগিয়ে বসেছিলেন। সেখানে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেস্তা আল্লাহর ইবাদতের জন্যে যেয়ে থাকেন। কিন্তু একদিন যে দল যান, কিয়ামত পর্যন্ত আর তাঁদের সেখানে যাওয়ার পালা পড়ে না। তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেন। এখানে পরম করুণাময় আল্লাহ পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরজ করেন এবং পরে তা কমাতে কমাতে মাত্র পাঁচ ওয়াক্ত রেখে দেন। এটা ছিল তাঁর বিশেষ রহমত। এর দ্বারা নামাযের শ্রেষ্ঠত্ব ও ফজীলত স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অতঃপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং সমস্ত নবীও (আঃ) অবতরণ করেন। সেখানে তিনি তাঁদের সকলকেই নামায পড়ান, যখন নামাযের সময় হয়ে যায়। সম্ভবতঃ ওটা ছিল ঐ দিনের ফজরের নামায। তবে কোন কোন গুরুজনের উক্তি এই যে, তিনি নবীদের ইমামতি করেছিলেন আসমানে। কিন্তু বিশুদ্ধ রিওয়াইয়াত দ্বারা এটা প্রকাশিত হয় যে, এটা বায়তুল মুকাদ্দাসের ঘটনা। কোন কোন রিওয়াইয়াতে আছে যে, যাওয়ার পথে তিনি এ নামায পড়িয়েছিলেন। কিন্তু প্রকাশ্য কথা এই যে, ফিরবার পথে তিনি ইমামতি করেছিলেন, এর একটি দলীল তো এই যে, আসমান সমূহে নবীদের সঙ্গে যখন তার সাক্ষাৎ হয়, তখন প্রত্যেকের সম্পর্কেই হযরত জিবরাঈলকে (আঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “ইনি কে?” যদি আগমনের পথে বায়তুল মুকাদ্দাসেই তিনি তাঁদের ইমামতি করে থাকতেন তবে পরে তাঁদের সম্পর্কে এই জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন কি ছিল? দ্বিতীয় দলীল এই যে, সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য তো উঁচুতে জনাব বারী তাআলার সামনে হাজির হওয়া। তাহলে স্পষ্টতঃ এটাই ছিল সবচেয়ে অগ্রগণ্য। যখন এটা হয়ে গেল এবং তাঁর উপর ও তাঁর উম্মতের উপর ঐ রাত্রে যে ফরজ নামায নির্ধারিত হওয়ার ছিল সেটাও হয়ে গেল তখন তারস্বীয় নবী ভাইদের সাথে একত্রিত হওয়ার সুযোগ হলো। আর এই নবীদের সামনে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যেই হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁদের ইমামতি করতে তাঁর প্রতি ইঙ্গিত করলেন। তখন। তিনি তাঁদের ইমামতি করলেন। তারপর বায়তুল মুকাদ্দাস হতে বুরাকে আরোহণ করে রাত্রির অন্ধকারেই ফজরের কিছু পূর্বে তিনি মক্কা শরীফে পৌঁছে গেলেন। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান একমাত্র মহান আল্লাহরই রয়েছে।

এখন এটা যে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাঁর সামনে দুধ ও মধু বা দুধ ও শরাব অথবা দুধ ও পানি পেশ করা হয়, এই চারটি জিনিসই ছিল, এগুলি সম্পর্কে রিওয়াইয়াত সমূহে এটাও রয়েছে যে, এটা হচ্ছে বায়তুল মুকাদ্দাসের ঘটনা, আবার এও রয়েছে যে, এটা আসমান সমূহের ঘটনা। কিন্তু এটা হতে পারে যে, এই দুই জায়গাতেই এ জিনিসগুলি তাঁর সামনে হাজির করাহয়েছিল। কারণ, যেমন কোন আগন্তুকের সামনে আতিথ্য হিসেবে কোন জিনিস রাখা হয়, এটাও ঐরূপই ছিল। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

আবার এ ব্যাপারেও লোকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) এই মিরাজ দেহ ও রূহ সমেত ছিল, না শুধু আধ্যাত্মিক রূপে ছিল? অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম তো এ কথাই বলেন যে, দেহ ও আত্মাসহ তাঁর মি’রাজ হয়েছিল এবং হয়েছিল আবার জাগ্রত অবস্থায়, স্বপ্নের অবস্থায় নয়। হাঁ, তবে এটা কেউ অস্বীকার করেন না যে, প্রথমে স্বপ্নে রাসূলুল্লাহকে (সঃ) এই জিনিস গুলিই দেখানো হয়েছিল। তিনি স্বপ্নে যা দেখতেন অনুরূপভাবে জাগ্রত অবস্থাতেও ঐগুলি তাঁকে দেখানো হতো। এর বড় দলীল এক তো এই যে, এই ঘটনাটি বর্ণনা করার পর্বে আল্লাহ তাআলা স্বীয় পবিত্রতা বর্ণনা করেছেন। এই ধরনের বর্ণনারীতির দাবী এই যে, এরপরে যা বর্ণনা করা হবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এটাকে স্বপ্নের ঘটনা মেনে নেয়া হয় তবে স্বপ্নে এ সব জিনিস দেখে নেয়া তেমন কোন গুরুত্বপুর্ণ বিষয় নয় যে, তা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তাআলা পূর্বেই স্বীয় অনুগ্রহ ও ক্ষমতার প্রকাশ হিসেবে নিজের পবিত্রতা বর্ণনা করবেন। আবার এটা যদি স্বপ্নের ঘটনা হতো তবে কাফিররা এভাবে এতো তাড়াতাড়ি তাঁকে মিথ্যাবাদী মনে করতো না। কেননা, কেউ যদি তার স্বপ্নে দেখা কিছু বিস্ময়কর জিনিস বর্ণনা করে তবে শ্রোতাদের তার কথায় উত্তেজিত হওয়া এবং কঠিনভাবে তা অস্বীকার করার কোনই কারণ থাকে না। তা ছাড়া যে সবলোক এর পূর্বে ঈমান এনেছিল এবং তাঁর। রিসালাত কবুল করে নিয়েছিল, মিরাজের ঘটনা শুনে তাদের ইসলাম থেকে ফিরে আসার কি কারণ থাকতে পারে? এর দ্বারাও এটা প্রমাণিত হয় যে, তিনি স্বপ্নের ঘটনা বর্ণনা করেন নাই। তারপর কুরআন কারীমের (আরবি) শব্দের উপর চিন্তা গবেষণা করলে বুঝা যাবে যে, (আরবি) এর প্রয়োগ দেহ ও আত্মা এই দু'এর সমষ্টির উপর হয়ে থাকে। এরপর (আরবি) আল্লাহ পাকের এই উক্তি এটাকে আরো পরিষ্কার করে দিচ্ছে যে, তিনি তাঁর বান্দাকে রাত্রির সামান্য অংশের মধ্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই দেখাকে লোকদের পরীক্ষার কারণ বলা হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) যদি এটা স্বপ্নই হবে তবে এতে মানুষের বড় পরীক্ষা কি এমন ছিল যে, ভবিষ্যতের হিসেবে বর্ণনা করা হতো? হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) এই দেখা ছিল চোখের দেখা। স্বয়ং কুরআন বলেঃ (আরবি) অর্থাৎ চক্ষু টলেও নাই এবং বিপথগামীও হয় নাই।” স্পষ্ট কথা যে, (আরবি) অর্থাৎ চক্ষু বা দৃষ্টি মানুষের সত্তার একটি বড় গুণ, শুধু আত্মা নয়। তারপর বুরাকের উপর সওয়ার করিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়াও এরই দলীল যে, এটা জাগ্রত অবস্থার ঘটনা এবং এটা তাঁর সশরীরে ভ্রমণ। শুধু রূহের জন্যে সওয়ারীর কোন প্রয়োজন ছিল না। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

অন্যেরা বলেন যে, রাসূলুল্লাহর (সঃ) এই মিরাজ ছিল শুধু আত্মর, দৈহিক নয়। মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) লিখেছেনঃ “হযরত মুআবিয়া ইবনু আবি সুফইয়ান (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহর (সঃ) দেহ অদৃশ্য হয় নাই, বরং তার মি'রাজ ছিল আত্মার, দেহের নয়।” তাঁর এই উক্তিকে অস্বীকার করা হয় নাই। কেননা, হযরত হাসান (রঃ) বলেনঃ (আরবি) এই আয়ত বর্ণিত হয়েছিল এবং হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে খবর দিয়েছেন যে, তিনি বলেছিলেনঃ “আমি স্বপ্নে তোমাকে (হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে যবাহ করতে দেখেছি, সুতরাং তুমি চিন্তা কর, তোমার মত কি?” তারপর এই অবস্থাই থাকে। অতএব, এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, নবীদের (আঃ) কাছে জাগ্রত অবস্থায়ও ওয়াহী আসে এবং স্বপ্নেও আসে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলতেনঃ “আমার চক্ষু ঘুমায় বটে, কিন্তু অন্তর জেগে থাকে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। এ সবের মধ্যে সত্য কোনটি? তিনি জানেন এবং অনেক কিছু দেখেন। ঘুমন্ত বা জাগ্রত যে অবস্থাতেই তিনি থাকুন না কেন সবই হক ও সত্য। এটা ততা ছিল মুহাম্মদ ইবনু ইসহাকের (রঃ) উক্তি। ইমাম ইবনু জারীর (রঃ) এটাকে বিভিন্নভাবে খণ্ডন করেছেন এবং বলেছেন যে, এটা কুরআন কারীমের শব্দের সরাসরি উল্টো উক্তি। অতঃপর তিনি এর বিপরীত অনেক কিছু দলীল কায়েম করেছেন। এ সব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) সহীহ বুখারীতে বর্ণনা করেছেন)

এই বর্ণনায় এক অতি উত্তম ও যবরদস্ত উপকার ঐ রিওয়াইয়াত দ্বারা হয়ে থাকে যা হাঁফিজ আবু নঈম ইসবাহানী (রঃ) কিতাবুদ দালাইলিন নবুওয়াহতে আনয়ন করেছেন। রিওয়াইয়াতটি এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন দাহইয়া ইবনু খালীফাকে (রাঃ) একটি পত্র দিয়ে দূত হিসেবে রোমক সম্রাট কায়সারের নিকট প্রেরণ করেন তখন তিনি সম্রাটের নিকট পৌঁছলে সম্রাট সিরিয়ায় অবস্থানরত আরব বণিকদেরকে তার দরবারে হাজির করেন। তাঁদের মধ্যে আবু সুফিয়ান সখর ইবনু হারব (রাঃ) ছিলেন এবং তার সাথে মক্কার অন্যান্য কাফিররাও ছিল। তারপর তিনি তাদেরকে অনেকগুলি প্রশ্ন করলেন যা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আবু সুফিয়ান (রাঃ) এই চেষ্টাই করে আসছিলেন যে, কি করে রাসূলুল্লহার (সঃ) দুর্নাম সম্রাটের সামনে প্রকাশ করা যায় যাতে তাঁর প্রতি সম্রাটের মনের কোন আকর্ষণ না থাকে। তিনি নিজেই বলেছেনঃ “আমি রাসূলুল্লাহর (সঃ) প্রতি মিথ্যা আরোপ করতে এবং তার প্রতি অপবাদ দিতে শুধুমাত্র এই ভয়েও কার্পণ্য করেছিলাম যে, যদি তাঁর প্রতি আমি কোন মিথ্যা আরোপ করি তবে আমার সঙ্গীরা এর প্রতিবাদ করবে এবং সম্রাটের কাছে আমি মিথ্যাবাদী প্রমাণিত হয়ে যাবো। আর এটা হবে আমার জন্য বড় লজ্জার কথা। তৎক্ষণাৎ আমার মনে একটা ধারণা জেগে উঠলো এবং আমি বললামঃ “হে সম্রাট! শুনুন, আমি একটি ঘটনা বর্ণনা করছি যার দ্বারা আপনার সামনে এটা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়বে যে, মুহাম্মদ (সঃ) বড়ই মিথ্যাবাদী লোক। একদিন সে বর্ণনা করেছে যে, একদা রাত্রে সে মক্কা থেকে বের হয়ে আপনার। এই মসজিদে অর্থাৎ বায়তুল মুকাদ্দাসের মসজিদে কু পর্যন্ত গিয়েছে এবং ফজরের পূর্বেই মক্কায় ফিরে এসেছে। আমার এই কথা শোনা মাত্রই বায়তুল মুকাদ্দাসের লাট পাদরী, যিনি রোমক সম্রাটের ঐ মজলিসে তাঁর পার্শ্বে অত্যন্ত সম্মানের সাথে বসেছিলেন, বলে উঠলেনঃ “এটা সম্পূর্ণরূপে সত্য ঘটনা। ঐ রাত্রের ঘটনা আমার জানা আছে।” তাঁর একথা শুনে রোমক সম্রাট অত্যন্ত বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকান এবং আদবের সাথে জিজ্ঞেস করেনঃ “জনাব এটা আপনি কি করে জানলেন?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “শুনুন, আমার অভ্যাস ছিল এবং এটা আমি নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক করে নিয়েছিলাম যে, যে পর্যন্ত এই মসজিদের (বায়তুল মুকাদ্দাসের) সমস্ত দরজা। নিজের হাতে বন্ধ না করতাম সেই পর্যন্ত ঘুমাতাম না ঐ রাত্রে অভ্যাস মত দরজা বন্ধ করার জন্যে আমি দাঁড়ালাম। সমস্ত দরজা ভালরূপে বন্ধ করলাম, কিন্তু একটি দরজা বন্ধ করা আমার দ্বারা কোন ক্রমেই সম্ভব হলো না। আমি খুবই শক্তি প্রয়োগ করলাম, কিন্তু কপাট স্বস্থান হতে একটুও সরলো না। তখন আমি আমার লোকজনকে ডাক দিলাম। তারা এসে গেলে আমরা সবাই মিলে শক্তি দিলাম। কিন্তু আমাদের এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল। আমাদের মনে হলো যে, আমরা যেন একটি পাহাড়কে ওর স্থান হতে সরাতে চাচ্ছি, কিন্তু ওটা একটুও হিলছে না বা নড়ছে না। আমি তখন একজন কাঠ মিস্ত্রীকে ডাকলাম। সে অনেকক্ষণ চেষ্টা করলো, কিন্তু পরিশেষে সেও হারমানলো এবং বললোঃ “সকালে আবার দেখা যাবে।” সুতরাং ঐরাত্রে ঐ দরজার দু'টি পাল্লা ঐভাবেই খোলা থেকে গেল। সকালেই আমি ঐ দরজা কাছে গিয়ে দেখি যে, ওর পার্শ্বে কোণায় যে একটি পাথর ছিল তাতে একটি ছিদ্র রয়েছে এবং জানা যাচ্ছে যে, ঐ রাত্রে কেউ সেখানে কোন জন্তু বেঁধে রেখেছিল,ওর চিহ্ন বিদ্যমান রয়েছে। আমি তখন বুঝে ফেললাম যে, আজ রাত্রে আমাদের এই মসজিদকে কোন নবীর জন্যে খুলে রাখা হয়েছে এবং তিনি অবশ্যই এখানে নামায পড়েছেন। এই কথা আমি আমার লোকদেরকে বুঝিয়ে বললাম।” এটা খুবই দীর্ঘ হাদীস।

ফায়েদাঃ হযরত আবু খাত্তাব উমার ইবনু দাহইয়াহ (রঃ) তাঁর (আরবি) নামক গ্রন্থে হরযত আনাসের (রাঃ) বর্ণনার মাধ্যমে মিরাজের হাদীসটি আনয়ন করে ওর সম্পর্কে অতি উত্তম মন্তব্য করতঃ বলেন যে, মিরাজের হাদীসটি হলো মুতাওয়াতির। হযরত উমার ইবনু খাত্তাব (রাঃ) , হযরত আলী (রাঃ) , হযরত ইবনু মাসঊদ (রাঃ) , হযরত আবু যার (রাঃ) , হযরত মালিক ইবনু সা’সা’ (রাঃ) , হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) , হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) , হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) , হযরত শাদ্দাস ইবনু আউস (রাঃ) , হযরত উবাই ইবনু কাব (রাঃ) হযরত আবদুর রহমান ইবনু কার (রাঃ) হযরত আবু হিব্বাহ্ (রাঃ) , হযরত আবু ইয়ালা (রঃ), হযরত হুযাইফা (রাঃ) ,হযরত বুরাইদা (রাঃ) , হযরত আবু আইয়ুব (রাঃ) , হযরত আবু উমামা (রাঃ) ,হযরত সামনা ইবনু জুনদুব (রাঃ) , হযরত আবুল খামরা’ (রাঃ) , হযরত সুহাইব রূমী (রাঃ) , হযরত উম্মে হানী (রাঃ) , হযরত আয়েশা (রাঃ) , হযরত আসমা (রাঃ) প্রভৃতি হতে মিরাজের হাদীস বর্ণিত আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করেছেন। যদিও এগুলোর মধ্যে কতকগুলি রিওয়াইয়াত সনদের দিক দিয়ে বিশুদ্ধ নয়, তথাপি মোটের উপর সঠিকতার সাথে মিরাজের ঘটনা সাব্যস্ত করেছেন এবং মুসলমানরা সমষ্টিগতভাবে এর স্বীকারোক্তিকারী। হাঁ, তবে যিনদীক ও মুলহিদ লোকেরা এটা অস্বীকারকারী। তারা চায় যে, আল্লাহর নূরকে (দ্বীন ইসলামকে) নিজেদের মুখ দ্বারা নির্বাপিত করে, অথচ আল্লাহ নিজ নূরকে পূর্ণতা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে ছাড়বেন, চাই কাফিররা যতই অসন্তুষ্ট হোক না কেন।

Quran Mazid
go_to_top
Quran Mazid
Surah
Juz
Page
1
Al-Fatihah
The Opener
001
2
Al-Baqarah
The Cow
002
3
Ali 'Imran
Family of Imran
003
4
An-Nisa
The Women
004
5
Al-Ma'idah
The Table Spread
005
6
Al-An'am
The Cattle
006
7
Al-A'raf
The Heights
007
8
Al-Anfal
The Spoils of War
008
9
At-Tawbah
The Repentance
009
10
Yunus
Jonah
010
11
Hud
Hud
011
12
Yusuf
Joseph
012
13
Ar-Ra'd
The Thunder
013
14
Ibrahim
Abraham
014
15
Al-Hijr
The Rocky Tract
015
16
An-Nahl
The Bee
016
17
Al-Isra
The Night Journey
017
18
Al-Kahf
The Cave
018
19
Maryam
Mary
019
20
Taha
Ta-Ha
020
21
Al-Anbya
The Prophets
021
22
Al-Hajj
The Pilgrimage
022
23
Al-Mu'minun
The Believers
023
24
An-Nur
The Light
024
25
Al-Furqan
The Criterion
025
26
Ash-Shu'ara
The Poets
026
27
An-Naml
The Ant
027
28
Al-Qasas
The Stories
028
29
Al-'Ankabut
The Spider
029
30
Ar-Rum
The Romans
030
31
Luqman
Luqman
031
32
As-Sajdah
The Prostration
032
33
Al-Ahzab
The Combined Forces
033
34
Saba
Sheba
034
35
Fatir
Originator
035
36
Ya-Sin
Ya Sin
036
37
As-Saffat
Those who set the Ranks
037
38
Sad
The Letter "Saad"
038
39
Az-Zumar
The Troops
039
40
Ghafir
The Forgiver
040
41
Fussilat
Explained in Detail
041
42
Ash-Shuraa
The Consultation
042
43
Az-Zukhruf
The Ornaments of Gold
043
44
Ad-Dukhan
The Smoke
044
45
Al-Jathiyah
The Crouching
045
46
Al-Ahqaf
The Wind-Curved Sandhills
046
47
Muhammad
Muhammad
047
48
Al-Fath
The Victory
048
49
Al-Hujurat
The Rooms
049
50
Qaf
The Letter "Qaf"
050
51
Adh-Dhariyat
The Winnowing Winds
051
52
At-Tur
The Mount
052
53
An-Najm
The Star
053
54
Al-Qamar
The Moon
054
55
Ar-Rahman
The Beneficent
055
56
Al-Waqi'ah
The Inevitable
056
57
Al-Hadid
The Iron
057
58
Al-Mujadila
The Pleading Woman
058
59
Al-Hashr
The Exile
059
60
Al-Mumtahanah
She that is to be examined
060
61
As-Saf
The Ranks
061
62
Al-Jumu'ah
The Congregation, Friday
062
63
Al-Munafiqun
The Hypocrites
063
64
At-Taghabun
The Mutual Disillusion
064
65
At-Talaq
The Divorce
065
66
At-Tahrim
The Prohibition
066
67
Al-Mulk
The Sovereignty
067
68
Al-Qalam
The Pen
068
69
Al-Haqqah
The Reality
069
70
Al-Ma'arij
The Ascending Stairways
070
71
Nuh
Noah
071
72
Al-Jinn
The Jinn
072
73
Al-Muzzammil
The Enshrouded One
073
74
Al-Muddaththir
The Cloaked One
074
75
Al-Qiyamah
The Resurrection
075
76
Al-Insan
The Man
076
77
Al-Mursalat
The Emissaries
077
78
An-Naba
The Tidings
078
79
An-Nazi'at
Those who drag forth
079
80
Abasa
He Frowned
080
81
At-Takwir
The Overthrowing
081
82
Al-Infitar
The Cleaving
082
83
Al-Mutaffifin
The Defrauding
083
84
Al-Inshiqaq
The Sundering
084
85
Al-Buruj
The Mansions of the Stars
085
86
At-Tariq
The Nightcommer
086
87
Al-A'la
The Most High
087
88
Al-Ghashiyah
The Overwhelming
088
89
Al-Fajr
The Dawn
089
90
Al-Balad
The City
090
91
Ash-Shams
The Sun
091
92
Al-Layl
The Night
092
93
Ad-Duhaa
The Morning Hours
093
94
Ash-Sharh
The Relief
094
95
At-Tin
The Fig
095
96
Al-'Alaq
The Clot
096
97
Al-Qadr
The Power
097
98
Al-Bayyinah
The Clear Proof
098
99
Az-Zalzalah
The Earthquake
099
100
Al-'Adiyat
The Courser
100
101
Al-Qari'ah
The Calamity
101
102
At-Takathur
The Rivalry in world increase
102
103
Al-'Asr
The Declining Day
103
104
Al-Humazah
The Traducer
104
105
Al-Fil
The Elephant
105
106
Quraysh
Quraysh
106
107
Al-Ma'un
The Small kindnesses
107
108
Al-Kawthar
The Abundance
108
109
Al-Kafirun
The Disbelievers
109
110
An-Nasr
The Divine Support
110
111
Al-Masad
The Palm Fiber
111
112
Al-Ikhlas
The Sincerity
112
113
Al-Falaq
The Daybreak
113
114
An-Nas
Mankind
114
Settings